শ্রীকৃষ্ণ যাঁদের সঙ্গে রাসলীলা করেছিলেন জানেন কি তাঁরা কারা ছিলেন

Main দেশ ধর্ম ভ্রমণ রাজ্য
শেয়ার করুন

Published on: নভে ২৩, ২০২৩ at ১১:০৪
লেখক-রসিক গৌরাঙ্গ দাস

এসপিটি বিশেষ প্রতিবেদন, মায়াপুর, ২৩ নভেম্বর:  আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার দুইশত সাইত্রিশ বছর আগে জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিশেষ সংখ্যাতত্ত্বের (পশ্চাৎগণনানুসারে)শ্রীধাম বৃন্দাবনের ধীরসমীরে, যমুনা তীরে বংশীবটমূলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্রজগোপাঙ্গনাদের সঙ্গে অপ্রাকৃত রাসলীলাবিলাস করেছিলেন। শারদীয়া পূর্ণিমার রাতে এই রাস নৃত্য অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই রাতে সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতি অপরূপসাজে সুসজ্জিত হয়েছিল।পূর্ণ চন্দ্রের স্নিগ্ধ চন্দ্রালোকে গগণমন্ডল উদ্ভাসিত। বৃক্ষ, লতা, গুল্মাদি, পশুপক্ষী উন্মুখ হয়েছিল ভগবানের রাসলীলা দর্শনে। শ্রীকৃষ্ণের নরলীলা সমূহের মধ্যে সর্বোত্তম রাসলীলা। এই রাসনৃত্য ছিল সম্পূর্ণ চিন্ময়। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র আট বছর।

শ্রীকৃষ্ণের কেবল আনন্দময় ‘আনন্দময়োহভ্যাসাৎ’। বৃন্দাবনে সকলেই আনন্দময়। পশু-পক্ষী, বৃক্ষ-লতা, জল-স্থল, গাভী, গোবৎস, গোপবালক এবং গোপবালিকারা সকলেই কৃষ্ণপ্রেমে আনন্দময়। শ্রীকৃষ্ণকে ভালবেসে তারা পরম আনন্দে মগ্ন।

ভগবানের ভগবত্তার নির্যাস হল মাধুর্য্যরস। যা পূর্ণরূপে প্রকটিত হয়েছে দ্বাপর যুগের শেষে কৃষ্ণলীলায়। শরতের শেষে বিশ্বপ্রকৃতি যেন আনন্দমগ্না। যমুনাপুলিন শরদজ্যোৎস্না দ্বারা বিধৌত।

বিশ্বপ্রকৃতির মনোমুগ্ধকর পরিবেশে শরৎ পূর্ণিমার রাতে বংশীবটমূলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বংশী বাদন শুরু করলেন। মন প্রাণ হরণকারী বংশীর ধ্বনি শুনে ব্রজগোপীকারা তাঁদের পতি, পুত্র, গৃহকর্ম, জাতি-কুল-মান সমস্ত কিছু পরিত্যাগ করে, শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মহামিলনের জন্য রাসস্থলীতে ছুটে এসেছিলেন। ভগবানের সঙ্গে মিলনের জন্য এইরূপ ব্যাকুলতাই মানুষকে চরম সার্থকতা এনে দেয়। কৃষ্ণানুরাগে রঞ্জিত হয়ে ওঠাই ছিল ব্রজবালাদের একমাত্র সাধনা। শ্রীকৃষ্ণও নৃত্যানুষ্ঠানের উপযুক্ত স্থান-কাল-পাত্র-বিবেচনা করে মল্লিকা, জুঁই ও অন্যান্য অত্যন্ত সুগন্ধিযুক্ত পুষ্প দ্বারা নিজেকে সজ্জিত করেছিলেন। অপ্রাকৃত রাস্নৃত্য শুরু হলো। রাসমন্ডলীতে দুই গোপী তার মধ্যে কৃষ্ণ। যত গোপী তত কৃষ্ণ। রাসরসের নায়ক শ্রীকৃষ্ণ।

Read more news:

ইসকন মায়াপুর মন্দিরে রাস পূর্ণিমা উৎসব শুরু ২৬ নভেম্বর

‘নাচতঘন নন্দলাল রসবতী করি সঙ্গে।’ এই রাসনৃত্যে বিশ্বভুবন নাচে। ফুলের উপর নাচে ভ্রমরভ্রমরী। মেঘের তালে নাচে ময়ূরময়ূরী। কদম্ব শাখায় নাচে শুক-শারী। বৃক্ষ-লতা, পশু-পক্ষী, জল-স্থল, আকাশ-বাতাস আনন্দে নৃত্য করে গোপী-গোবিন্দের প্রেমের উদ্বেলতায়। এই চির আনন্দ খেলার বিরাম নেই। চলছে নিরন্তর নিরবচ্ছিন্ন।

শ্রীকৃষ্ণ কে? সকল বিশ্বজীবের অন্তরে যিনি অধ্যক্ষ বা বুদ্ধি প্রভৃতির সাক্ষী, সেই পরমাত্মা আজ ক্রীড়ার তরে লীলা বিগ্রহধারী। সকলের অন্তরের অন্তরতম রূপে শ্রীকৃষ্ণ বিরাজমান। তাঁর কেউ পর নেই। কি পুরুষ, কি নারী, সকলেরই হৃদয় বিহারী। তাঁর এই লীলা আত্মার সঙ্গে আত্মার বিহার। নিজের সঙ্গে নিজে্রই খেলা। এই খেলা বিশ্বজুড়ে প্রতিনিয়ত চলছে। তাঁরই বৈচিত্র্যময় প্রকাশ রাসলীলা। গোপীদের ব্রতসাধন, দীর্ঘদিনের তপস্যা, হৃদয়ে পুঞ্জীভূত অনুরাগের ফলে, তাঁদের অনুগ্রহ করবার জন্য শ্রীকৃষ্ণ এই রাসলীলা করেন।

বর্তমানে আমরা একবিংশ শতাব্দীর সভ্য মানুষ। আত্মসুখের আয়োজনে তৎপর। উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে ছোট হয়ে আসা পৃথিবীর মানুষ। সব কিছুই আমাদের হাতের মুঠোয়। আমরা ছুটে চলেছি বিশ্ব বিজয়ে। চলছে পারমনাবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা। চাহিদা বেড়ে চলেছে ভোগ্য বস্তুর। ভুলে গেছি আত্মানুসন্ধানের যথার্থতা। অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে জানতে চাই শ্রীভগবানের রাসলীলা রহস্য। অথচ মন ছুটে চলে জড় জাগতিক বিকৃত কদর্য রসের দিকে।

‘কিন্তু এর বাইরেও যে জগৎ আছে তোমরা নিজেরাই জানো না।’ জগতের কেউ সুখী নয়। সুশোভিত চির বিকাশমান পুষ্পের মতো জীবনের আরেক রূপ যথার্থ বাস্তব জীবন। যা শাশ্বত, জরা-ব্যাধি-মৃত্যুহীন। এই জীবনেই তা লাভ করা সম্ভব।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা জড়জাগতিক কামউপভোগ নয়। আমাদের কাম-কলুষিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে শুদ্ধ চিত্তে রাসলীলা রহস্য উন্মোচনে প্রয়াসী হতে হবে। মনে রাখতে হবে ব্রজাঙ্গনারা সাধারণ স্ত্রীলোক ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ পার্ষদ।ব্রহ্মসংহিতায় বলা হয়েছে যে, তাঁরা হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তির প্রকাশ।

শ্রীধাম বৃন্দাবনে চার শ্রেণীর ব্রজললনাদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ রাসনৃত্য করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিল নিত্যসিদ্ধ গোপকন্যারা, যাঁরা ছিলেন শ্রীমতী রাধারানীর কায়ব্যূহ। অন্য শ্রেণী ছিল দেবকন্যারা, যাঁরা নিত্যসিদ্ধদের সঙ্গের ফলে নিত্যসিদ্ধ স্তর লাভ করেছিলেন। অন্য আর এক শ্রেণী ছিল মূর্তিমানশ্রুতিরা, যাঁরা তপস্যা করে গোপকূলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁরা ছিল সাধনাসিদ্ধ। আর ছিলেন ঋষিরা, যাঁরা দন্ডকারণ্যে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে দেখে শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে লাভ করতে চেয়েছিলেন।

ব্রজরামারা যমুনার তীরে এক মাস ব্যাপী কাত্যায়নীর ব্রত করেছিলেন। তাঁরা শ্রীকৃষ্ণকে পতি রূপে লাভ করতে চেয়েছিলেন। ব্রজবালাদের মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্যই রাসনৃত্য অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে অসংখ্য রূপে বিস্তার করে প্রত্যেক গোপীর সঙ্গে যুগপৎভাবে নৃত্য করেছিলেন। রাসপূর্ণিমার রাতটি ছিল ব্রহ্মরাত। মানুষের কাছে যা চারশত বত্রিশ কোটি বছর। ব্রজগোপিকারা একটু গর্বিত হলে, রাধারানীকে নিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্হিত হয়ে যান।

কৃষ্ণবিরহে গোপাঙ্গনারা প্রেমে উন্মাদ্গ্রস্ত হয়েছিলেন এবং সারা রাত্রি কৃষ্ণের লীলা অনুসরণ করে অন্বেষ্ণ করেছিলেন। অবশেষে কৃষ্ণ দর্শন দান করে রাসনৃত্যের মাধ্যমে গোপীদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছিলেন। এইভাবে ব্রহ্মারও দুর্লভ প্রেম গোপীরা প্রাপ্ত হয়েছিলেন।

ব্রজগোপাঙ্গনাদের কৃষ্ণের প্রতি যে আকর্ষ্ণ বা ভালবাসা, এই আকর্ষণ বা ভালবাসা-ই তাঁদের সবকিছু পরিত্যাগ করে কৃষ্ণ সান্নিধ্য লাভে সহায়তা করেছিল। গভীর প্রেমার্তি না থাকলে তাঁকে পাওয়া যায় না। যতরকমের সাধন-মার্গ আছে, সবেরই মূলকথা প্রেম-গভীর আকর্ষণ। আমাদের মন প্রাণকে কৃষ্ণের সেবার প্রতি, তা হলে রুদ্রকে অনুকর্ণ করে বিষ পান করার মতোই সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।

শ্রদ্ধা সহকারে যিনি শ্রীকৃষ্ণের এই অপ্রাকৃত রাসলীলা শ্রবণ, কীর্তন ও স্মরণ করবে, তিনি অচিরেই শ্রীকৃষ্ণ পাদপদ্যে প্রেমভক্তি লাভ করবেন।

লেখক পরিচিতি-মায়াপুর ইসকন-এর জনসংযোগ আধিকারিক

Published on: নভে ২৩, ২০২৩ at ১১:০৪


শেয়ার করুন