রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সন্ধান মিলল লালগড়ের জঙ্গলে, ফাঁদ ক্যামেরায় ধরা পড়ল সেই ছবি

এসপিটি এক্সক্লুসিভ দেশ বন্যপ্রাণ রাজ্য
শেয়ার করুন

সংবাদদাতা-বাপ্পা মণ্ডল                ছবি-বন দফতর

Published on: মার্চ ২, ২০১৮ @ ১৫:৪৭

একসময় জঙ্গলমহলের এই লালগড় সশস্ত্র মাওবাদীদের আতঙ্কে খবরের শিরোনামে উঠে এসছিল। সেইসময় একদিকে যেমন ছিল ছত্রধরের নেতৃত্বে পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটির আন্দোলন আর একদিকে ছিল  কিষেনজির নেতৃত্বে গোটা জঙ্গলমহল জুড়ে মাওবাদীদের দৌরাত্ম। ফের দশ বছর বাদে লালগড় উঠে এল খবরের শিরোনামে। এবার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের আতঙ্ক।  

এসপিটি নিউজ, লালগড়, ২ মার্চঃ গত এক মাস ধরে চলছিল বাঘ নিয়ে জল্পনা। জঙ্গলমহলের মানুষ বারে বারে বাঘের কথা বলে গেলেও বন দফতর বিষয়টি আমল দিতে চাইছিল না। অবশেষে জঙ্গলমহলবাসীর কথাই সত্যি প্রমাণিত হল।বৃহস্পতিবার ভোর ৪টে ২৮ মিনিটে বাঘটি জঙ্গলের ফাঁদ ক্যামেরায় ধরা পড়ে।

এরপর সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে ঐ ফাঁদ ক্যামেরাতেই ধরা পড়ে পূর্ণ বয়স্ক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারটি। যেখানে দেখা যাচ্ছে বাঘটি নিশ্চিন্ত মনেই জঙ্গলের ভিতর চলাফেরা করে বেড়াচ্ছে।

রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বলতে এতদিন সকলেই বুঝত সুন্দরবনের জঙ্গল। কিন্তু ঝাড়গ্রাম জেলার লালগড়ের মেলখেড়িয়ার জঙ্গলে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার দেখতে পাওয়া যাবে তা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। গত ৩০ জানুয়ারি থেকে লালগড়ের আমলিয়া, মেলখেড়িয়া, সিজুয়া, কাঁটাপাহাড়ি, পড়াডিহা সহ জঙ্গলঘেরা গ্রামগুলিতে বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পায় গ্রামবাসীরা। এমনকি মেলখেড়িয়ায় একটি জলাশয়ে বাঘটি জল খেতে গিয়েছিল বলে তার আশপাশে বাঘটির পায়ের ছাপও দেখেছে গ্রামবাসীরা।এর পর থেকেই গোটা লালগড় জুড়ে বাঘের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

যার ফলে পড়াডিহা গ্রামের শিশু শিক্ষা কেন্দ্রটি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি মেলখেড়িয়ার জঙ্গলে একটি হিংস্র জন্তু দেখতে পায় ঐ গ্রামের বাসিন্দা গোপীনাথ মুরমু। ২৬ তারিখ অতিরিক্ত বনাধিকারিক পূরবী মাহাতর নেতৃত্বে চারজন বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞ লালগড়ের ঐ গ্রামগুলিতে পৌঁছয়। তারা হিংস্র জন্তুটির পায়ের ছাপ সংগ্রহ করে। হিংস্র জন্তুটি ঠিক কি বাঘ না অন্য কিছু তা জানার জন্য জঙ্গলে সাতটি ট্র্যাপ বা ফাঁদ ক্যামেরা লাগানো হয়।

জেলা বনাধিকারিক রবীন্দ্রনাথ সাহা জানান, জঙ্গলমহলের ইতিহাসে এমন ঘটনা সত্যিই বিরল। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত এখানে বাঘের দেখা কোনওদিন পাওয়া যায়নি। তাই প্রথমে আমরা এখানকার মানুষের কথায় বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কিন্তু ফাঁদ ক্যামেরায় পূর্ণ বয়স্ক বাঘের ছবি দেখার পর আমাদের ভুল ভাঙল।

জেলা বনাধিকারিক রবীন্দ্রনাথ সাহা বৃহস্পতিবার দুপুর দুটো নাগাদ সাংবাদিক সম্মেলন করে লালগড়ের জঙ্গলে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের দেখা পাওয়ার কথা জানান। তিনি বলেন, লালগড় থানার সিজুয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ৭৯ নম্বর জঙ্গল খাস মৌজার মেলখেড়িয়া গ্রামে যে ফাঁদ ক্যামেরাটি লাগানো রয়েছে তাতে বাঘের ছবি ধরা পড়েছে। বাঘটি পূর্ণ বয়স্ক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। বাঘটি কাঁটাপাহাড়ি বিটের মেলখেড়িয়ার জঙ্গলে সাতটি গরুকে মেরেছে, চারটি গরু জখম হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ক্যামেরার সূত্র ধরে বলা যায় বাঘটি এই মুহূর্তে যে জায়গায় অবস্থান করছে সেখানে ৩৫টি দাঁতাল হাতি রয়েছে। যা বন দফতরের চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিষয়টি বন দফতরের উদ্ধতন কতৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

লালগড়ের জঙ্গলে একেবারে পূর্ণ বয়স্ক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার কিভাবে চলে এল তা নিয়েও কিন্তু অবাক হয়ে গিয়েছেন স্থানীয় বন কর্মীরা। জঙ্গলমহলের ইতিহাসে এখানে বাঘের দেখা কোনওদিন পাওয়া যায়নি। তবে এই বাঘটি ঠিক কিভাবে এখানে চলে এল তা নিয়েও কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। বনাধিকারিক রবীন্দ্রনাথ সাহা মনে করছেন, বাঘটি হয়তো ওড়িশার সিমলিপালের জঙ্গল থেকে চলে এসছে।তবে বাঘটির আসার করিডরটিকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বন দফতর।

সাধারণতঃ ভারতে ব্যাঘ্র প্রকল্পগুলি ছাড়া সেভাবে বাঘের দেখা পাওয়া খুব একটা যায় না। সেখানে লালগড়ের জঙ্গলে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব মেলায় ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞরা একদিকে উচ্ছ্বসিত আবার আর এক দিকে চিন্তিতও বটে।তাদের মতে, বর্তমানে ভারতে বাঘের সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে। এধরনের প্রাণীর অস্তিত্ব যত বাড়বে ততই বন্য পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা পাবে।তবে চিন্তার কারণ, এ ধরনের বাঘকে ঘিরে যে ধরনের শোরগোল শুরু হয়েছে তাতে করে যে কোনও মুহূর্তেই কিন্তু এই বাঘটি ক্ষুব্ধ জনতার মাঝে পড়ে গেলে আক্রান্ত হতে পারে।

বাঘটিকে বন দফতর এখনও ধরতে পারেনি। তবে সুন্দরবনে ব্যাঘ্র প্রকল্পের কর্মীদের খবর দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে বাঘ ধরার চারজনের এক প্রতিনিধি দল রওনা দিয়েছে।

তবে বাঘটিকে যতক্ষন না ধরা যাচ্ছে ততক্ষন লালগড়ের জঙ্গল এলাকায় আশপাশের গ্রামের মানুষদের বাড়ি থেকে বেরোতে নিষেধ করা হয়েছে। বেরোলে এক সঙ্গে দশ জনের বেশি মানুষ যাতে বেরোয় আর তারা যেন মুখে জোরে হজোরে আওয়াজ করতে করতে যায়।এখনও পর্যন্ত বাঘটি কিন্তু একজন মানুষকেও আক্রমণ করেনি। কিংবা ওই বাঘের হামলায় কোনও মানুষ আক্রান্তও হয়নি। তবে বাঘটি কয়েকটি গরু খেয়েছে বলে গ্রামবাসীরা দাবি করেছে।

বাঘের হদিশ মেলায় বন দফতর নিশ্চিত হলেও লালগড়ের মেলখেড়িয়া, সিজুয়া, কাঁটাপাহাড়ি, আমলিয়া সহ জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলির বাসিন্দারা বাঘের আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।

Published on: মার্চ ২, ২০১৮ @ ১৫:৪৭

 


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 + 6 =