
সংবাদদাতা-বাপ্পা মণ্ডল ছবি-রামপ্রসাদ সাউ
Published on: মে ৯, ২০১৮ @ ২২:৫১
এসপিটি নিউজ, শালবনী, ৯ মেঃ এক বছর আগেও তারা জানত না কি হবে তাদের ভবিষ্যৎ।তবে তারা দু’জনেই ঠিক করে নিয়েছিল এবার থেকে তারা আলোর জগতে থাকবে। সমাজের আর পাঁচটা মানুষের মতো করে বাঁচার লড়াই চালিয়ে যাবে।এদের একজন আঠাশ বছরের যুবতী সুলেখা মাহাতো যিনি মাওবাদী স্কোয়াড নেতা মদন মাহাতো স্কোয়াডের সদস্য ছিলেন। আর একজন ৩১ বছরের যুবক দিলীপ মাহাতো যিনি জনসাধারণের কমিটির নেতা শুকদেব মাহাতোর হাত ধরে মাওবাদী শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন।আজ তাদের চার হাত এক হয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন।
কিন্তু এই পরিণয় এক দিনে সম্ভব হয়নি। এর পিছনেও রয়েছে অনেক দিনের কাহিনি, যা বলিউডের সিনেমাকেও হার মানাবে। আমরা ক্রিকেটারদের প্রেম, শিল্পপতিদের ছেলে-মেয়েদের প্রেমকাহিনি নিয়ে কত লেখালিখি করে থাকি। মানুষও তা গোগ্রাসে গেলে। কিন্তু কোনও মাওবাদী ছেলে-মেয়ে তারা সমাজের মূলস্রোতে ফিরে নিজেদের প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একে অপরকে সারা জীবনের সঙ্গী বানিয়েছে তেমন কাহিনি শুনেছেন কি? আর সেটাই হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরে।আর এই বৃত্ত সম্পূর্ণ করেছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশ।
এ এক সত্যি কারের কাহিনি।
তখন রাজ্যে ক্ষমতায় বামফ্রন্ট সরকার। জঙ্গলমহলে সবে মাওবাদীদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। এলাকায় মানুষের হয়রানির শেষ নেই। গ্রামে নেই বিদ্যুৎ। নেই হাসপাতাল, নেই পর্যাপ্ত স্কুল-কলেজ। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিল না বললেই চলে। অর্থের অভাবে ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনো শিকেয় উঠতে শুরু করেছিল। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গ্রামের মানুষকে নিজেদের দিকে টেনে জঙ্গলমহলে পা রেখেছিল মাওবাদীরা। ধীরে ধীরে তারা হয়ে উঠেছিল জঙ্গলমহলের অঘোষিত শাসক। সেই সময় এই জঙ্গলমহলের বহু ছেলে-মেয়ে অভাবের তাড়নায়, মনের জ্বালায়, সরকারি বঞ্চনা আর অত্যাচার সইতে না পেরে মাওবাদী স্কোয়াডে নাম লেখাতে শুরু করেছিল।
ঝাড়গ্রাম জেলার বেলপাহাড়ি থানার আদলি গ্রামের তরুণী সুলেখার কাছেও একদিন এল মাওবাদী স্কোয়াডে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব। শাসকের অত্যাচার না কি মাওবাদী দলে নাম লেখানো এই দুইয়ের মধ্যে সুলেখা বেছে নিয়েছিল দ্বিতীয়টিকেই। কারণ, সেইসময় সে ভেবেছিল এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে সিপিএমের অত্যাচারের শিকার হতে হবে। সেইসময় জঙ্গলমহলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মদন মাহাতোর স্কোয়াড। পুলিশের নাগাল এড়িয়ে মদনের নেতৃত্বাধীন সেই মাওবাদী স্কোয়াড একের পর এক নাশকতামূলক কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে। সেই স্কোয়াডেই যোগ দিয়েছিলেন সুলেখা। কিছুদিনের মধ্যে মাও প্রশিক্ষণে সুলেখা হয়ে উঠেছিল এক মহিলা মাও যোদ্ধা।
একই ঘটনা ঘটেছিল দিলীপের জীবনেও। শালবনী থানার বীরভানপুর গ্রামের এই যুবক বরাবরই প্রতিবাদী ও দৃঢ়চেতা মনের মানুষ। শাসকের অত্যাচারে সেসময় তাদের রাতের ঘুম চলে গেছিল। এর বিরুদ্ধে লড়াই করার সুযোগ খুঁজছিলেন দিলীপ। আর সেইসময় এসে গেল সেই মোক্ষম সুযোগ। জসাধারণের কমিটির শুকদেব মাহাতোর হাত ধরে মাওবাদী শিবিরে যোগ দিলেন সেদিনের তরুন দিলীপ।
এরপর মাওবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন দু’জনেই। সেসময়ে দু’জনের মধ্যে সেভাবে যোগাযোগ গড়ে না উঠলেও একে অপরকে চিনতেন। সেই চেনাটা যে কখন ভলো লেগে যায় তা সুলেখা-দিলীপ কেউ বুঝতে পারেননি। ধীরে ধীরে অশান্ত জঙ্গলমহল শান্ত হয়ে ওঠে। শাসকের পরিবর্তন হয়। বাম জমানা কেটে আসে তৃণমূলের জমানা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে জঙ্গলমহলের মানুষের জন্য আসে একাধিক উন্নয়্নমুখী প্রকল্প।পূর্বের বঞ্চনা, অবহেলা, অত্যাচার দূর হয়। মানুষ বুঝতে পারে সমস্যা দূর হয়েছে। এখন সমাজের মূল স্রোতে ফিরতে হবে, শুরু হয় তোড়জোড়।
২০১৭ সালে আসে সেই শুভক্ষণ। একাধিক মাওবাদী সদস্যের মতো সুলেখা-দিলীপরাও আত্মসমর্পন করেন।রাজ্য সরকার ঠিক করে মাওবাদী প্রশিক্ষণে দক্ষ এইসব যুবক-যুবতীদের যদি পুলিশের চাকরিতে নিয়ে আসা যায় তাহলে একদিকে পুলিশ প্রশাসন যেমন উপকৃত হবে ঠিক তেমনই আত্মসমর্পনকারীরাও সমাজের মূল স্রোতে ফিরে নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে পারবেন।
তৃণমূল শাসিত রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্ত অনুসারে আত্মসমর্পনকারী মাওবাদীদের রাজ্য পুলিশের হোমগার্ডে চাকরি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে তাদের পুনর্বাসনের প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হয়। আর তখনই ঘটে সুলেখা-দিলীপের প্রেমের আসল পর্ব। হোমগার্ডের প্রশিক্ষণ চলার সময় দেখা হত সুলেখার সঙ্গে। চনমনে সুশ্রী সুলেখাকে পছন্দ হয়ে যায় দিলীপের। প্রথম দেখাতেই প্রেম। আর তারপর দু’জনের কাছাকাছি আসা। চোখে চোখ রাখা। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা এসব তো আছেই। হোমগার্ডের প্রশিক্ষণের মাঝেই চলত এই প্রেম। তাদের এই ভালোবাসার পর্বে সহকর্মীরা যথাসম্ভব সাহায্য করে গেছেন।
পরে বিষয়টি কানে যায় পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়ার। তিনিই দুই যুবক-যুবতীর চার হাত এক করার উদ্যোগ নেন।বুধবার সন্ধ্যায় শালবনীর কর্ণগড় মহামায়া মন্দিরে সুলেখা ও দিলীপের বিয়ের আয়োজন করা হয়। সেখানে দুই পরিবারের সকল সদস্য যেমন ছিলেন তেমনই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশের পদস্থ কর্তারাও হাজির ছিলেন। পুলিশ সুপারের পাশাপাশি ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শচীন মক্কর সহ অন্যান্যরাও।উপস্থিত সকলেই আশীর্বাদ করেন নব দম্পতিকে। তাহলে বলুন তো ক্রিকেটার কিংবা শিল্পপতিদের চেয়ে কোন অংশে কম এই প্রেমগাঁথা?
Published on: মে ৯, ২০১৮ @ ২২:৫১