Published on: সেপ্টে ১০, ২০২৪ at ১০:৩৭
Reporter: Aniruddha Pal
এসপিটি, কলকাতা, ১০ সেপ্টেম্বর: কিছু মানুষ বেঁচে থাকেন তাদের কথা বলার জন্য, বাকিরা ম্যানগ্রোভের জঙ্গলে বাঘের শিকার হয়ে যান। এইভাবে মানুষ বনাম পশুর এই লড়াইয়ে, যা মোটেও সুখপ্রদ অভিজ্ঞতা নয় সুন্দরবনের মানুষদের, অনুপ্রেরণামূলক হয়ে দাঁড়ায় সকলের কাছে, যেখানে মানুষ মনের জোরে প্রতিকূলতা জয় করে। চুয়ান্ন বছর বয়সী গৌর মণ্ডল তেমনই একজন, গত ১৭ আগষ্ট ২০২৪ দিনে যাকে বাঘ আক্রমণ করেছিল। তার ডানদিকের ঘাড় বাঘের কামড়ে ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কামড়ের দাগ এবং আঁচড়ের দাগসহ একাধিক চোট তো ছিলই, এছাড়া মাথার খুলির পিছনেও রয়েছে ভয়ংকর চোট। প্রত্যাঘাত করে গৌর মন্ডল বাঘের সামনে রুখে দাঁড়ান, যার ফলে আরও আঘাত এড়ানো সম্ভব হয়।
এই ভয়ানক আক্রমণের পর গৌর মণ্ডলকে দ্রুত একটি স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, যেখানে তার আঘাতগুলোর চিকিৎসা করা হয়। এরপর কলকাতায় তাকে ট্রান্সফার করা হয় পরবর্তী চিকিৎসা করার জন্য। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে তাকে দ্রুত নিয়ে ভর্তি করা হয় মণিপাল হসপিটাল, ঢাকুরিয়াতে। সঙ্গে সঙ্গেই একটি বিশেষ টিম, যেখানে ছিলেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা, তারা দ্রুত চিকিৎসা পরিষেবায় নিয়োজিত হয়ে পড়েন। ইমার্জেন্সী টিম প্রস্তুত ছিল এবং দ্রুত ক্রিটিক্যাল সার্জারি করেন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য।
হসপিটালে আসার সাথে সাথে গৌর মন্ডলের সম্পূর্ণ ডায়াগনস্টিক পরীক্ষানিরীক্ষা হয়, যার মধ্যে ছিল একাধিক সিটিস্ক্যান। সিটিস্ক্যান রিপোর্টে দেখা যায় যে ট্রমার মধ্যে, ফ্র্যাকচার, যা সাধারণত হয়ে থাকে যখন কোন হাড় তিন বা বেশির ভাগই ভেঙে যায়। মাথার খুলির পিছনে, অক্সিপিটালকন্ডাইলে, সিলিন্দ্রিকাল হাড় যা খুলির সামনে ও পিছনে, এছাড়া স্টেইলয়েদপ্রোসেস, যা কানের দিকে ছিল।
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ফ্র্যাকচার হওয়ার কারণে প্রয়োজন হয়ে পরে দেখার যে কোন ক্ষতি হয়েছে কিনা, যা পুরোদস্তুর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যাওয়া থেকে অন্যান্য নিউরোলজিক্যাল সমস্যা, সবগুলো সম্ভাবনা ছিল। সিটিস্ক্যান রিপোর্টে আরও ধরা পড়ে যে ডানদিকের চিকবোনের কাছে একটি ফ্র্যাকচার, যা অস্ত্রোপচার করা জরুরি হয়ে পড়েছিল, অন্যথা মুখের আকৃতি এবং কার্যের ক্ষেত্রে বিপদজনক হতে পারত।
গৌর মন্ডলের একটি জটিল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়, যেখানে পিছনের সারভিক্যালডিকম্প্রেশন যুক্ত, যা এর আগে স্থানীয় ভেন এর উপর অতিরিক্ত চাপ এবং শিরদাঁড়া কম্প্রেসড করে দিয়েছিল। এই অস্ত্রোপচারের আরও কারণ ছিল ১৭টি হাড়ের ফ্র্যাগমেন্ট এবং বোনডাস্ট, যা এইঅস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বাদ দেওয়া হয়। ডঃ নিরুপ দত্ত, কনসালটেন্ট নিউরোসার্জন, মণিপাল হসপিটাল সার্জিক্যাল টিমকে নেতৃত্ব দেন।
এই অস্ত্রোপচার হয় তিন ঘন্টার বেশি সময় ধরে। অবশ্য এই অস্ত্রোপচার এর মধ্যে দিয়ে রিকভারির লম্বা পর্ব শুরু হয়। অস্ত্রোপচারের পর গৌর মণ্ডলকে আইটিইউতে ট্রান্সফার করা হয় যেখানে ভেন্টিলেশনের সাপোর্ট দেওয়া হয়েছিল। ওনাকে সেরিব্রালডি কঞ্জেস্টেন্ট এবং ব্যথা কমার ওষুধ দেওয়া হয়। এছাড়া তাড়াতাড়ি সেরে ওঠার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। তার জ্ঞান ফিরে আসে এবং ধীরে ধীরে উন্নতি দেখা যায়। প্রথমে তাকে এইচডিইউতে নেওয়া হয় এবং পরবর্তী সময়ে সাধারণ ওয়ার্ডে ট্রান্সফার করা হয়। গৌর মন্ডলের সেরে ওঠা বেশ গতির মধ্যে হতে থাকে। তিনি মণিপাল হসপিটালের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের অধীনে ছিলেন, যার মধ্যে ছিলেন ডঃ সায়ন চক্রবর্তী, কনসালটেন্ট, সংক্রমক বিভাগ, ডঃ বিশরূপ মুখার্জি, কনসালটেন্ট, ইএনটি সার্জারি বিভাগ, ডঃ কমল সিনহা, কনসালটেন্ট, ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগ, ডঃ কৌশিক মুখার্জি, কনসালটেন্ট, সিটিভিএস সার্জারি বিভাগ, ডঃ সুমন দাস, কনসালটেন্ট ম্যাক্সিওফেসিয়াল সার্জারি বিভাগ।
ডঃ নিরূপ দত্ত, কনসালটেন্ট নিউরোসার্জন, মণিপালহসপিটাল, ঢাকুরিয়া, বলেন,” আমরা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম গৌর মন্ডলের আঘাত দেখে। বাঘের আক্রমণে একাধিক ফ্র্যাকচার হয়েছিল। এছাড়া ওনার মুখের একাধিক জায়গায় চোট ছিল যা বিভিন্ন জায়গার কার্যকরিতার ভয়ংকর ক্ষতি করেছিল। এরফলে ওনার নিউরোলজিক্যাল ইম্পেয়ারমেন্ট হতে পারত। ওনার হাড়ের এবং পার্শ্ববর্তী টিস্যুর চোট কিরকম, তা বোঝার জন্য সিটি ইমেজের থ্রিডি কন্সট্রাকশন করা হয়। এটি সার্জিক্যাল টিমকে পরিষ্কার ছবি দেয় অস্ত্রোপচার কতটা সূক্ষ্মভাবে করতে হবে। আমাদের মণিপাল হসপিটালের টিম অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে যাতে সেরা ফল পাওয়া সম্ভব হতে পারে। ”
নিজের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে গৌর মন্ডল জানান,” আমি একটি মাছ ধরার নৌকায় ছিলাম। হঠাৎ কোথার থেকে একটি বাঘ এসে আমাকে আক্রমণ করল। এই ধাক্কায় আমি অতর্কিতে নৌকা থেকে জলে পড়ে যাই। তবে আমি একবারের জন্য লড়াই করা থেকে থামিনি, যেটা সম্ভবত বাঘটিকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। যখন আমার দুই সাথী আমাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসল এবং লড়াইতে যোগদান করল, তখন বাঘটি শেষমেশ ওই জায়গা ছেড়ে চলে গেল। আমাকে দ্রুত নিয়ে আসা হয় স্থানীয় হাসপাতালে এবং পরবর্তীকালে আনা হয় মণিপাল হসপিটাল ঢাকুরিয়াতে। আমি সত্যি ভাগ্যবান, যেভাবে জীবন ফিরে পেয়েছি। তবে আমি ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ মণিপাল হসপিটালের ডাক্তার এবং নার্সদের কাছে। তাদের সাহচর্য এবং পরিষেবা আমাকে মৃত্যুর নাগাল থেকে ফিরিয়ে এনেছে।”
গত ৩০ আগষ্ট ২০২৪ তাকে যখন ডিসচার্জ করে দেওয়া হল, তখন সে হিমোডায়নামিকালি স্টেবল ছিল, পুরোপুরি জেগে থাকার সাথে সাথে সাড়া দিচ্ছিল সব কিছুতে। এছাড়া কোনরকম সাহায্য ছাড়াই নিজের দুইহাত, দুই পা নাড়াতে পারছিল।গৌর মন্ডল বাড়ি ফিরছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ফলোআপের মধ্যে থাকবেন, যেখানে লক্ষ্য রাখা হবে ওনার পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হচ্ছে, নিশ্চিত করা হবে যাতে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে পারেন।
Published on: সেপ্টে ১০, ২০২৪ at ১০:৩৭