সোনার বাংলার সোনার প্রতিভা মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য মানব প্রেমের মূর্ত প্রতীক

এসপিটি এক্সক্লুসিভ দেশ বিদেশ
শেয়ার করুন

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ৫৩৩তম শুভ আবির্ভাব উপলক্ষ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলী

রসিক গৌরাঙ্গ দাস

 Published on: মার্চ ১, ২০১৮ @ ১৪:১৩

এসপিটি প্রতিবেদেন, ১ মার্চঃ বাংলার এক হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সোনার বাংলায় শুধু ফসলই ফলেনি, অজস্র সোনার প্রতিভারও স্ফূরণ ঘটেছে। সেই জ্যোতির্ময় আশ্চর্য্য সব প্রতিভার মধ্যে ‘নদের নিমাই’ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু হচ্ছেন মধ্যমণি।

এহেন প্রেমের অবতার এই বাংলাদেশের উর্বর মাটিতেই সম্ভব। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মধ্যে মনীষা এবং হৃদয়বৃত্তির এক অপুর্ব সমন্বয় ঘটেছিল। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যথার্থই বলেছিলেন-

‘বাঙালীর হিয়া অমিয় মথিয়া

     নিমাই ধরেছে কায়া ।’

১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি নবদ্বীপের মায়াপুর গ্রামে শুভ দোলপূর্ণিমতে আবির্ভূত হয়েছিলেন ‘নদের নিমাই’। গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু রাধাকৃষ্ণের মিলিত তনু। অহৈতুকী প্রেমভক্তি আন্দোলনের পরাকাষ্ঠা। ভগবান হয়েও তিনি এই ধরাধামে ভক্তরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। অবতরণের প্রধান কারণ- প্রথমত, তিনি শ্রীধারার প্রেমের মাধুর্য্য এবং স্বরূপ আস্বাদন করতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি শ্রীবৃন্দাবনের লুপ্ততীর্থ উদ্ধার এবং শ্রীকৃষ্ণের পুজোর পুনরায় প্রচলন করতে চেয়েছিলেন। তৃতীয়ত, কলিযুগের উপযোগী করে ভগবানের নাম ও প্রেম প্রচার করতে চেয়েছিলেন। কারণ, কলিযুগের মানুষ এমনিতে স্বল্পায়ু এবং জীবন যুদ্ধে অতিশয় ব্যস্ত। তাদের পক্ষে জটিল পূজার্চনা বা যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়। তাছাড়া ভগবান আত্মারাম হয়েও ‘স্বমাধুর্য্য’ আস্বাদন করতে চেয়েছিলেন।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কে? যাঁর কৃপালাভের জন্য সারা বিশ্ব পাগল, যাঁর শুধামৃত পানে আপামর জনসাধারণ পরিতৃপ্ত। যাঁকে দর্শন করলে শুদ্ধভক্তির উদয় হয়, যাঁকে স্পর্শ করলে জীবনে শাশ্বত শক্তির সঞ্চার হয়, যাঁর সান্নিধ্যে এলে লজ্জা-ঘৃণা-ভয় দূরীভূত হয়। যিনি ভক্তদের কৃপা করতে সর্বদা উৎসুক, যিনি ইহলোকের আশ্রয়, পরলোকের প্রাণের আশ্বাস, যিনি ভীতচিত্তের সর্বস্ব; যিনি অপূর্ণের পূর্ণ- শূন্যের ষোল আনা, যিনি পরম পিতা, পরম মাতা, যিনি সুখের প্রভাত, আবার দুঃখ্রাত্রির অবসান, যাঁর কণ্ঠস্বরে দিব্য লীলার সুর ঝংকৃত, যিনি সর্বদা দিব্য কৃষ্ণনাম এবং কৃষ্ণপ্রেমে নিমগ্ন, তিনিই প্রথম ঘোষণা করলেন ধর্মের নামে হিংসা-অধর্ম। যাঁর অলৌকিক প্রভাবে জগাই-মাধাইয়ের মতো শত শত ঘোর মদ্যপও মনুষ্যত্বের মর্যাদা ফিরে পেয়েছে। অহিংসা সাম্যবাদী আন্দলনই যে সমস্যা সমাধানের রাস্তা এই সত্য ধর্মীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রথম দেখা গেল। শত সহস্র মানুষ তাঁর প্রদর্শিত পথ অনুসরন করে ত্যাগ, প্রেম ও অহিংসার আদর্শে অনুপ্রাণিত হল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালীর অপূর্ণতায় ব্যথিত হয়ে বলেছেন- ‘আমাদের মধ্যে হইতেই তো চৈতন্য জন্মিয়াছিলেন। তিনি বিস্মৃত মানব প্রেমের বঙ্গভূমিকে জ্যোতির্ময়ী করিয়া তুলিয়াছিলেন।’

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন- ‘যেখানে একবিন্দু যথার্থ ভক্তি দৃষ্টিগোচর হইবে সেখানেই বুঝিতে হইবে যে উহা নদীয়া কেশরী শ্রীগৌরাঙ্গ প্রেম প্রণয়ের মাহাত্ম্য কণিকা।’

চিত্তরঞ্জন দাস বলেছেন-‘আমার জীবনে পরিবর্তন এনেছেন শ্রীগৌরাঙ্গদেব। শ্রীগৌরাঙ্গের আত্মহারা প্রেমমূর্তি আমার সব কুসংস্কার, সব দোষ দূর করে দিয়েছে ও দিচ্ছে।’

কবি নজরুল ইসলামের কবিতার কিছু অংশ-

‘বনচোরা ঠাকুর এল রসের নদীয়ায়

তোরা দেখবি যদি আয় ।’

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রেমভক্তি আন্দোলন এবং ব্যক্তিত্বের চুম্বক আকর্ষণের দ্বারা সকলে প্রভাবিত হয়েছিল। যেমন, তৎকালীন বাংলার শাসন কর্তা সুলতান হোসেন শাহের দুই মন্ত্রী সাকর মল্লিক (প্রধানমন্ত্রী) এবং দবীর খান (অর্থমন্ত্রী) পরবর্তীকালে সনাতন এবং রূপ গোস্বামী। প্রবোধানন্দ সরস্বতী, বল্লভাচার্য, গোপাল ভট্ট এবং পুরীর রাজা প্রতাপরুদ্র। এমনকি তৎকালীন ভারত সম্রাট আকবরও তাঁর উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন করে বলেছেন-

‘ঐছন পহুঁকো যাই বলিহারি।

শাহ আকবর তেরে প্রেম ভিখারী।’

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রবর্তিত প্রেমের ফল স্বরূপ মানুষ ফিরে পেল মনুষ্যত্বের মর্যাদা, পেল মুক্তির স্বাদ, শুচি হল মুচি, যবন হল নামাচার্য্য, উচুঁ-নীচু বিভেদভাব, বৃথা অভিলাষ, হিংসা-দ্বেষ হল দূরীভূত। বিশ্ব শান্তি ও বিশ্ব কল্যাণে আজও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অবদান চিরভাস্বর।

শুভ আবির্ভাব দিবসে প্রার্থনা জানাই তিনি যেন আমাদের চৈতন্য চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেন।

(লেখক শ্রীমায়াপুর চন্দ্রোদয় মন্দির, ইন্টার ন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনসাসনেসের জনসংযোগ আধিকারিক)

Published on: মার্চ ১, ২০১৮ @ ১৪:১৩


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

8 + 2 =