Published on: অক্টো ১, ২০২৪ at ১৯:৫৮
এসপিটি নিউজ, কলকাতা/শিলিগুড়ি, ১ অক্টোবর: নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন মানেই যে সুখনিদ্রা নয়, হাতেনাতে তার প্রমাণ পেলেন শিলিগুড়ির সেবক রোডের একত্রিশ বছর বয়সী যুবক সঞ্চিত খন্ডেলওয়াল। সদ্য শুরু করা কাপড়ের ব্যবসায়ী সঞ্চিত বেশ কিছু বছর ধরে রাতে ঘুমোতে গেলেই গগনবিদারী নাক ডাকেন। প্রথমে সমস্যাটিকে সাধারণ ভেবে মানিয়ে নিলেও যখন নাক ডাকার সঙ্গে ঘুমের মধ্যে নিশ্বাস নিতে অসুবিধা হওয়ার কারণে ধড়ফড় করে উঠে পড়তে বাধ্য হন সঞ্চিত, তখন বোঝেন শুধু নাক ডাকা নয়, আরও গম্ভীর কোনো সমস্যা রয়েছে।
শিলিগুড়িতে ডাক্তার দেখিয়ে সঞ্চিত জানতে পারেন তিনি ভুগছেন মারাত্মক ওএসএ বা অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়াতে, যে রোগে ঘুমের সময় শ্বাসনালী বাধাপ্রাপ্ত হয়। আপাতদৃষ্টিতে এই অদৃশ্য লড়াইটি মানুষের জীবনযাত্রার মানকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে, এমনকি প্রাণঘাতীও হতে পারে। এই স্লিপ অ্যাপনিয়ার প্রভাবে শুধু যে ঘুমন্ত অবস্থায় শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয় তা নয়, এটি উচ্চস্বরে নাক ডাকা ও দিনের বেলা নিদ্রালুতারও কারণ হয়।
ওএসএ-এর উপসর্গগুলি তার উৎপাদনশীলতাকে হ্রাস করে এবং তার মানসিক ও শারীরিক সুস্থতাকে গুরুতরভাবে ব্যাহত করে। সঞ্চিতের অবস্থা এতটাই গুরুতর ছিল যে চিকিৎসকরা তাকে সি-প্যাপ (কন্টিনিউয়াস পজিটিভ এয়ারওয়ে প্রেসার) থেরাপির পরামর্শ দেন, যা শ্বাসনালী খোলা রাখতে ও তার উপরে ধারাবাহিক চাপ বজায় রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু তাতেও খুব একটা সুবিধা না হওয়ায় তিনি অন্য চিকিৎসার খোঁজ শুরু করেন। সেই সময় জানতে পারেন কলকাতার মণিপাল হাসপাতালের ব্রডওয়ে শাখায় ডঃ দীপঙ্কর দত্তের কথা।
ইএনটি সার্জন ও স্লিপ সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডঃ দত্ত প্রথমবার সঞ্চিতকে দেখে অবাক হন যে সঞ্চিতের বয়স ও শারীরিক সুস্থতার অধিকারী একজনের এই রোগ হয়েছে। সঞ্চিত স্থূলকায়ও ছিলেন না এবং নিয়মিত জীমে ব্যায়াম করেন। ডঃ দত্ত জানান, স্লিপ অ্যাপনিয়া সঞ্চিতের মতো সুস্থ, তরুণ ব্যক্তিদের মধ্যে অত্যন্ত বিরল।
ডঃ দত্ত সঞ্চিতকে বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে বলেন, যার মধ্যে ছিল পলিসমনোগ্রাফি টেস্ট যা তার ঘুমের সময় মস্তিষ্কের তরঙ্গ, রক্তের অক্সিজেনের মাত্রা, হৃদস্পন্দন এবং শ্বাস-প্রশ্বাস পর্যবেক্ষণ করে। পরীক্ষাটি নিশ্চিত করে যে রোগী সত্যিই ওএসএতে ভুগছিলেন এবং সিপিএপি মেশিনে সাড়া না দেওয়ায় সার্জারিই সেরা বিকল্প হবে। ডঃ দত্ত সঞ্চিতের গলায় কিছু বিশেষ অপারেশন করেন যা শ্বাসনালীকে প্রশস্ত ও পরিষ্কার করতে সাহায্য করে, যাতে সঞ্চিত ভালো করে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারেন এবং ভালোভাবে ঘুমোতে পারেন।
ডঃ দত্ত প্রথমে কোব্লেশন নামক পদ্ধতির সাহায্যে টনসিলগুলির বেশিরভাগ অংশ সরিয়ে ফেলেন, কিছুটা রেখে দিয়ে যাতে সেগুলি বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। তারপর তিনি মুখের উপরের টাগড়াকে মসৃণ করেন যাতে এটি শক্ত না হয় এবং একটি রাবার ব্যান্ডের মতো প্রসারিত করা যায়। সর্বশেষ, তিনি ইউভুলা বা আলজীভ (গলার পিছনে ঝুলন্ত ছোট্ট অংশ) কাটেন যাতে এটি বায়ুপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি না করে। এই ধাপগুলো মিলিতভাবে সঞ্চিতকে শ্বাস নিতে ও ভালভাবে ঘুমাতে সাহায্য করে।
সঞ্চিতকে প্রথমে ডে কেয়ারে ভর্তি করে তার ড্রাগ-ইনডিউসড স্লিপ এন্ডোস্কপি (ডিআইএসই) পরীক্ষা করা হয়, যাতে সঞ্চিতকে ওষুধের সাহায্যে ঘুম পাড়িয়ে উপরের শ্বাসনালীতে কতটা অবরোধ আছে সেটা
তৎক্ষণাত বুঝতে সাহায্য করে এবং তারপর সঞ্চিতের সার্জারির পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। ৮ই সেপ্টেম্বর ডঃ দত্ত সঞ্চিতের শ্বাস-প্রশ্বাস ও ঘুম উন্নত করার জন্য বেশ কয়েকটি অপারেশন করেন, যাকে মাল্টি-লেভেল স্লিপ সার্জারি বলা হয়।
ডঃ দত্ত প্রথম যে অপারেশনটি করেন, সেটি কোব্লেশনের মাধ্যমে ইনট্রা ক্যাপসুলার টনসিলেক্টমি (আইসিটি) যাতে টনসিলগুলির সামান্য পরিমাণ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য রেখে দিয়ে বাকিটা বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তিনি বার্বড প্যালাটোফ্যারিঞ্জোপ্লাস্টি নামে একটি বিরল অস্ত্রোপচার করেন, যাতে তালুকে পুনরাকৃতি দেওয়া হয় ও প্রশস্ত করা হয়, যাতে শ্বাসনালী সংকুচিত না হয়। অবশেষে, তিনি ইউভুলোপ্লাস্টি করেন, যেখানে নিশ্বাসে বাধা কমানোর জন্য আলজীভের অংশ কাটা হয়। ধাপে ধাপে এই সার্জারিগুলি সঞ্চিতের বায়ুপ্রবাহ উন্নত করে এবং বিশ্রামদায়ক ঘুমে সহায়ক হয়।
ডঃ দত্ত বলেন, “অস্ত্রোপচার করতে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। প্যালাটোফ্যারিঞ্জোপ্লাস্টি সার্জারি বিরল এবং তখনই করা হয়, যখন ওএসএ সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকে এমনকি সি-প্যাপের মতো অন্য কোনো চিকিৎসায় সাড়া দেয় না। অস্ত্রোপচারের জটিলতা এবং সঞ্চিতের বিরল অবস্থা এটিকে আরও কঠিন করে তুলেছিল। সার্জারির ঝুঁকি সামলাতে এবং সাফল্য নিশ্চিত করতে একটি অত্যন্ত দক্ষ সার্জারি টীমের উপস্থিতির প্রয়োজন। নানান প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও রোগীর সুস্থতা অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তুলতে পারে।”
তার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে সঞ্চিত বলেন, “আমি ক্রমাগত ক্লান্তি এবং হতাশার মধ্যে বাস করছিলাম। এই সার্জারিই আমাকে একটি নতুন জীবনের আশা দেয়। আমার মনে হচ্ছে যেন নতুনভাবে জীবন শুরু করছি। দীর্ঘ সময় ধরে আমি মারাত্মক ওএসএতে ভুগছিলাম, যা আমার স্বাস্থ্য ও পেশাগত জীবনে খারাপ প্রভাব ফেলছিল। ক্রমাগত ক্লান্তি, ঘুমের সময় ঘাম ও শ্বাস নিতে সমস্যা হওয়ার জন্য অল্প বয়সেই সি-প্যাপ মেশিনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয় আমাকে। এই কারণে আমি স্থায়ী সমাধানের সন্ধান করছিলাম। আমি ডঃ দীপঙ্কর দত্ত ও মণিপাল হাসপাতালকে গভীরভাবে ধন্যবাদ জানাই। তারা আমাকে এক নতুন জীবন দিয়েছেন। এখন আমি কোনও মেশিনের উপর নির্ভরশীল নই। আমি রাতে গভীর ঘুমের আনন্দ পাচ্ছি এবং নতুন উদ্যমে আমার ব্যবসা এগিয়ে নিচ্ছি।”
সঞ্চিত মাত্র দুই দিনের মধ্যেই হাসপাতালে থেকে বাড়ি ফিরে যান এবং এখন সি-প্যাপ থেরাপি ছাড়াই স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। অস্ত্রোপচারের সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই ডঃ দত্ত তাকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে জানিয়েছেন, যে আগামী তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যেই সঞ্চিত ভালোভাবে শ্বাস নিতে সক্ষম হয়ে যাবেন এবং স্বাভাবিক ঘুম উপভোগ করতে পারবেন, যা তাকে সম্পূর্ণভাবে সতেজতা দেবে।মণিপাল হাসপাতাল থেকে প্রকাশিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এমনতাই জানানো হয়েছে।
Published on: অক্টো ১, ২০২৪ at ১৯:৫৮