ঘোষগ্রামের লক্ষ্মীমাতা: কামদেব ব্রহ্মচারী প্রতিষ্ঠিত এই পুজো ঘিরে রয়েছে অসাধারণ কাহিনি

Main দেশ বিদেশ ভ্রমণ রাজ্য
শেয়ার করুন

 Published on: অক্টো ২৮, ২০২৩ at ২৩:৩৬
Reporter: Aniruddha Pal

এসপিটি নিউজ: শনিবার ২৮ অক্টোবর ২০২৩, কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। ঘরে ঘরে মা লক্ষ্মীর আরাধনায় ব্রতী হয়েছে বহু মানুষ। ঠিক তেমনই বীরভূমে তারাপীঠের অদূরে রয়েছে ঘোষগ্রামের লক্ষ্মীমাতার মন্দির।এখানকার পুজো ঘিরে রয়েছে অসাধারণ কাহিনি। আছে জনশ্রুতিও, যা শুনে ভক্তরা মুগ্ধ হয়ে যায়।এদিন সন্ধ্যা থেকেই লক্ষ্মীমাতার মন্দিরে পুজো দেখতে বহু মানুষ ভিড় করেছেন।

তারাপীঠ থেকে পাকা রাস্তা ধরে ধরে যাওয়ার সময় ঘোষগ্রামে প্রবেশের মুখে রাস্তার ধারে দেখা যায় সুদৃশ্য লক্ষ্মীমাতার মন্দির। প্রাচীন এই মন্দিরে রীতি মেনেই হয়ে আসছে পুজো। এখানে মন্দিরে লক্ষ্মীমাতার মূর্তিটি দারুময়ী। এই মূর্তি গড়ার পিছনেও রয়েছে দারুন এক কাহিনি। জানা যায়, এই লক্ষ্মীমাতার পুজো শুরু করেছিলেন কামদেব ব্রহ্মচারী নামে এক মাতৃসাধক। যিনি ছিলেন তন্ত্র ও বৈষ্ণব মতের সাধক। তাই মায়ের নির্দেশে তিনি দারুময়ী মূর্তিটিকে মহালক্ষ্মীরূপে দশমহাবিদ্যার দেবী কমলা জ্ঞানে পুজো শুরু করেন।

ঘোষগ্রামের নেপথ্য ইতিহাস

‘তীর্থভূমি তারাপীঠ’ গ্রন্থের লেখক প্রবোধ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, বাংলায় শূর বংশীয় রাজাদের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে রাজা আদিশূর ৭৩২খ্রিষ্টাব্দে মতান্তরে ১০৪২ খ্রিষ্টাব্দে ভূশুরের মঙ্গল কামনায় যজ্ঞের আয়োজন করে। সেই যজ্ঞের জন্য বাংলায় ব্রাহ্মণ না থাকায় যুক্তপ্রদেশ বর্তমান উত্তরপ্রদেশের কণৌজ থেকে পাঁচ জন ব্রাহ্মণ ও পাঁচজন কায়স্থ নিয়ে আসেন। এই পাঁচজন কায়স্থের মধ্যে একজন ছিলেন সোম ঘোষ। কায়স্থদের মধ্যে রাজা আদিশূর ৫০ হাজার স্বর্ণমুদ্রার বার্ষিক উপঢৌকনের বিনিময়ে সোম ঘোষকে জয়যান থেকে একচক্রা পর্যন্ত ২৭০০টি গ্রামের সামন্তরাজ করেছিলেন। সেই হিসেবে ঘোষগ্রামের বয়স নিঃসন্দেহে ১৫০০ বছরের অধিক পুরনো বলে মনে করা যেতে পারে। ঘোষগ্রামের আগে গ্রামটির নাম ছিল ভবেশ্বরপুর। পরে সোম ঘোষের অধীনে গ্রামটি নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কারণে এবং লক্ষ্মীভক্ত দয়াল ঘোষের জন্য গ্রামের নাম ঘোষগ্রাম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

সাধক কামদেব ব্রহ্মচারী

ঘোষগ্রামে লক্ষ্মীমাতার পুজো শুরু করেছিলেন সাধক কামদেব ব্রহ্মচারী। প্রবোধবাবু বলেন- ঘোষগ্রামের নিবিড় আম্রকুঞ্জের মধ্যে বৈষ্ণব মতে লক্ষ্মীমায়ের সাধনা করেন। তিনিই হলেন ঘোষগ্রামে লক্ষ্মীমাতার সিদ্ধসাধক।কামদেব ব্রহ্মচারীর আবির্ভাব বড়তুড়িগ্রামে। তিনি শাক্ত ও বৈষ্ণব মতে সাধনা করে সিদ্ধ হয়েছেন। শাক্তমতে বড়তুড়িগ্রামে কালীমায়ের ও চণ্ডীপুর-তারাপীঠে তারামায়ের সাধনা করেছেন। তারাপীঠে তাঁর নামানুসারে একটি গ্রামের নাম কামদেবপুর এবং কামদেবপুর মৌজায় তারাপীঠ মহাশ্মশান অবস্থিত।

লক্ষ্মীমায়ের পুজো নিয়ে রয়েছে অসাধারণ এক কাহিনি

লক্ষ্মীমায়ের পুজো নিয়ে রয়েছে অসাধারণ এক কাহিনি। প্রবোধ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লোকশ্রুতির কাহিনিটি তাঁর বই-‘তীর্থভূমি তারাপীঠ’ –এ তুলে ধরেছেন। “কামদেব ব্রহ্মচারী যখন ঘোষগ্রামের আম্রকুঞ্জের পাশে নিমগাছের তলায় বসে সাধনা করছেন তখন এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে যায়। সেই সময় লক্ষ্মীভক্ত দয়াল ঘোষ জমিতে হলকর্ষণ করছিলেন। তখন তার পুত্র বায়না ধরে যে গ্রামের পাশের জলাশয় থেকে ভেসে থাকা প্রস্ফুটিত পদ্মটি তুলে দিতে হবে। ভক্ত দয়াল তখন পদ্মটি তুলতে গেলে সেটি সরে যেতে থাকে। এমনটা চলতে থাকে। অবশেষে সাধনায় থাকা কামদেব ব্রহ্মচারীকে গোটা ঘটনা খুলে বলেন। এবার কামদেব ব্রহ্মচারী পরদিন পদ্মটিকে তুলে দেওয়ার কথা বলেন।এরই মধ্যে লক্ষ্মীমায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে রাতেই পদ্মটিকে তুলে আম্রকুঞ্জে একটি ঘটের উপর স্থাপন করে লক্ষ্মীপুজো শুরু করেন। এভাবেই মা সকলের মাঝে প্রকট হন।

Read more news: 

তারাপীঠে আজ মাতারা’র আবির্ভাব তিথি উৎসব, বিশ্রামমন্দিরে হল মায়ের পুজো

দারুময়ী মূর্তির কাহিনি

তবে ঘটে পটে পূজিতা হয়ে আসছিলেন মালক্ষ্মী।একদিন মালক্ষ্মী তন্ত্র ও বৈষ্ণব সাধক কামদেবকে স্বপ্নাদেশে জানালেন- তাঁর মূর্তি গড়ে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন প্রতিষ্ঠা করতে। আর সেই মূর্তি হবে দারুময়ী।কোথা থেকে সেই কাঠ আনতে হবে মা তাও জানিয়ে দিলেন সেই সাধককে। জলাশয়ের কাছে বাস্তুভিটা সংলগ্ন পদ্মচিহ্ন যুক্ত একটি শাখা বিশিষ্ট নিম গাছের কাঠ দিয়ে হবে সেই দারুমূর্তি। সেই গাছে থাকবে না কোনও কোটর, থাকবে না পাখি কিংবা সাপের বাসা। শুধু গাছের গায়ে থাকবে পদ্মচিহ্ন। এই কথা জানিয়ে মা সেই সাধককে বলেম- মূর নদী থেকেই তুমি এই কাঠ সংগ্রহ করতে পারবে।আমি মুর্শিদাবাদের মণিগ্রামের রাজার তৈরি কণক লক্ষ্মীমন্দির থেকে রাজার উদাসীনতায় বন্যার কারণে ভাসতে ভাসতে কাঠ রূপে নূর নদীর কিনারাতে অবস্থান করব। তুমি সেই কাঠ সংগ্রহ করবে। তোমার পর্ণকুটিরের ঘরে সাধনার জায়গায় দারুমূর্তি গড়ে পূজার্চ্চনার ব্যবস্থা করবে। সেই সঙ্গে মালক্ষ্মী তাঁর ভক্ত সাধককে জানিয়ে দেন, কি রূপে পুজা করবে। সাধক কামদেবকে মা বলেন- তুমি তন্ত্র ও বৈষ্ণব সাধক হওয়ায় আমাকে মহালক্ষ্মীরূপে দশমহাবিদ্যার দেবী কমলা জ্ঞানে আরাধনা করবে। তারপর সেই মতো মূর নদী থেকে স্বপ্নাদেশে পাওয়া প্রদত্ত কাঠ সংগ্রহ করে তার উপর গঙ্গামাটি দিয়ে চতুর্ভূজা রূপে ঘোষগ্রামের আম্রকুঞ্জে তাঁর পর্ণকুটিরে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর রাতে মহালক্ষ্মীমূর্তি স্থাপন করেন। সাধক কামদেব সত্ব গুণের অধিকারী হওয়ায় অক্ষ অর্থাৎ জপের মধ্যে আত্মচৈতন্যে নবজীবন পেয়ে মায়ের আশীর্বাদে সিদ্ধ হন।

লক্ষ্মীমাতার মন্দির নির্মাণ এবং জমি প্রদান

প্রবোধবাবু লক্ষ্মীমাতার মন্দির নির্মাণ সম্পর্কে জানাতে গিয়ে বলেন- একবার সাধক কামদেবের পর্ণকুটিরের পাশ দিয়ে ঘোড়ায় চেপে সম্ভবত ঢেকার রাজা রামজীবনের উত্তরাধিকারী মহেশ রায় যাচ্ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেন সাধক তাঁর পর্ণকুটিরে নিম গাছের তলায় বসে পদ্মকে লক্ষ্মীজ্ঞানে পুজো করছেন।লক্ষ্মীভক্ত মহেশ রায় সাধকের উপর সন্তুষ্ট হয়ে মায়ের মন্দিরনির্মাণ থেকে পুজার্চ্চনা সব কিছুর দায়িত্ব নেওয়ার কথা স্বীকার করেন। তখন সাধক কামদেব জমিদারের কাছে বলেন- আপনার তো অনেক সম্পত্তি আছে। তা থেকে যদি কিছু মায়ের জন্য দেন তাহলে ভাল হয়। এই বলে তিনি সেই জমিদারকে বলেন যে তিনি শাখে তিনটি ফুঁ দিয়ে যতটা জমি প্রদক্ষিণ করবেন ততটুকু জমি মায়ের নামে হবে।ীতে রাজী হয়ে যান জমিদার। তারপরই  সাধক প্রথম ফুঁ দিয়ে ১০০ বিঘা দ্বিতীয় ফুঁ দিয়ে আরও ১০০ বিঘা এবং তৃতীয় ফুঁ দিয়ে ৭২ বিঘা প্রদক্ষিণ করার পর জমিদার হাত জোড় করে সাধককে আর প্রদক্ষিণ না করার অনুরোধ জানান।সেই থেকে ২৭২ বিঘা জমি লক্ষ্মীমায়ের নামে দান করেন। যদিও আজ বেশিরভাগটাই বেহাত হয়ে গেছে। শুধু মন্দিরের অবস্থানটি বর্তমান সেবাইতদের নামে রেকর্ড হয়ে আছে।

মায়ের মূর্তি ও ধানের শিষের আঁটি

মূর্তির ডানদিকে কন্যা সন্তান ধন ও বাম দিকে পুত্র সন্তান কুবের রয়েছেন। প্রতীক রূপে চালের গাই মন্দিরে মায়ের হাতে দেখা যাবে- যা তিনি পুত্র কুবেরকে জনসাধারণের মধ্যে বিলি করার নির্দেশ দিয়েছেন। কথিত আছে যে সত্য যুগে ধান না হয়ে সরাসরি চাল হত। জনৈক রাজা একবার খিদের জ্বালায় চাল ছিঁড়ে খান। এই দৃশ্য দেখে মালক্ষ্মী অত্যন্ত বিচলিত হন। মালক্ষ্মী তখন ভাবেন যে রাজা নিজেই যদি চাল ছিঁড়ে খান তাহলে প্রজারা তো আরও বেশি করে খাবেন। তাই তিনি চালের চারিদিকে খোসার আবরণ দিয়ে ধানের সৃষ্টি করেন।

প্রতি বছর কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন ঘোষগ্রামের লক্ষ্মীমাতার মন্দিরে বহু মানুষ পুজো দিতে আসেন। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রায় কয়েক হাজার মানুষ এদিন মায়ের ভোগ প্রসাদ পান। প্রতি বছর পৌষ, চৈত্র ও ভাদ্র মাসের প্রতি বৃহস্পতিবার বহু ভক্ত মন্দিরে পুজো দিতে আসেন। প্রত্যহ পাঁচ সের দুধ, পাঁচ পোয়া আতপ ও পাঁচ ছটাক চিনি দিয়ে মায়ের পরমান্ন ভোগ হয়।

Published on: অক্টো ২৮, ২০২৩ at ২৩:৩৬


শেয়ার করুন