
শ্রীশ্রীমায়ের ১৬৬তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে সংবাদ প্রভাকর টাইমস-এর শ্রদ্ধার্ঘ্য
লেখকঃ অরুণাভ গুপ্ত
Published on: ডিসে ২৭, ২০১৮ @ ২৩:১৫
এসপিটি, ২৭ ডিসেম্বরঃ
- ‘আমি সত্যিকারের মা; গুরুপত্নী নয়, পাতানো মা নয়, কথার কথা মা নয়- সত্য জননী।’
- ‘আমার ছেলে যদি ধুলোকাদা মাখে আমাকেই তো ধুলো ঝেড়ে কোলে নিতে হবে।’
- ‘ভয় কি, বাবা, সর্বদাই জানবে যে ঠাকুর তোমাদের পেছনে রয়েছেন।আমি রয়েছি, আমি মা থাকতে ভয় কি?’
-এইসব মা সারদার অমৃতবানী।নির্ভেজাল সত্য তিনি আমাদের সকলের জন্ম-জন্মান্তরের ‘মা’। ঘটনা হল মা সারদা এক বিশাল অনন্ত শক্তির রূপ। যতকিছু চর্চা তাঁকে নিয়ে হোক মনে হবে যথেষ্ট হল না। যিনি অপরিমেয় তাঁর পরিমাপ অসম্ভব। অমন দুঃসাহস আমার নেই। স্বয়ং স্বামীজী পারলেন না মায়ের অতলান্তিক গভীরতার সন্ধান সেখানে সাধারণ মানুষ…থাক সে কথা। বরং এদিক সেদিক ছড়ান-ছিটান ঘটনাগুলি একটা সুতোয় গেঁথে মা সারদার মাধ্যমে মা সারদাকে উপলব্ধি করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে স্বামী বিবেকানন্দ কি জ্ঞানে ‘মা’-কে প্রতি মুহূর্তে গ্রহণ করেছেন তাই হোক শুরুর শুরু। স্বামীজী শিবানন্দজীকে লিখলেন, ‘ মায়ের কৃপা আমার উপর বাপের কৃপার চেয়ে লক্ষগুণ বড়ো।’ এমন বিশ্বাসের উৎস কোথায়-নিজের অন্তরে। যখন চিঠির বয়ানে ছিল, ‘তারকভায়া, আমেরিকা আসবার আগে মা-কে আশীর্বাদ করতে বলেছিলাম, তিনি যেমন আশীর্বাদ দিলেন অমনি হুপ করে পগারপার। এই বুঝ দাদা, মায়ের কথা মনে পড়লে সব সময় বলি,”কো রাম? ওই যে বলেছি, ওইখানটায় আমার গোঁড়ামি। রামকৃষ্ণ পরমহংস ঈশ্বর ছিলেন কি মানুষ ছিলেন, যা হয় বল, দাদা, কিন্তু মায়ের ওপর যার ভক্তি নেই তাকে ধিক্কার দিও।’ স্বয়ং শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ বলেছেন, ‘ও কি যে সে?ও আমার শক্তি।’ একবার ভাগনে হৃদয়রামকে সতর্ক করে বলেছেন,’ওকে’ এমন করে বলিসনি। ‘এর’ ভেতরে যে আছে সে ফোঁস করলে হয়তো রক্ষা পেতে পারিস, কিন্তু ‘ওর’ ভেতরে যে আছে সে ফোঁস করলে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরও তোকে বাঁচাতে পারবে না।” কোন এক সময় স্বামী সারদানন্দজী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরাসরি বলেছেন,’ কি ভেবেছ তোমরা? আমাদের ঠাকুর কি একজন ঘুঁটেকুড়োনীকে বিয়ে করেছেন?’ স্বামীজী তুরীয়ানন্দের সহযোগী হয়ে বাগবাজারে মায়ের সাক্ষাৎ লাভে চলেছেন। কিন্তু নৌকায় যাত্রাকালে স্বামীজী থেকে-থেকে গঙ্গাঁর ঘোলা জল দু-হাত ভরে খেয়ে যাচ্ছেন, যা দেখে গুরুভাই তুরীয়ানন্দ আঁতকে উঠে বলেছেন, ‘ মহা মুশকিল ঘোলা জল অনবরত খাচ্ছ, শেষকালে সর্দি বাধবে যে?’ স্বামী বিবেকানন্দের আবেগঘন উত্তর ছিল, ‘ না, ভাই ভয় করে, আমাদের তো মন মা-র কাছে যাচ্ছি…ভয় করে।’ অর্থাৎ মা সারদার অপরিসীম পবিত্রতার সামনে নিজেকে কলুষ মুক্ত রাখার প্রাণপণ প্রয়াস। শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীশ্রী মা সারদাদেবীকে সাক্ষাত দেবী রূপে ও জ্ঞানে পুজো করেছেন। ‘হে কালে, হে সর্বশক্তির অধীশ্বরী মাতঃ, ত্রিপুর সুন্দরী, সিদ্ধি দ্বার উন্মুক্ত করো, এর শরীর মনকে পবিত্র করে এতে আবির্ভূত হয়ে সর্বকল্যান সাধন করো।’ ‘হে শরণদায়িনী, হে নারায়নী, তোমাকে প্রণাম করি।’
মা সারদা হলেন ব্রহ্মবিদ্যা-র আঁধারস্বরূপ। তাঁর মাধ্যমে রামকৃষ্ণ তত্ত্ব অবগত হওয়া যায়। দক্ষিণেশ্বরে মা ঠাকুরের পদসেবা করার সময় বিনীত প্রশ্ন পেশ করেছেন, ‘আমাকে কি বলে মনে মনে হয়।’ শ্রীশ্রী ঠাকুরের তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘যে মা মন্দিরে আছেন এভং ভবতারিনী নামে আমার পূজা গ্রহণ করছেন- তিনিই এখন শ্রীমা সারদা হয়ে আমার পদসেবা করছেন।’ শ্রীমা সারদা ঈশ্বরী। গা্যত্রী জননী। তিনি ছিলেন অগ্নি ন্যায় তেজদৃপ্ত। তৎকালীন সময় দেশব্যাপী ইংরেজ হটাও আন্দোলন। মা কিন্তু আমার মাতৃভূমি এমন ভাবাবেগে আপ্লুত হননি বা প্রশ্রয় দেননি। অথচ নিজস্ব যুক্তি ও চিন্তায় স্বদেশ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং নিজেও প্রত্যয়ী থেকেছেন। যেমন উদাহরণস্বরূপ উল্ল্যেখ করা যায় ইংরেজ সরকার প্রতিমুহূর্তে মায়ের বাড়ির প্রতি কড়া নজর রেখেছিল, যদিও সাহসে কুলোয়নি মা-কে ঘাটানোর। ‘শ্রীশ্রীমা’-র কাছে কোন কিছু অজ্ঞাত ছিল না, তবে অসামান্য ব্যক্তিত্বের অধিকারিনী ‘মা’ দৃঢ় অথচ শান্তি আচার আচরণে রাজশক্তিকে উপেক্ষা করে গেছেন, তাঁর স্নেহের ছত্র ছায়ায় বহু বিপ্লবী আশ্রয় নিয়েছেন। নীরবে-নিভৃতে কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করেছেন। স্বামীজী শিবানন্দজীকে চিঠিতে লিখলেন, ‘যার মা-র ওপর ভক্তি নেই তার ঘোড়ার ডিম হবে। সোজা বাংলা কথা। ঠাকুর বরং যাক। ঠাকুরের থেকে মা বড়ো দয়াল। মা-কে তোমরা বোঝনি। মায়ের কৃপা লক্ষগুণ বড়ো।’
স্বামী বীরেশ্বরানন্দ ‘শ্রীশ্রীমা’ সম্পর্কে লিখছেন-একবার দুজন যুবক এল। দুজনেই রাজদ্রোহী। মা তাদের স্নান করতে পাঠালেন, তারা স্নান করে এলে তাদের দীক্ষা দিলেন। তারপর তাদের খাইয়ে দাইয়ে তাড়াতাড়ি অন্যত্র যেতে বললেন। এসব ছেলেদেরও দীক্ষা দিতে মা এতটুকু ভয় পেতেন না। মা তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দীক্ষা দিয়ে গেছেন। মা যখন উদ্বোধনে অত্যন্ত অসুস্থ তখন একদিন এক পারসী যুবক এসে উপস্থিত। তিনি মঠে অতিথি হয়ে কয়েকদিন ধরে বাস করছিলেন। এখন মায়ের কাছে এসেছেন তাঁকে দর্শন করতে এবং তাঁর কাছে দীক্ষা দিতে নিতে। মায়ের তখন এত অসুখ যে দর্শন একেবারে বন্ধ। এই যুবক নিচে বসে রইলেন। তাঁকে দোতলায় যেতে দেওয়া হল না। মা কিন্তু কিভাবে জেনে গেলেন যে, এই যুবকটি নিচে তাঁর দর্শনের জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি তখন একজনকে বললেন তাকে তাঁর কাছে ডেকে নিয়ে আসতে। মা তাকে দীক্ষা দিয়ে নিচে পাঠালেন। স্বামী সারদানন্দ এই ঘটনার কথা জানতে পেরে মন্তব্য করলেনঃ ‘মায়ের যদি এক পারসী শিষ্য করার ইচ্ছে হয়ে থাকে তাহলে আমার আর কি বলার আছে?’ এই পারসী যুবকটি আর কেউ না, চিত্র জগতের বিখ্যাত অভিনেতা ও প্রযোজক বম্বের সোরাব মোদি।
গিরিশবাবু বলতেনঃ ‘ এই যে মহিলা, গ্রামের সাধারণ বউটির মত আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনিই যে জগতের রাজ-রাজেশ্বরী তা কে বলবে?’ স্বামী সারদানন্দ একবার বলেছিলেনঃ ‘শ্রীরামকৃষ্ণের ভিতরের ভাব বাইরে থেকে খানিকটা ধরা যেত, মায়ের কিন্তু কিছুই বোঝা যেত না। ভাব চেপে রাখার অসম্ভব ক্ষমতা ছিল তাঁর। বাইরে তাঁর ভাবের এতটুকু প্রকাশ নেই। মা যেন মোটা কাপড়ের এক ঘোমটা দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে রেখেছেন। তাই কেউ তাঁকে একটুও দেখতে পাচ্ছে না।’ শ্রীশ্রী মা সারদাই বেদের গায়ত্রী।, তন্ত্রের কালী, বর্তমানে সরস্বতী। সব মিলেমিশে তিনি সকলের ‘মা’।
Published on: ডিসে ২৭, ২০১৮ @ ২৩:১৫