বিজ্ঞান সচেতনতার লক্ষ্যে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় স্মারক বিজ্ঞান মেলা ও প্রদর্শনী শুরু আজ থেকে

Main দেশ রাজ্য
শেয়ার করুন

Published on: জানু ৫, ২০২৪ at ২৩:৪৯
Reporter; Aniruddha Pal

এসপিটি নিউজ, কলকাতা, ৫ জানুয়ারি: আজ যখন বিশ্বজুড়ে পরিবেশ বিপন্ন, সেই সময় অত্যন্ত সময়োপযোগী ‘পরিবেশ রক্ষা করো’- এই আহ্বান দিয়ে কলকাতার বুকে পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, বেল্গাছিয়া বিজ্ঞান কেন্দ্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিটি হলে আজ শুক্রবার ৫ জানুয়ারি ২০২৪ থেকে শুরু হয়েছে ‘আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় স্মারক বিজ্ঞানব মেলা ও প্রদর্শনী’। এই মেলা চলবে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত।

আজ ছিল মেলার প্রথম দিন। এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী চিকিৎসার ক্লিনিকের সামনে থেকে একটি সুন্দর পদযাত্রা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন ও বেলগাছিয়া রোডের কিছুটা পরিক্রমা করে কমিউনিটি হলের আগে বাংলার বিজ্ঞান চর্চার মন্ডপ পর্যন্ত প্রদক্ষিণ করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা উত্তোলন করেন মেলা কমিটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক উপাচার্য অধ্যাপক শ্যামসুন্দর দানা। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পতাকা উত্তোলন করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক প্রদীপ কুমার মহাপাত্র। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ নিবেদনের পর ‘বাংলার বিজ্ঞান চর্চা’র মন্ডপের ফিতে কেটে মেলার উদ্বোধন করেন জুওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’র অধিকর্তা ড. ধৃতি ব্যানার্জি।

এই পৃথিবীকে বসবাসের উপযুক্ত করে তুলতে হবে-ধৃতি ব্যানার্জি

উদ্বোধনী ভাষণে ধৃতি ব্যানার্জি পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলেন। তিনি বলেন- “ভারত সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে জুওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া কাজ করে চলেছে। পরিবেশের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষ ও প্রকৃতি। আমরা শক্তির পুজো করে এসছি। ঠাকুর পুজো করি। বাঘ, ময়ূর, হাঁস সব পুজো করি। আবার সেইগুলোকে আবার মেরে খেয়েও নি। আমরা সবাই কিন্তু জানি কি হচ্ছে। এই যে আজ জানুয়ারি মাসে এত গরম হচ্ছে যে মনে হচ্ছে ফ্যান চালালে ভাল হয়। আমাদের ক্ষমতাr মধ্যে কিন্তু সব কিছু করার আছে। চেষ্টা করা অবশ্যই আমাদের কর্তব্য। আমাদের কর্তব্য হওয়া উচিত এমন একটি গ্রহ তৈরি করা যার জন্য শুধু আমাদের নয় সমস্ত জীব-জন্তুর ভাল হয়। আজ যদি পৃথিবীটা আমাদের জন্য অনুপযুক্ত হয় , জন্তু-জানোয়ারের জন্য অনুপযুক্ত হয় কাল কিন্তু এই পৃথিবীটা আমাদের জন্যও অনুপযুক্ত হবে। আমাদের কাছে এত টাকা নেই যে আমরা মঙ্গল গ্রহে গিয়ে বাড়ি করে থাকব। সেটা এলন মাস্ক, বিল গেটসরাই পারবে। আমরা দেখেছি রবীন্দ্রনাথের লেখায় প্রকৃতি নানাভাবে ঘুরে এসেছে। উনি বহুক্কল আগে যখন তেলের দৃশ্য দেখেছিলেন এবং বলেছিলেন এমনটা যদি সমুদ্রের অবস্থা হয়ে তাহলে ভবিষ্যতে কি হবে।য়াজ কিন্তু সেটাই হচ্ছে।”

ব্রিটিশ স্ট্যাটিসটিশিয়ান কার্ল পিয়ার্সন-এর উদ্ধৃতি

ব্রিটিশ স্ট্যাটিসটিশিয়ান কার্ল পিয়ার্সন-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বক্তব্য শুরু করেন পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শ্যামসুন্দর দানা। সেই বিখ্যাত উক্তি-“দেয়ার ইজ শর্ট কাট টু ট্রুথ, নো ওয়ে টু গেইন এ নলেজ অফ দ্য ইউনিভার্স এক্সসেপ্ট থ্রু দ্য গেটওয়ে অফ সায়েন্টিফিক মেথড” অর্থাৎ সত্যের কোন সংক্ষিপ্ত পথ নেই, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রবেশদ্বার ব্যতীত মহাবিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের কোন উপায় নেই।এই যে বিখ্যাত স্টাটিশটিশিয়ান কার্ল পিয়ার্সন কবে বলে গেছেন সেই কথা আজও একশো ভাগ সত্য। ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বিশেষ আবেদন এই কথাটা মনে রেখো।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা থেকে শুরু করে পরিবেশ সব কথাই বলে গেছেন। আমাদের মধ্যে থেকে লোভ যায়নি।আমি মুক্তেশ্বর , আলমোড়া গেছি – দেখছি সেখানে এত হোটেল গড়ে উঠছে। সরকারও অনুমোদন দিয়ে দিচ্ছে হোটেলও যথচ্ছভাবে গড়ে উঠছে। লোভ সামলাতে হবে। এটা সামলাতে না পারলে যতই এসব সেমিনার, ওয়ার্কশপ করি না কেন কিছুই লাভ হবে না।”

বেঙ্গল কেমিক্যাল গড়ে তোলেন আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়-

বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সভাপতি ড. সুমিত্রা চৌধুরী এদিন আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের কথা তুলে ধরেন। বলেন- আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের কথা না বলে পারি না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার অনেক আগে থেকে ১৮৯২ সালে তিনি চাইলেন সাহেবদের দেশে যেমন শিল্প তৈরি হয় ঠিক তেমনি আমাদের কাঁচা মাল দিয়ে শিল্প তৈরি হবে।তিনি মাত্র ১৮ টাকা সম্বল করে গড়ে তুললেন বেঙ্গল কেমিক্যাল। ক্রমশ সেটা একটা বিশাল কারখানা হল। তিনি সেই যুগের প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক – বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাচের বোতল সংগ্রহ করেছেন। যাতে ওষুধ দেবেন। কাঁচা মাংসের হাড় তুলে নিয়ে গিয়ে নিজের বাড়ির ছাদের পোড়াতেন। পুড়িয়ে যে ছাই হত সেটা ক্লাসে নিয়ে এসে বলতেম- তোরা খা। এটা একটা বিশুদ্ধ কেমিক্যাল। ছেলেরা একটু নাক সিটকোতো। উনি এক চামচ খেয়ে বলতো – এই তোদের বিজ্ঞান। ক্যালসিয়াম ফসফেট তোরা খেতে পারলি না। এই যে একদিকে তিনি শুধু শিক্ষা দিচ্ছেন না তাদের কুসংস্কার মুক্ত করছেন। এইভাবে ওনার উপর নির্ভর করে দেশের বহু শিল্প তৈরি হয়েছিল ওরা সাহেবদের পাল্লা দিত। আমরা সেই সময় স্বাধীনতা পাইনি ঠিকই কিন্তু সাহেবদের থেকে কিভাবে কম খরচে ওষুধ বিক্রি করা যায় নতুন প্ল্যান তৈরি করলেন যেটা সেহেবদের টেক্কা দিল। এই মানুষগুলো দাপিয়ে বেড়িয়েছেন কালা আদমিদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। আমরা পরিবেশ আন্দোলন করি আর যেটাই করি তাদের কথা স্মরণে রাখব। আমাদের যে উর্বর ভূমি আমাদের দিয়ে গেছেন আমরা যেন সেটাকে যেন নষ্ট করে না ফেলি। তোমরা ছোট এদের কথা পড়। এদের থেকে বিজ্ঞান চর্চা করো।

বেলগাছিয়ার ক্যাম্পাস জীববৈচিত্রের খনি- অধ্যাপক পার্থ দাস

পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধক অধ্যাপক পার্থ দাস বলেন- “এই মেলা থেকে সব চেয়ে উপকৃত হবে আশপাশের স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা। আমাদের এই বেলগাছিয়ার ক্যাম্পাস জীববৈচিত্রের খনি। পশ্চিমবঙ্গের বুকে কলকাতা হৃদযন্ত্র সেখানে প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যার সব রকমই এখানে আছে। আমাদের এখানে অনেক পরিযায়ী পাখিও এখানে পাওয়া যায়। আমি যখন বিদেশে ছিলাম কোথাও একটা কাগজ কিংবা প্লাস্টিক ফেলতে পারতাম না।ওটি পকেটে রেখে দিতাম। নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া ফেলার অভ্যাস আমার চলে গিয়েছিল। ভারতে ফিরে আসার পর বেশ কিছুদিন অভ্যাসটা ছিল এখন আমার মনে হয় সেই অভ্যাসটা আমার নেই, সেটা ফেলে দি। অভ্যাস অনেক কিছু শেখায়। আমরা যদি অভ্যসটাকে নিজের করে নিয়ে অন্যদেরও অভ্যাস পালটে দিতে পারি তাহলেই কিন্তু এই মেলার সার্থকতা এই বিজ্ঞানের সার্থকতা।”

বিজ্ঞান কোনও বিষয় নয় এটি একটি পদ্ধতি- অনিন্দ্য চৌধুরী

মেলা কমিটির সম্পাদক অনিন্দ্য চৌধুরী বলেন- প্রথম মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল গত বছর মার্চ মাসে। সেই মেলার থেকে শিক্ষা নিয়ে মোটামুটি ১০ মাসের মাথায় দ্বিতীয় এই মেলা অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। এই মেলা আজ যেখানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এর প্রস্তুতি পর্ব অনেক আগে থেকেই শুরু করেছিলাম। আমরা চেষ্টা করেছিলাম সমস্ত বিজ্ঞান প্রেমী মানুষকে এর সাথে যুক্ত করবার জন্য। আমাদের পরিবেশ-প্রকৃতি-বিজ্ঞান চর্চা এই সম্পর্কে মানুষকে ভাবানোর জন্য। আমরা বিগত ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে এই মেলা প্রাঙ্গনেই প্রায় ৫০০ প্রতিযোগী বিপুল সাড়ার মাধ্যমে বসে আঁকো প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলাম। এরপরেই দুই নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী মাদাম কুরী এবং সি ভি রমনের জন্মদিন ৭ই নভেম্বরে শুরু হয় আমাদের সারা ভারত বিজ্ঞান চেতনা অভিযান।বিজ্ঞান অভিযানের আরও বেশি করে প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। আমরা মনে করি, বিজ্ঞান কোনও বিষয় নয় এটি একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে গেলেই মানুষ তথন সমাজ বিজ্ঞানমনস্ক হবে।”

এরইমাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এসএস দানা মেলা উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকার উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানের ঘোষক বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ্ম নিবন্ধক ড. সৌরভ চন্দ সকলকে মেলা পরিদর্শনের জন্য আহ্বান জানান।

বিজ্ঞান মেলায় যারা অংশ নিয়েছে

২২টি বিদ্যালয়, তিনটি মহাবিদ্যালয় তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের তৈরি বিজ্ঞানের নানা উদ্ভাবনী মডেল বিজ্ঞান মেলার প্রধান আকর্ষণ। ঐতিহাসিক এসিয়াটিক সোসাইটি, মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে সাড়া জাগানো সংস্থা ইসরো, ভারতীয় প্রাণি সর্বেক্ষণ, ভারতীয় বন সর্বেক্ষণ, ভারতীয় উদ্ভিদ সর্বেক্ষণ, ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ সায়েন্স মিউজিয়াম, জাতীয় কলেরা ও অন্ত্র রোগ সংস্থা, ভারতীয় কৃষি গবেষণা সংস্থার বিভিন্ন সংস্থার অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ এই মেলার উপযোগিতা অনেকাংশে বাড়িয়ে তুলেছে। পাশাপাশি তারামন্ডল, দুরবীণে আকাশ দেখা, কুসংস্কার বিরোধী যুক্তিবাদী প্রদর্শনী, তান্নাঘরে বিজ্ঞান, হ্যাম রেডিও, বিবর্তনের ইতিহাস, খাদ্যে ভেজাল নির্ণয়ের মতো বিষয়গুলি মানুষের মনে কৌতুহল জাগায়। একই সংগে অভিনব ডগ শো এই মেলাকে অন্য বিজ্ঞান মেলা থেকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।

বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা

একই সঙ্গে বিজ্ঞানের রকমারি বইয়ের সম্ভার নিয়ে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, বিজ্ঞান দরবার, গোবরডাঙা গবেষণা পরিষৎ ও দেজ এর মতো প্রকাশক সংস্থা। এছারাও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জীবনী নিয়ে প্রদর্শনী বাংলার বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে যে সকল মনীষীরা অবদানব রেখে গেছেন তাঁদের সংক্ষিপ্ত জীবনী সহ ‘বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা’র মণ্ডপে বিজ্ঞানের নানা দিকের জ্ঞাতব্য বিষয় যা সাধারণের মননে নিশ্চয়ই আলোড়ন তুলবে।

Published on: জানু ৫, ২০২৪ at ২৩:৪৯


শেয়ার করুন