সমাজ সংস্কারে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেবের আবির্ভাব

দেশ ধর্ম ভ্রমণ রাজ্য
শেয়ার করুন

লেখক– শ্রীতারকব্রহ্ম দাস ব্রহ্মচারী

Published on: মার্চ ২১, ২০১৯ @ ০০:৪৮

এসপিটি বিশেষ প্রতিবেদনঃ শ্রীগৌড়ীয় বৈষ্ণব সাহিত্যাকাশে মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব এক উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্কস্বরূপ।

তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে ধর্মান্ধতা, ভেদবুদ্ধি এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতবাসীর জীবন বিপর্যস্ত ছিল। বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের বহু পূর্ব হতেই ক্ষাত্র পরিপুষ্ট ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি সমাজের সাধারণ মানুষকে পীড়িত করেছিলেন। বুদ্ধদেব এসে যদিও অহিংসার বাণী প্রচার করেছিলেন তবুও পরবর্তীকালে নাস্তিক্যবাদ, সৌরতন্ত্র, হীনযান, মহাযান, বজ্রযানাদি প্রভৃতি কূট নিয়মে মানব সমাজে কল্যাণের পথ আস্তে আস্তে রুদ্ধ হয়ে যায়।

তৎপরবর্তীকালে শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদ, রামানুজাচার্যের বিশিষ্টাদ্বৈতাবাদ, নিম্বার্কের দ্বৈতদ্বৈতাবাদাদি প্রতিষ্ঠিত হলেও সমাজের নিম্নশ্রেণীর সাধারণ মানুষেরা ছিল এই সব বিষয় থেকে দূরে। আর শূদ্র জাতীয় সাধারণ নিম্নশ্রেণীর মানুষ ছিল সমাজে ঘৃণিত, অবহেলিত, উপেক্ষিত এবং লাঞ্ছিত। তাদের জীবন ছিল ভারবাহী পশুর মতো, গলায় ঘণ্টা বেঁধে তাদের পথ চলতে হতো। তারপর আবার বাংলার সেন রাজগণ জাতিভেদকে শতধা ভাগে ভাগ করলেন। ঐ সময় সমাজে কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তন হলে উচ্চ শ্রেণীর নিষ্পেষণে শূদ্র জাতীয় সাধারণ মানুষ প্রবলভাবে হাঁপিয়ে উঠলো।

মহাপ্রভুর আবির্ভাব এক তাৎপর্যমন্ডিত যুগান্তকারী ঘটনা

১) অনন্তর তুর্কীর আক্রমণে জাতীয় জীবন বিপর্যস্ত হলো, আর মঠ-মন্দিরাদি প্রতিষ্ঠান সমূহ ধ্বংস হতে লাগলো, জনজীবন ভীষণভাবে দুর্বিসহ হয়ে উঠলো। বিদেশিদের আক্রমণে ভারতবাসীর ধর্মজীবনে বিপর্যয় নেমে এলো। মুন্ড নিয়ে গেন্ডু খেলার মধ্য দলে দলে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করতে লাগলো। সমাজের এই প্রকার দূরাবস্থা দর্শন করে শান্তিপুর নাথ শ্রীদ্বৈতাচার্য সনাতন বৈদিক সমাজকে সঙ্কটময় পরিস্থিতি হতে রক্ষা করার জন্য তুলসী-গঙ্গাজলে ভগবদারাধনায় নিযুক্ত হলেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রার্থণা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সন্নিধানে উপনীত হলে ১৪০৭ শকের (১৪৮৬ খৃঃ) ফাল্গুনী পূর্ণিমায় সন্ধ্যাকালে তিনি শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব বিশেষ এক তাৎপর্যমন্ডিত যুগান্তকারী ঘটনা।

২) ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার অবক্ষয়ের দিনে গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে সহস্র সূর্যের মতো দশদিক আলোয় উদ্ভাসিত করে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর আবির্ভাবে সমাজ জীবনে ধর্ম, দর্শন, সমাজনীতি, রাজনীতি ও সাহিত্য ক্ষেত্রে এক বিশেষ বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। তিনি ছিলেন এক মহান বিপ্লবী সমাজ-সংস্কারক।সমাজের ভয়ানক দুঃসময়ে তিনি মানবজাতির কল্যাণের জন্য কলির যুগধর্ম হরিনাম সংকীর্তন প্রচার করেন।

৩) জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণকে ঐক্যবোধে উদ্দীপিত করে বৈদিক সাম্যবাদ প্রকাশের মাধ্যমে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে কোন ভেদ নেই। চন্ডাল যদি হরিভক্তি পরায়ণ হয়, তবে সে ব্রাহ্মণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। হরিভক্তি পরায়ণ যবন হরিদাসকে তিনি আচার্যত্ব দান করলেন। খোলাবেচা দরিদ্র শ্রীধর হতে গজপতি রাজা প্রতাপরুদ্র পর্যন্ত, মহাপাপী জগাই-মাধাই হতে রাজমন্ত্রী রূপ-সনাতন পর্যন্ত আপামর মানুষকে তিনি শ্রীহরিণাম সংকীর্তনের মাধ্যমে একত্রিত করে মানবতার স্বাভাবিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনেন।ধনী-নির্ধন, ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল-ম্লেচ্ছ, উচ্চ-নীচ সমাজের সকল স্তরের মানুষকে তিনি মানবতার এক আসনে বসবার সুযোগ দান কলেন শ্রীহরিনাম সংকীর্তন আন্দোলনের মাধ্যমে। অবহেলিত, অপমানিত, লাঞ্ছিত, ঘৃণিত, কলুষিত মূঢ় ম্লান সমাজকে প্রেম, স্নেহ-ভালবাসার ম্নত্র দিয়ে তিনি ভারতীয় বোইদিক সংস্কৃতি ও সনাতন ধর্মকে রক্ষা করলেন।

শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের প্রতি মুগ্ধ হয়ে হরিনাম সংকীর্তনে অনুমতি দেন নবদ্বীপের শাসক চাঁদকাজী

১) শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু জানতেন- জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা আতঙ্কিত পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ ও কলহে শতধা বিভক্ত ভেদবুদ্ধি কলুষিত সমাজের মধ্যে একটা স্থায়ী কল্যাণকর পরিবর্তন আনতে হলে নতুন দৃষ্টিতে ধর্ম সংস্থাপন করতে হবে। আর সেই দৃষ্টি হলো স্নেহ-প্রেম ও অহিংসার দৃষ্টি। তিনি সর্বপ্রথম অহিংসার পথে আইন-অমান্য অন্দোলন প্রবর্তন করেন। তৎকালে নবদ্বীপের শাসক চাঁদকাজী আদেশ জারি করেছিলেন- নগরে বা গৃহে কেউ হরিনাম সংকীর্তন করলে সে দণ্ডনীয় হবে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব সদলে হুঙ্কার দিয়ে সেই দিনই সন্ধ্যাকালে চাঁদকাজীর অঙ্গনে গিয়ে উচ্চস্বরে শ্রীহরিনাম সংকীর্তন করতে লাগলেন। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের ভাবমন্ডিত ও গম্ভীর মুখমন্ডল, অহিংসা প্রেমের নির্ঝর, অপার করুণাপূর্ণ দৃষ্টি দর্শন মাত্রেই চাঁদকাজী মুগ্ধ, অভিভূত এবং ভীত হয়ে তাঁর শ্রীচরণে ক্ষমা প্রার্থনা করে শ্রীহরিনাম সংকীর্তন করার জন্য ঢালাও অনুমতি প্রদান করলেন।

২) বললেন- “আমার বংশে কেউ যদি হরিনাম সংকীর্তনে বাধা দেয় আমি তাকে কঠিন শাস্তি দেব। এটি অহিংসার পথে আইন অমান্য আন্দোলনের ও তার সাফল্যের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেবই তার সর্বপ্রথম প্রবর্তক। প্রেমের দ্বারা সকল প্রকার শত্রুতা ও বিদ্বেষ ভাব যে দূর হয় তা তিনি নিজ জীবনে এভাবে দেখিয়েছেন। অস্পৃশ্যতা বর্জন, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে আশ্রয় দান, প্রেম বিতরন করে শ্রীহরিনামে উন্মুক্তকরণ-এ সকলের মধ্য দিয়েই তিনি বাস্তব সমাজ সংস্কারের রূপটি উজ্জ্বল্ভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর অহিংসক সাম্যনীতি, আর অমৃতময় মধুর জীবনের ছোঁয়াচ পেয়ে সমাজ জীবনে এক জাগরণ প্রকটিত হলো। একেই বলে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য রেনেসাঁস বা সমাজের নবজাগরণ।

শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেবের সাম্যচিন্তার আজ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে

১) শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব সুকোমল প্রেমিক হৃদয় হলেও জগৎ জীবের মঙ্গলের জন্য আত্মসংযম ও ত্যাগ বৈরাগ্যের দ্বারা সংস্কার বন্ধন ছিন্ন করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সংযম, তিতিক্ষা, সৌন্দর্য, সুতীক্ষ্ণ প্রতিভা, অনন্য সুলভ পাণ্ডিত্য প্রকর্ষ, স্বভাব সুলভ কোমল বাক্যালাপ, বিনয়গর্ভ অমায়িক ব্যবহার ইত্যাদি দিব্যগুণাবলী সকল জাতীয় লোকের চিত্তাকর্ষক ছিল। এ জন্যই তাঁর প্রবর্তিত ধর্মে তৎকালীন সমাজের সকল শ্রেণীর লোকই সমভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল।

২) এতে নৈয়ায়িক বাসুদেব সার্বভৌম ভট্টাচার্য, কাশিবাসী সন্ন্যাসী কুলগুরু প্রকাশানন্দ সরস্বতী, দুর্বিনীত পাঠান সৈন্যাধ্যক্ষ বিজলীখান, নবদ্বীপের শাসঙ্কর্তা মাওলানা সিরাজউদ্দীন চাঁদকাজী, গৌড়ের বাদশা আলাউদ্দিন হুসেন শাহ, বিপক্ষ নৃপতি কুল তিলক মহারাজ প্রতাপ্রুদ্র, সদলে বনদস্যু সর্দার নারোজী, দুর্বৃত্ত জগাই-মাধাই প্রমুখ বিপরীত ভাবাপন্ন ব্যক্তিগণ শ্রীচৈতন্যচরণের আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন। নৈয়ায়িক রঘুনাথ, সরল বুদ্ধি শ্রীনিবাস পণ্ডিত, অতি দরিদ্র খোলাবেচা শ্রীধর, রাজমন্ত্রী শ্রীরূপ-সনাতন, তৎকালীন বারলক্ষ মুদ্রা আয়ের জমিদারির অধিপতি রঘুনাথ দাস, রাজা রামানন্দ রায় প্রমুখগণ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের প্রতি গুণাকৃষ্ট হয়ে চিরতরে আত্মসমর্পন করেছিলেন। তাঁর দিব্যগুণাবলীতে জগৎবাসী মুগ্ধ।

৩) তাঁর প্রচারিত আদর্শ পন্থা সমাজের সকলের জন্যই কল্যাণজনক। ভেদবুদ্ধি কলঙ্কিত সমাজ জীবনে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেবের সাম্যচিন্তার আজ প্রয়োজন রয়েছে। নগর কীর্তনের মধ্য দিয়ে তিনি সকল স্তরের মানুষকে প্রেমধর্মের পথে টেনে নিয়েছিলেন, এই ধর্মপথে সকলেই পেল মানবতার অধিকার। এই সংগঠন একটি বড় মহাশক্তি। এই সংগঠনের মাধ্যমেই তিনি মনুষ্যত্বের জাগরণ ঘটিয়েছিলেন। আর যেখানেই সমাজের সকল মানুষ সাম্যের ধারণা পেয়েছিলেন। আজকের দিনে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেবের প্রবর্তিত আদর্শ অত্যন্ত প্রয়োজন। ফাল্গুনী দোলপূর্ণিমায় তাঁর শুভ আবির্ভাব দিবসে আমরা সকলে তাঁর কাছে প্রার্থনা জানাই -তিনি আমাদের সকলের প্রতি শুভ দৃষ্টিপাত করুন।

Published on: মার্চ ২১, ২০১৯ @ ০০:৪৮


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

91 − = 88