ফিজ থেকে ভর্তি, স্কুল থেকে কিনতে হচ্ছে বইও, চাপে পড়ে জেরবার অভিভাবকরা

Main অর্থ ও বাণিজ্য কোভিড-১৯ দেশ রাজ্য
শেয়ার করুন

  • লকডাউন চলার সময় থেকেই মধ্যমগ্রামে সুধীর মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউশনে বহাল তবিয়তেই অভিভাবকদের ফোন করে স্কুলে ডেকে ভর্তির টাকা ড্রাফট মারফত কিংবা নগদ টাকা জমা নেওয়া চলছে বলে অভিযোগ।
  • কামারহাটির দ্য অ্যারিয়ান স্কুল এই মহামারীর পরিস্থিতিতিতেও কার্নিভাল, স্পোর্টস, কম্পিউটার ল্যাব থেকে সরস্বতী পুজোর টাকা জমা দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ।
  • নৈহাটির সেন্ট লুক’স ডে স্কুলের বিরুদ্ধেও প্রশ্ন উঠেছে -এই মহামারীর পরিস্থিতিতেও কিভাবে তারা ক্লাস ফাইভের ভর্তিতে 11 হাজার টাকা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ চার্জ বাবদ রাখতে পারে? কিভাবে তারা ডেভেলপমেন্ট ফিজ বাবদ 200টাকা রাখে?

 সাংবাদিক-অনিরুদ্ধ পাল

Published on: মে ২৯, ২০২০ @ ২১:৩৬

এসপিটি নিউজ, কলকাতা, ২৯ মে:  সরকার বলেছিল স্কুলগুলিকে মানবিক হতে। কিন্তু এক শ্রেণির ইংরাজি মাধ্যম স্কুল তার বদলে যা করছে তা অভিভাবকদের কাছে দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। লকডাউনের ভিতর বেশ কিছু ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে মান্থলি ফিজ থেকে ভর্তির টাকা জমা নেওয়া চলছে বহাল তবিয়তে। এমনকি, কিছু স্কুল বই তাদের ক্যাম্পাস থেকেই বিক্রি করছে, ভর্তির টাকা জমা দেওয়ার শর্তসাপেক্ষে।মধ্যমগ্রাম, কামারহাটি, নৈহাটি সর্বত্র একই চিত্র। এর বাইরেও কিন্তু আবার কিছু ইংরাজি মাধ্যমের স্কুল তাদের মানবিক রূপ দেখিয়েছে।

মধ্যমগ্রামে সুধীর মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউশন

লকডাউন চলার সময় থেকেই এই স্কুলটিতে বহাল তবিয়তেই অভিভাবকদের ফোন করে স্কুলে ডেকে ভর্তির টাকা ড্রাফট মারফত জমা নেওয়া শুরু হয়। স্কুলের অভিভাবকদের একটা অংশ স্কুলের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সরব হয়। স্কুলের বিরুদ্ধে ফিজ বৃদ্ধি থেকে এই সংকটকালে চাপ দিয়ে ভর্তির টাকা আদায় করা থেকে আনুষঙ্গিক সমস্ত খরচ দিতে বাধ্য করার অভিযোগ করে তারা। এই বিষয়ে তারা সংবাদ প্রভাকর টাইমস-এর দফতরে লিখিতভাবে সবিস্তারে জানায়। সেই চিঠি পাওয়ার পরই আমরা স্কুলের ডিরেক্টর সুমন ভট্টাচার্যের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করি। তিনি জানান-

  • “স্কুল কোনও ফিজ বৃদ্ধি করেনি। আমরা ভর্তির টাকা আদায়েও অভিভাবকদের উপর চাপ সৃষ্টি করিনি।”
  • “আমরা তিন বছর অন্তর মান্থলি ফিজ বাড়াই। সেটা এতদিন বাড়ায়নি।”
  • “আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের এক থেকে দু’লাখ টাকার মেডিক্লেম করে দিয়েছি।”
  • “আমরা ১০ শতাংশ ছাড়ে বই দিচ্ছি। যা অন্য কেউ দেয় না।”
  • “আমরা প্রত্যেক অভিভাবকদের বুকলিস্ট দিয়ে দিয়েছি। তারা ইচ্ছা করলে বাইরে থেকেও বই কিনতে পারেন। তবে স্কুল থেকে নিলে এক সঙ্গে সমস্ত বই পেয়ে যাবেন।”
  • “আমরা সোশ্যাল ডিসট্যান্স বজায় রেখেই ভর্তি এবং বই সরবরাহ করেছি।”
  • “আমরা লকডাউন উঠে যাওয়ার পর অভিভাবকদের নিয়ে বৈঠকে বসব।”
  • “আমরা সমস্ত বিষয় জানিয়ে স্থানীয় বিধায়ক রথীন ঘোষকে চিঠি দিয়েছি।”

স্কুলের ডিরেক্টরের এই সমস্ত কথার সূত্র ধরে অভিভাবকরা জোরালো ভাবেই জানালেন এই কথায় মধ্যে অনেক ফাক আছে। তারা বিধায়ককে পাঠানো স্কুলের পক্ষ থেকে মেলের সূত্র ধরে খন্ডন করতে থাকেন বিষয়গুলি।

১)”সেপ্টেম্বর ২০১৯ -এ ফিজ বৃদ্ধির কোনও ইঙ্গিত ছিল না। তাছাড়া উনি বলেছেন যে গত তিন বছরে ফিজ বৃদ্ধি করা হয়নি। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। প্রতি বছরেই আমরা বর্ধ্বিত ফিজ দিয়ে গেছি। সেটা আমাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে উল্লেখ আছে। “
২) “মেইলের দু’নম্বর পয়েন্ট দেখুন- সেখানে যা লেখা আছে তাতে এটা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম যে সেপ্টেম্বরে কোনও ফিজ বাড়ানো হয়নি আবার কমানোও হয়নি।মিথ্যে কথা বলছেন।”
৩)ওরা যে বলছে মেডিকেল ইন্স্যুরেন্স কভার ১ থেকে ২ লাখ করে দিয়েছে। এটা কি করতে পারে, আমাদের সঙ্গে কোনও আলোচনা না করে? যেখানে প্রিমিয়াম আমদের পকেট থেকে যাবে? সেটা আমরা এই পরিস্থিতিতে দিতে পারবো কিনা সেটা জানারও প্রয়োজন বোধ করেনি।অধিকাংশ অভিভাবক বলছেন- তাদের ইন্স্যুরেন্স এর দরকার নেই।
৪) ওরা তো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নির্দেশও মানছে না। এভাবে পার্সেন্টেজ অ্যাডমিশন করিয়ে ওরা প্রেশার ট্যাকটিক্স করতে চাইছে। পরে বলবে- সবাই তো অ্যাডমিশন করিয়ে নিয়েছে, আপনাদের সমস্যা কেনো? সবাইকে এখন ভয় দেখাচ্ছে বই পাওয়া যাবে না।
৫) লকডাউনে স্কুল খুলে অ্যাডমিশনের টাকা জমা নিতে পারছে আর অভিভাবকদের সঙ্গে মিটিং করতে পারবে না। ভিড় তো হবে না। খুব বেশি হলে ১২ জন অভিভাবক অংশ নেবে।
৬) সরকারি নির্দেশিকায় পরিষ্কার বলা আছে যে স্কুল-কলেজ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা যাবে না।
৭) এখানে মেল-এ সুমনবাবু কিন্তু বলেননি যে ফিজ কমানো হবে। শুধু বলছেন যে যাদের ফিজ নিয়ে যাদের মনে ধোঁত্যাশা আছে তারা স্কুলের প্রশাসনিক বিভাগে কথা বলে সন্দেহ দূর করে নিতে পারেন। অথচ আগে উনি বলেছেন ফিজ বাড়ানো হয়নি বা বাড়ানো হবে না। শুধুমাত্র লেট ফাইন নেওয়া হবে না সেটা বলেছেন।

বিধায়ক রথীন ঘোষ যা বললেন

“আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন সুধীর মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউশনের অভিভাবকদের একাংশ। ওনারা ফিজ বাড়ানো সহ একাধিক অভিযোগ করেছেন। আমি স্কুলের সঙ্গে কথা বলেছি। আমি জানিয়েছি স্কুলকে-আপনারা এমন কিছু করবেন না যাতে এই মহামারীর সময় অভিভাবকরা সমস্যায় পড়েন। সরকারি নিয়ম মেনে সব কিছু করুন। সব ছাত্র-ছাত্রী যাতে বই পায় সেদিকে নজর দিন।”

একই অভিযোগ নৈহাটির সেন্ট লুক’স ডে স্কুল ও কামারহাটির দ্য অ্যারিয়ান স্কুলের বিরুদ্ধেও

কামারহাটির অ্যারিয়ান স্কুলেও বৃহস্পতিবার অভিভাবকরা বিক্ষোভ দেখান। সেখানেও ভর্তি, ফিজ বৃদ্ধি সহ একাধিক অভিযোগ করেছেন অভিভাবকরা। তাদের অভিযোগ- স্কুল কর্তৃপক্ষ সমানে তাদের মেল করে মেসেজ পাঠিয়ে বলছে আপনারা ভর্তি করে যান। ফিজ দিয়ে যান। এই পরিস্থিতিতে তারা কি এভাবে চাপ সৃষ্টি করতে পারেন? অভিযোগ- স্কুল এই মহামারীর পরিস্থিতিতিতেও কার্নিভাল, স্পোর্টস, কম্পিউটার ল্যাব থেকে সরস্বতী পুজোর টাকা জমা দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। তাদের বলা হচ্ছে 27 তারিখ থেকে আপনারা স্কুলে এসে টাকা জমা দিয়ে যান।

স্কুল কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলেছেন- তারা কোনও চাপ সৃষ্টি করছেন না। অভিভাবকরা ইচ্ছা করলে টাকা চারটি কিস্তিতে জমা দিতে পারবেন।

এরকমই অভিযোগ উঠেছে নৈহাটির সেন্ট লুক’স ডে স্কুল -এর বিরুদ্ধেও। যদিও এখানে এই স্কুলের ক্যাম্পাসে রয়েছে আরও দু’টি নামের স্কুল- সেন্ট লুক কেজি ও হরপ্রসাদ প্রাইমারি ইনস্টিটিউশন।সবকটি স্কুলই একই বিল্ডিং-এ। অভিযোগ- রীতিমতো পরের পর মেসেজ পাঠিয়ে রিপোর্ট কার্ড বিতরনের সুযোগ নিয়ে তারা প্রতিটি ক্লাসের বাচ্চাদের ভর্তি করিয়ে নিয়েছে। আর ভর্তি না করলে বই তারা দেবে না আগেই জানিয়ে দিয়েছিল। সেই ভয়ে অভিভাবকদের অধিকাংশই স্কুলের নির্দেশ মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। না হলে যে বাচ্চা বই পাবে না। কেননা এই স্কুলে গরমের ছুটি পড়ে গিয়েছে। আর তার জন্য তারা রবিবারেও স্কুল খোলা রেখে ভর্তির কর্মকান্ড চালিয়ে গিয়েছে বহাল তবিয়তে। এখানে অভিভাবকরা অবশ্য বিক্ষোভ দেখানোর সাহস পাননি। তবে এই স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি ফিজ নেওয়া হয়েছে 8 হাজার টাকা, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ চার্জ বাবদ নেওয়া হয়েছে 11 হাজার টাকা। মান্থলি ফিজ 1100 টাকা এবং ডেভেলপমেন্ট ফিজ নেওয়া হয়েছে 200 টাকা। এখন প্রশ্ন উঠছে, এই মহামারীর পরিস্থিতিতে স্কুল কিভাবে অভিভাবকদের উপর এভাবে চাপ দিয়ে ডেভেলপমেন্ট ফিজ- 200 টাকা এবং অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ চার্জ বাবদ 11 হাজার টাকা নিতে পারে। এর কোনও জবাব অবশ্য পাওয়া যায়নি। আমরা স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। কোনও সদুত্তর মেলেনি। তবে এসএম এস মারফত তারা একটি বার্তা পাঠিয়ে জানায়- তারা কোনও ফিজ বাড়ায়নি। 2019-20 সালের ফিজ বহাল রেখেছে। আর ভর্তির সময়সীমা 15 জুলাই শেষ তারিখ রেখেছে।

আইসিএসই -এর ন্যাশনাল জয়েন্ট সেক্রেটারি নবারুন দে জানালেন-

“কাউন্সিল পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে- ফিজ বাড়ানো যাবে না। আগের বছরের ফিজ বহাল রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে এপ্রিল-মে মাসে কাউকে চাপ দেওয়া যাবে না। আমরা এই নির্দেশিকা মেনে কাজ করছি। ডিআই স্কুলকে লিখিতভাবে তা জানিয়েছি যে আমরা ফিজ বাড়ায়নি। কিন্তু অনেক স্কুল এসব না মেনে তাদের মতো কাজ করে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী। ”

শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন-

” স্কুলগুলিকে অবশ্যই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলতে হবে। এই পরিস্থিতিতে তাদের কোনওভাবেই অভিভাবকদের উপর চাপ সৃষ্টি করা চলবে না।”

রাজ্যের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য জানান- গোটা পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে না জেনে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে, স্কুলগুলির কাছে আবেদন- আপনারা এই পরিস্থিতিতে সরকারের নির্দেশ মেনে মানবিক হয়ে কাজ করুন। অভিভাবকদের দিকটা বিশেষভাবে বিবেচনা করুন।

মানবিক রূপ দেখাল এই স্কুলগুলি

এত সব কান্ডের মধ্যেও কিন্তু মানবিক রূপ দেখিয়েছে বরানগর সেন্ট্রাল মডেল স্কুল। তারা অভিভাবকদের উপর চাপ সৃষ্টি করেনি। এই স্কুল বই-খাতা বিক্রি করে না। অভিভাবকদের বুকলিস্ট দিয়ে দেয়।বাইরে থেকে কেনার জন্য।

ডানকুনির এস এম মেমোরিয়াল স্কুল। তারা অভিভাবকদের কাছ থেকে প্রতিটি ক্লাসে ভর্তি বাবদ মাত্র এক হাজার টাকা নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের নাম নতুন ক্লাসের রেজিস্টার খাতায় তুলেছেন।তারা এখনও পর্যন্ত কোনও ফিজ নেননি।

সল্টলেক শিক্ষায়তন তাদের স্কুলের মান্থলি ফিজ 1200টাকা কমিয়েছে।

Published on: মে ২৯, ২০২০ @ ২১:৩৬


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

− 2 = 7