ভূ-পর্যটক মহাযোগী বাবা লোকনাথ

Main এসপিটি এক্সক্লুসিভ দেশ ধর্ম বাংলাদেশ রাজ্য
শেয়ার করুন

আজ ঈশ্বরকোটি ব্রহ্মবিদ মহাযোগী বাবা শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর ১৩০তম তিরোধান দিবস। এই উপ-মহাদেশে তাঁর মতো মহাপুরুষের আবির্ভাব আমাদের কাছে আশীর্বাদ। সংবাদ প্রভাকর টাইমস এই মহাপুরুষকে জানায় শতকোটি প্রণাম। এমন একজন মহাজ্ঞানী মহাপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের পাঠকদের প্রতি এই ছোট্ট নিবেদন।

 Published on: জুন ২, ২০২০ @ ১৮:১৮ 

লেখকঃ অনিরুদ্ধ পাল

ভারতীয় উপমহাদেশে বহু মুনি-ঋষি জন্মেছেন কিংবা আবির্ভূত হয়েছেন। এক একজন এক এক রকমভাবে মানুষকে আলোর দিশা দেখিয়ে গেছেন।তৈলঙ্গস্বামী, সাধক রামপ্রসাদ, বাবা লোকনাথ, শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, সাধক বামাক্ষ্যাপা, শিরডির সাইবাবা। সকলেই তাঁরা আপন সাধনমার্গের পথে হেঁটে মানুষকে সত্যের আলো দেখিয়েছেন। এ কথা বলতে বাধা নেই – সেই আলো আমরা সত্যি কতটা নিতে পেরেছি। তা যদি পুরোপুরি নিতে পারতাম তাহলে হয়তো আজ সর্বত্র মানুষে-মানুষে এত হানাহানি, উঁচু-নীচুর মধ্যে ভেদাভেদ, অহংভাব, অপরাধবোধ বাড়ত না।

একটা সময় ছিল যখন এই দেশে একের পর এক মহাপুরুষ জন্ম নিয়েছেন। সেই ১৬০৭ খ্রিঃ – ১৭২৩ খ্রিঃ পর্যন্ত ভারতের আধ্যাত্মিক মহাকাশে একের পর এক মহানক্ষত্রের উদয় হয়েছিল। যাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিদিন বেঁচে ছিলেন তৈলঙ্গস্বামী(২৮০ বছর), এরপর শ্রীশ্রী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী (১৬০ বছর)। তারপর যাদের নাম করতে হয় সেই সাধক রামপ্রসাদ, সাধক বামাক্ষ্যাপা ও ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব স্বল্প সময় পৃথিবীতে ছিলেন। এঁদের সকলের মধ্যে একমাত্র বাবা লোকনাথই সারা বিশ্ব ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি জানতে চেয়েছিলেন ঈশ্বরকে। তিনি বুঝতে চেয়েছিলেন মানুষকে। তিনি চিনতে চেয়েছিলেন প্রকৃত ধর্মকে। এই ভ্রমণকালে তিনি অনেক কিছুই অনুধাবন করেছিলেন। যা তিনি পরবর্তী সময়ে নিজের ভক্তদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তাই তাঁকে আমরা একজন সফল ভূ-পর্যটক হিসাবেও জানার চেষ্টা করতে পারি।

বাবা বলেছিলেন- “ওরে, আমি সারাজীবন ধরে যে ধন কামাই করেছি, তা তোরা বসে বসে খাবি।”

এখানে বাবা ধন বলতে কিন্তু টাকা-পয়সার কথা বলেননি। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, তাঁর এই ধন হল– বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, ভক্তি, আন্তরিকতা, শক্তি ও ভরসা। যা মানুষের জীবনে প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজন। এগুলি ছাড়া মানুষের জীবন যে একেবারে অচল।

এই পৃথিবীতে এমন বহু মানুষ আছে যারা না জেনে না বুঝে শুধু ঈশ্বর ঈশ্বর করে বেড়ায়। এই মানুষগুলি মন্দিরে গিয়ে পুজো দেয়। আবার তারাই দীন-দরিদ্রকে দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয়। প্রয়োজনে তাদের কটু কথা বলতে ছাড়ে না। যদিও বা সামান্য কিছু সাহায্য করে কিংবা দান করে সেটাও বড় করে প্রচার করে দেখায় তারা কত মহান কাজ করেছে। পয়সার দম্ভে তাদের ভাবগতিক একটা ভরং ছাড়া আর কী-ই বা বলা যেতে পারে বলুন তো।

এসব বাবা একদমই পছন্দ করতেন না। তিনি বাস্তব জগৎ-এ বিশ্বাস করতেন। তিনি নিজে কখনোই প্রচার চাইতেন না। সর্বভূতে নিজেতে দর্শন করে উত্তরকালে ভক্তজনকে তাই কৃপাময় পরম দয়ালু বাবা বলেছেন- “ওরে, বহু নছর পাহাড়-পর্বত আমি ঘুরেছি। কিন্তু তোদের ঈশ্বরের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। আমি দেখেছি আমাকে। আমি সংসারে বদ্ধ জিহ্বা আর উপস্থে।”

যিনি এ দুটি সম্বরন করতে পারেন, সিদ্ধি তার করতলগত। যথার্থই বলেছেন বাবা। সর্বভূত যে শ্রীবাবারই মাঝে পরিব্যপ্ত, মহত্মা পরম পূজ্য শ্রীবিজয়কৃষ্ণের উক্তি তার উজ্জ্বল প্রমাণ। তিনি বলেছিলেন- ” ব্রহ্মচারী বাবার প্রতিটি লোমকূপে দেবতা। আমি তাঁকে দেখেছি ত্রিবিধ মূর্তিতে। সাধারণ ব্রাহ্মণদের মত তাঁকে ত্রিসন্ধ্যায় মন্ত্রপাঠ করতে হয় না। তাঁর গাত্রবস্ত্রে- কুটিরের সর্বত্র আমি দেবদেবী দর্শন করেছি। তাঁর মত মহাউন্নত বড় একটা নিম্নভূমিতে অবতরণ করেন না।”

আর এই করুণাময় বাবাই সিদ্ধিলাভের জন্য জিহ্বা ও উপস্থ সম্বরণের আদেশ প্রদান করলেন। এই দুই মহাশক্তির ইন্দ্রিয় সংযত করা ছাড়া সাধন ক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া যে অসম্ভব। তা বাবা বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। এই দুই ঘর ত্যাগ করতে পারলেই হবে। তাই তো বিজয়কৃষ্ণ বাবার কথা মেনে বলে গেছেন- “যিনি জিহ্বা ও উপস্থ জয় করেছেন আর অন্তর্মুখে সদা ভগবানের নাম জপ করেন, তাঁকে কোন কিছু বাধা দিতে পারে না।”

পরম করুণাময় বাবা তখন হিমালয়ের কোলে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে দিয়েছেন। তেমনই একদিন আচার্য্যদেব তাঁকে বলেন- “শোন, এরপর আমি তোমাদের পরিব্রাজকব্রতে চালিত করতে চাই। আমার ইচ্ছা, নানান স্থান ভ্রমণ করে এখন তোমরা বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন মানুষের সম্বন্ধে পরিচিত হও। জ্ঞাত হও তাদের চাল-চলন, আহার-বিহার এবং আচার-আচরণ সম্বন্ধে। আর লোকনাথ তোমার কিন্তু এই ভ্রমণের বিশেষ প্রয়োজন।কারণ আমি মানসচক্ষে দেখছি যে অতি স্বল্প সময়ের মধ্যেই এমন এক স্থানে তোমাকে লোকশিক্ষার জন্য অবস্থান করতে হবে, যে স্থানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী অজস্র মানুষের মিলনে মহাধন্য। আর, তাই বর্তমানে তোমার নানান লোকাচার ও ধর্ম সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন।”

বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলা তাঁর গুরুর এই কথাগুলি যদি আমরা গভীর ভাবে অনুধাবন করার চেষ্টা করি তাহলে বুঝতে পারব, এর গভীরতা কতটা। আসলে যে কোনও মানুষকেই সমস্ত কিছু সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া প্রয়োজন। সমস্ত ধরনের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা দরকার। তাদের সম্পর্কে জানা দরকার। তাদেরকে ভালভাবে চেনা দরকার। তা না হলে অনেক কিছুই যে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

এই বিশ্ব ভ্রমণে বেড়িয়েই বাবা পেয়েছিলেন এমন দু’জন মহান মানুষের সাক্ষাৎ। যা বাবাকে অনেক কিছু শিখিয়েছিল। ঘুরতে ঘুরতে বেণীমাধবকে সঙ্গে নিয়ে এমন এক জায়াগায় পৌঁছে গেছিলেন যেখানে পরম করুণাময় বাবা সেখানকার মানুষদের অকুণ্ঠ স্নেহ পেয়েছিলেন। সেখানে বসবাসকারী মুসলমানরা শ্রীশ্রী বাবার অপরূপ দেহলাবণ্য দর্শন করে অভূতপূর্ব এক ভক্তিরসে আপ্লুত হয়ে ওঠেন। বাবাও তাদের আচরণে মুগ্ধ হয়ে তাদের তৈরি করা খাবার সাগ্রহে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁকে দেখে আমাদের এখনও অনেক কিছু শেখা বাকি আছে। যারা ধর্মের নামে আজও অধর্ম করে চলেছে, যারা জাতের নামে বজ্জাতি করে চলেছে তাদের আরও বেশি করে বাবার জীবন দর্শন উপলব্ধি করা প্রয়োজন। তিনি ছিলেন সর্ব সর্বধর্মের উর্ধ্বে। তিনি বিশ্বাস করতেন- মানুষই সত্য। মানুষকে ভালবাসতে পারলেই ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা সম্ভব। সেখানে বাবাকে ঘিরে এক মহাপ্লাবন তৈরি হয়। হবে নাই বা কেন? তিনি যে সর্ভূতেই বিরাজ করেন।

তাঁদের মধ্যে বসেই হিন্দু-মুসলমান এই দুই ধর্মাবলম্বী মানুষের বাহ্যিক এবং নিতান্তই অর্থহীন যাবতীয় দ্বিধাদ্বন্দ্ব বিনাশের জন্য সকলের সামনে উদাত্ত কণ্ঠে বলে ওঠেন-

“যিনি আল্লা, তিনিই ঈশ্বর। দেহস্থ চঞ্চল প্রাণকে স্থিরাবস্থায় উন্নীত করার নামই হল আল্লা- আর সেই একই নাম আবার ঈশ্বর অর্থাৎ শ্রী ভগবান। আমি এক এবং অদ্বিতীয়- সর্বভূতে বিরাজিত। এবং সর্বভূত আমাতেই স্থিত। কি হিন্দু, কি মুসলমান, কি বুদ্ধ, কি খ্রিস্টান- সকল মত ও ধর্মাবলম্বী মানুষ একমাত্র আমারই শরণাগত। আমিই সর্বভূতে বিরাজিত আত্মা।”

সেদিন তাঁর এই কথার তাৎপর্য যে কতখানি ছিল তা কালে কালে মানুষ উপলব্ধি করতে পারবে। তিনি সত্যিই ছিলেন এক সফল ভূ-পর্যটক। তিনি আরব দেশ পার করে মক্কা, মদিনা দর্শনের পর মক্কেশ্বরের পথে রওনা দিলেন। যেখানে তিনি দর্শন পেয়েছিলেন আব্দুল গফুর নামে এক মহা উন্নত মহাপুরুষের। যাঁকে দর্শন করে আমাদের ত্রিকালদর্শী মহাযোগী বাবা অনন্ত ভাবাবেশে ডুবে গেছিলেন।

বাবাকে দেখেই সেই প্রাচীন সাধক স্মিত হেসে জিজ্ঞাসা করলেন- কতদিনের লোক তুমি?
দুই দিনের – জবাব দিলেন বাবা। অর্থাৎ কি না দুই জন্মের কথা তাঁর স্মরণে আছে।
কিন্তু, আপনি কতদিনের যদি কৃপা করে বলেন, জানতে চাইলেন বাবা।
আমি চারদিনের। গম্ভীর কণ্ঠে কথাগুলি বলে ফের সমাধিস্থ হলেন সেই প্রাচীন সাধক।

সেই প্রাচীন সাধক বাবার মনে এমনভাবে স্থান করে নিয়েছিলেন যে বাকি জীবনে বাবা তাঁর কথা কোনওদিন ভুলতে পারেননি। এই প্রসঙ্গ উঠলেই বাবা বলতেন- “এত পাহাড়, এত পর্বত ঘুরলাম। কিন্তু মাত্র দু’জন ব্রাহ্মণ দর্শন করলাম। একজন হলেন তৈলঙ্গস্বামী আর অন্যজন আব্দুল গফুর।”

এরপর বাবা মক্কেশ্বর হয়ে পশ্চিমের পথ ধরে ইউরোপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। একে একে তিনি তুরস্ক, গ্রিস, ফ্রান্স যাত্রা করে সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অবহিত হলেন। ঘুরতে ঘুরতে শেষে তাঁরা এলেন হিমালয়ের বদরিকাশ্রমে। যেখানে ঠান্ডার তীব্রতা ছিল মারাত্মক। বাবা সেই ঠান্ডাকেও জয় করেছিলেন।

এখানে ভ্রমণের বিষয় উঠতেই বাবা ভক্তদের বলতেন – “ভীষণ শীতের কামড় ওখানে। তাই গ্রীষ্মকালেই লোক বাস করে কেবল। শীতের ছ’মাস নিম্নভূমিতে চলে যেতো যে যার মতো। তখন কেবল তুষারপাত। অজস্র তুষারে সবদিক ঢাকা। ওই ছ’মাস বন্ধ থাকে বদ্রিনারায়ণের মন্দির। আর শুধু এখানেই বা কেন, কেদার আর গঙ্গোত্রীতেও তো থাকত এমনই অবস্থা।”

আসলে বাবা যোগক্রিয়ার মাধ্যমে এমন অকল্পনীয় ঠান্ডাকে জয় করতে পেরেছিলেন। আর তার ফলেই খুব কাছ থেকে সেখানকার জীবনধারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এ বিষয়ে সকলের স্মরণে রাখা উচিত- যেখানে ঠান্ডার সময় মানুষ নীচে নেমে আসত, তখন বাবা কিন্তু ওই বরফে ঢাকা প্রদেশে নির্বিঘ্নে কাটিয়েছেন গোটা একটা বছর। তাহলে তাঁর মতো সফল ভূ-পর্যটক ক’জন আছেন বলতে পারেন?

 Published on: জুন ২, ২০২০ @ ১৮:১৮


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

11 + = 21