অভিভাবকদের চাপে ফেলে এই দুঃসময়েও ‘ব্যবসা’ চালিয়ে যাচ্ছে বেশ কিছু ইংরাজি মাধ্যম স্কুল

Main উত্তর সম্পাদকীয় কোভিড-১৯ রাজ্য
শেয়ার করুন

Published on: জুন ১, ২০২০ @ ২১:৫০
প্রতিবেদন- অনিরুদ্ধ পাল

এর আগে কখনো এমনটা হয়নি। এত দীর্ঘদিন ধরে স্কুলের পঠন-পাঠন বন্ধ কেউ ভাবতেই পারত না। কিন্তু কোভিড-১৯ লকডাউনে শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়ে এসেছে সেই দুর্দিন। পড়াশুনো বন্ধ। স্কুল বন্ধ। ছাত্র-ছাত্রীদের কোচিং ক্লাসে যাওয়া বন্ধ। এ এক সত্যিই ভয়াবহ দুঃসময়। অথচ ইংরাজি মাধ্যম স্কুলগুলির অধিকাংশেরই কিন্তু এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তাভাবনা নেই। অভিভাবকদের উপর চাপ সৃষ্টি করে তারা কিন্তু মোটা টাকার ‘ব্যবসা’ চালিয়ে যাচ্ছে। বলছে এই টাকা না হলে তাদের শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মীদের বেতন দেবে কিভাবে? স্কুলগুলির কি সত্যিই এতটা দুরাবস্থা হয়ে গেল যে তাদের কর্মীদের বেতন দেওয়ারও টাকা তাদের হাতে নেই। এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি।

কর্তৃপক্ষের কথায় আর কাজের মধ্যে আছে বিস্তর ফারাক

আমি ব্যক্তিগতভাবে বেশ কয়েকটি ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। কথা বলেছি স্কুলগুলির অভিভাবকদের সঙ্গেও। দুই পক্ষের সঙ্গে কথা বলে যা জানতে পেরেছি, তা সত্যিই খুবই উদ্বেগজনক। কর্তৃপক্ষের কথায় আর কাজের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক রয়েছে তা কিন্তু তাদের কথার মধ্যেই ধরা পড়েছে।

১) কোভিড-১৯ লকডাউনের সরকারি নির্দেশিকায় পরিষ্কার করেই বলা ছিল যে স্কুল কিংবা সমস্ত রকমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হবে। ইংরাজি মাধ্যম স্কুলগুলির অধিকাংশই কিন্তু সেই নির্দেশিকা একদম মানেনি।

২) কোনও স্কুল তো খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে অভিভাবকদের লকডাউনের ভিতর স্কুলে এসে সমস্ত রকমের – ভর্তি থেকে শুরু করে, জামা-জুতো, বই-খাতা, ফিজের টাকা জমা দিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।

৩)স্টাফেদের বেতনের টাকা কোথা থেকে আসবে তাই অভিভাবকদের কাছ থেকে তড়িঘড়ি টাকা আদায়ের প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়েছে।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে

  • এখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে- এই স্কুলগুলির এত দুঃসাহস হল কিভাবে যে সরকারি নিয়মকে তোয়াক্কা না করে এভাবে তড়িঘড়ি তাদের টাকা আদায় করতে হল?
  • সদ্য অনুমোদন পাওয়া কিংবা অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা বেশ কিছু স্কুল যেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তির টাকার পরিমান শিথিল করে স্কুল কর্মীদের বেতন দিচ্ছে সেখানে 20-25 বছরের পুরনো স্কুলগুলিকে কেন এভাবে অভিভাবকদের উপর চাপ দিয়ে টাকা আদায় করতে হচ্ছে?
  • লকডাউনে গত দু’মাস যেখানে স্কুল বন্ধ আছে সেখানে স্কুলগুলিতে খরচার পরিমান অন্যান্য সময়ের চাইতে একেবারেই নেই বললেই চলে তা সত্বেও তারা তাহলে কোন যুক্তিতে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ চার্জ, কার্নিভাল চার্জ, সরস্বতী পুজোর খরচ, স্পোর্টস চার্জ থেকে আনুষঙ্গিক অন্যান্য টাকা আদায় করছে?
  • কোন যুক্তিতে তারা স্কুল থেকে ড্রেস, জুতো কিংবা বই-খাতা কেনা বাধ্যতামূলক করছে?
  • সরকারের ‘রাইট টু ফ্রি এডুকেশন’ এই স্কুলগুলি কেন মেনে চলছে না?
  • কেন তারা এক একজন ছাত্র-ছাত্রীকে ভর্তি না হলে বই বিক্রি করবে না বলে হুলিয়া জারি করছে, এটা কি তারা আদৌ করতে পারে?
  • অভিভাবকদের মতামত না নিয়ে স্কুলগুলি কিভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের মোটা টাকার মেডিকেল ইন্স্যুরেন্স করতে পারে?

অন্তর্তদন্তে উঠে এসেছে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য

এসব একাধিক প্রশ্ন উঠছে। তবে এসব প্রশ্ন উঠলেও এর উত্তর এই অভিযুক্ত স্কুলগুলি কোনওদিনই দেবে না। যদিও আমাদের অন্তর্তদন্তে উঠে এসেছে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। যা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক।

এক আইসিএসই স্কুলের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার সময় আমি জানতে চেয়েছিলাম-আপনারা এই ভয়াবহ সময় যখন লকডাউন চলছে যখন সমস্ত অফিস বন্ধ আছে। ব্যবসা বন্ধ আছে। লোকজনের আয় বন্ধ আছে তখন আপনারা কিভাবে মান্থলি ফিজের টাকা জমা দেওয়ার কথা বলেন? কেনই বা আপনারা তার সঙ্গে ডেভেলপমেন্ট ফিজ দিতে বলেন?

জবাবে সেই স্কুলের কর্তা বলেছিলেন- তাদের নাকি স্টাফেদের বেতন দিতে হবে। যে সমস্ত চতুর্থ শ্রেণির কর্মী কাজ করে তাদের তো পরিবার-পরিজন আছে । তাই তাদের কথা চিন্তা করেই আমাদের এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। একই কথা আরও একাধিক স্কুলের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও শোনা গিয়েছে।

‘স্যালারি রিজার্ভ ফান্ড’ – আড়াল করে রাখার অভিযোগ

অথচ কী আশ্চর্য- আইসিএসই স্কুলেরই আর এক প্রিন্সিপলের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে অ্যাফিলিয়েটেড অর্থাৎ আইসিএসই অনুমোদিত স্কুলগুলির প্রত্যেকেরই তিন মাসের ‘স্যালারি রিজার্ভ ফান্ড’ থাকে।সেখান থেকেই শিক্ষক থেকে অশিক্ষক-কর্মীদের বেতন দেওয়া যেতে পারে। এ কথা যখন সেই অভিযুক্ত স্কুলগুলির কর্তৃপক্ষকে জানালাম তারা মনে হল আকাশ থেকে পড়লেন।তাদের যুক্তি- না, না এসব হয় না। সত্যিই কি হয় না! আসলে ওই ফান্ডে তারা হাত দিতে চায় না। আড়াল করে রাখতে চায়।এমনই অভিযোগ উঠছে।আসুন তাহলে একটা সহজ হিসাব করে ফেলা যাক।

এক বছরেই স্কুলের ভর্তি থেকে আসে কোটি টাকার উপর

ধরা যাক একটি ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে প্লে গ্রুপ থেকে শুরু করে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মোট 14টি ক্লাস আছে। একটি ক্লাসে তিনটি করে সেকশন আছে। প্রতি ক্লাসে ভর্তির ফিজ গড়ে ধরা গেল 10 হাজার টাকা। তাহলে প্রতি সেকশনে যদি গড়ে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা 40 জন করে হয় তাহলে একটি ক্লাসে মোট ছাত্র সংখ্যা দাঁড়ায় 120 জন। ছাত্র পিছু ভর্তির ফিজ যদি 10 হাজার টাকা হয় তবে 120 জন ছাত্রের ভর্তির ফিজ দাঁড়ায় 12,00,000টাকা। অর্থাৎ একটি ক্লাস থেকে ভর্তি বাবদ স্কুলের খাতে ঢুকছে 12 লক্ষ টাকা। তাহলে 14টি ক্লাসে মোট ছাত্র সংখ্যা 120 জনের হিসাবে দাঁড়াচ্ছে 1,680জন। এক বছরে মোট ভর্তির টাকা দাঁড়াচ্ছে 1 কোটি 68 লক্ষ টাকা। এবার এক একটা স্কুলের বয়স যদি পাঁচ কিংবা তার বেশি বছর হয় তাহলে টাকার পরিমান কোথায় দাঁড়াচ্ছে ভাবুন। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে প্রতি মাসের মান্থলি ফিজের পরিমানের টাকা। এর পরেও স্কুলগুলি যদি বলে তাদের হাতে টাকা নেই সেটা কি বিশ্বাসযোগ্য?

স্কুলগুলির লক্ষ্য নানা অছিলায় অভিভাবকদের থেকে মোটা টাকা আদায়

আসলে এই স্কুলগুলির লক্ষ্য- যেনেতেন প্রকারে অভিভাবকদের কাছ থেকে টাকা আদায়। অনেকটা বাজারে মালপত্র কেনার মতো। সেখানে অবশ্য মালপত্র কেনার পর দোকানদার টাকা চায়। এখানে অবশ্য মালপত্র কেনার আগেই আপনাকে টাকা পরিশোধ করে দিতে হচ্ছে। সেখানে অবশ্য সব মালপত্র অবশ্য আপনি পাবেন কিনা তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। এই যেমন দু’মাস ক্লাস না হলেও তারা কিন্তু অভিভাবকদের কাছ থেকে দু’মাসের টিউশন ফিজ থেকে ডেভেলপমেন্ট ফিজ সবই আদায় করে নিয়েছে।আদায় করে নিয়েছে ভর্তির টাকাও। সঙ্গে আনুষঙ্গিক সমস্ত ফিজের টাকাও।না দিয়ে যাবেন কোথায়!

স্কুলগুলি আবার নতুন ব্যবসাও শুরু করেছে

এখন তো স্কুলগুলি আবার নতুন ‘ব্যবসা’ও শুরু করে দিয়েছে। প্রায় অধিকাংশ ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে বই-খাতা বিক্রি করাও শুরু হয়েছে। কোনও কোম্পানির সাথে চুক্তি মারফত। অধিকাংশ অভিভাবককে এক প্রকার বোকা বানিয়ে তাদের হয়রানির সুযোগ নিয়ে তাদের বোঝানো হচ্ছে – আপনারা একবারে টাকা দিয়ে সঙ্গে 10 শতাংশ ছাড় দিয়ে স্কুল থেকেই সম্পূর্ণ বই-খাতা পেয়ে যাবেন।আর অভিভাবকরাও স্কুলের এই প্রস্তাব মেনে নিচ্ছেন। কিন্তু তারা জানেন না, স্কুল তাদের থেকে টাকা নিয়ে নিজের কোষাগার মজবুত করছে। যে টাকায় আপনারা বই কিনছেন সেই টাকার উপর স্কুল ওই কোম্পানি থেকেই কিন্তু মোটা টাকার কমিশন খাচ্ছে। যার পরিমান স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা অনুযায়ী প্রায় লক্ষাধিক কিংবা তারও বেশি টাকা। এভাবে বেশ কিছু স্কুল ড্রেস থেকে জুতো বিক্রি করে সবেতেই ফুলেফেঁপে উঠছে।আর বলে বেড়াচ্ছে এটা তো আমাদের ব্যবসা নয়। আসলে এটাই তাদের বিনা পুঁজির ‘ব্যবসা’। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়- এতসব করেও এদের ‘ব্যবসা’ কিন্তু কেউ বন্ধ করতে পারছে না।

আর তাই এই দুঃসময়েও এই সমস্ত স্কুলগুলি তাদের ব্যবসা বহাল তবিয়তেই চালিয়ে যাচ্ছে।আর অসহায় অভুভাবকদের স্কুলের সামনে বিক্ষোভ দেখিয়েও শেষে স্কুলের ‘ব্যবসা’র টাকা আদাজল খেয়ে মেটাতে হচ্ছে।    লেখকঃ সংবাদ প্রভাকর টাইমস-এর প্রধান সম্পাদক

Published on: জুন ১, ২০২০ @ ২১:৫০


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

43 − 40 =