মুক্ত প্রকৃতির প্রাঙ্গনে এ ভাবেও চড়ুইভাতি সম্ভব, ছাত্রদের এক নয়া দিশা দেখাল মায়াপুর ইসকন

এসপিটি এক্সক্লুসিভ রাজ্য
শেয়ার করুন

অনিরুদ্ধ পাল

Published on: ফেব্রু ৬, ২০১৮ @ ১২:৫১

শীত বিদায় নিতে বসেছে। চলে যাচ্ছে দিনগুলিও। কিন্তু থেকে যাচ্ছে কিছু লোকিক শিক্ষা। যা আজ আমাদের মধ্যে থেকে বিদায় নিতে বসেছে। আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছিল সেই লৌকিক শিক্ষার আসরে উপস্থিত থাকার। আর সেই শিক্ষাটাও হল এক অভিনব প্রক্রিয়ায়। ছাত্রদের নিয়ে চড়ুইভাতির আয়োজন করেছিলেন মায়াপুর ইসকনের পন্ডিতরা। যেখানে ছিল না তারস্বরে মাইকের দাপাদাপি। ছিল না নাচানাচি। ছিল না কোনও রঙিন জলের ফোয়ারাও। তবু সেখানে ছিল প্রকৃতির এক রাশ আনন্দ। ছিল অপার জ্ঞান প্রাপ্তির সুখ। ছিল ছাত্র সমাজের কাছে সঠিক পথে চলবার দিশা।এ যেন সত্যিই এক অচেনা চড়ুইভাতি। কয়েকটা মুহূর্তের জন্য ফিরে এল প্রাচীন কালের সেই গুরু-শিষ্য পরম্পরার দৃশ্য।

সংবাদ প্রভাকর টাইমস-এর প্রতিনিধি হয়ে এই মুহূর্তটায় উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। পাঠকদের কাছে সেইদিনের গোটা ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।

গত শনিবার ৩ ফেব্রুয়ারি সকালে মায়াপুর ইসকনে গেছিলাম আমি। মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রসিক গৌরাঙ্গ দাসের সঙ্গে দেখা করতে। অবশ্যই মন্দির দর্শন তো ছিলই। তিনিই আমাকে বলেন, চলুন, আপনাকে আমাদের চড়ুইভাতির অনুষ্ঠানে নিয়ে যাচ্ছি। ভাল লাগবে। আমি তখন ভেবেছিলাম, চড়ুইভাতি আবার দেখার কি আছে!কিন্তু সেখানে গিয়ে যা দেখলাম তা অনবদ্য, অসাধারণ, অপূর্ব।

দেখা গেল মায়াপুর ইসকন মূল মন্দিরের ঠিক উলটো দিকে গঙ্গার পাড় ঘেঁষে তৈরি হয়েছে এক অরণ্য। প্রকৃতি ঘেরা সেই জায়গায় তখন চলছে ছাত্রদের নিয়ে চড়ুইভাতি। এ আবার কেমন চড়ুইভাতি? এ তো গুরু-শিষ্যের কথোপকথন। ইসকনের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রসিক গৌরাঙ্গ দাস জানালেন-আপনি এত অধৈর্য্য হচ্ছেন কেন, দেখুন না সব উত্তর পেয়ে যাবেন। হ্যাঁ, উত্তর আমি পেয়েছি। এমন সুন্দর সুস্থ মানসিকতা, লোকশিক্ষার মধ্যেও যে একটা চড়ুইভাতি হতে পারে তা দেখাল মায়াপুর ইসকন। এমনকী, খাবারের মেনুতেও ছিল জিবে জল আসা সব নিরামিশ আহার। সত্যি পথ দেখাল ইসকন।

তখন ছাত্রদের উপদেশ দেওয়া শেষ করেছেন ইসকনের গভর্নিং বডির সদস্য ভক্ত পুরুষোত্তম স্বামী। তার উপদেশ শোনার সৌভাগ্য থেকে আমি বঞ্চিত হলেও মায়াপুর ইসকনের ভায়েস চেয়ারম্যান এরপর শঙ্কর সন নিতাই দাস-এর প্রায় গোটা কথোপকথন শোনার সৌভাগ্য লাভ করতে পেরেছি। তাঁর সামনে তখন বসে আছে ছাত্ররা। যাদের বয়স ১৩ থেকে শুরু করে ১৮-১৯ বছর পর্যন্ত। সকলেই মন দিয়ে শুনছেন।

গুরুমশাই তাদের কাছে জানতে চাইছেন-তোমরা ৮ মালা কারা কারা জপ কর? ৬ মালা? ৪ মালা? ১ মালা? শূন্য মালা? বলেই হাসলেন।ছাত্রদের সঙ্গে শুরু হল তাঁর আলাপচারিতা-কথপোকথন।

তিনি বলতে থাকেন-যে প্রভুপাদ আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনা কেন্দ্র ইসকন তৈরি করেছেন, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে-সারা পৃথিবীর মানুষ মহপ্রভুর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তাদের মনুষ্যজীবনকে সার্থক করুক। কি, তাই তো!

কারণ, মহাপ্রভু বলেছিলেন, “পৃথিবীতে আছে যত নজরাদি গ্রাম সর্বত্র প্রচারিত হইবে মোর নাম।” তিনি আরও বলেছিলেন, “ভারতভূমিতে মনুষ্য জন্ম হইল যার, জন্ম সার্থক করি করো পরোপকার।” মনুষ্যজন্ম তখনই সার্থক হয় যখন আমরা অন্যের উপকার করি।

কারা কারা অন্যের উপকার করতে চাও?কারা কারা অন্যের অপকার করতে চাও? হাত তোলো।

দেখা গেল অপকারের ক্ষেত্রে কারও হাত উঠল না। এরপর তিনি ফের ছাত্রদের কাছ থেকে জানতে চান, তা কি করে উপকার হয়। অন্যের উপকার কি করে আমরা করতে পারি? তারপর তিনি নিজেই জবাব দেন-যার বাড়ি নেই, তাকে বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হল। যে খেতে পাচ্ছে না তাকে খেতে দেওয়া হল।যে বস্ত্র পায় না তাকে বস্ত্র বা কাপড় দেওয়া হল।ছাত্রদের মধ্যে কোনও অস্থিরতা দেখা গেল না। তারা মন দিয়ে গুরুর পরামর্শ শুনছেন।

গুরু বলতে থাকেন, মহাপ্রভু যে উপকারের কথা বলছেন সেটা হচ্ছে-নিত্য পরোপকার।একটা হচ্ছে নিত্য পরোপকার আর একটা হচ্ছে অনিত্য পরোপকার।এরপর ছাত্রদের সামনে একটি গল্প বলেন।

একবার তিনজন বন্ধু রাজার কাছে গেছে।রাজা ভাবছেন কিছু চাইতে এসেছে ওরা।প্রথম বন্ধু এসেছে রাজার কাছে। রাজা বলছেন, তুমি আমার কাছে কি চাও? তখন সে রাজাকে বলে, রাজন, আমাদের বাড়িটা ভাঙাচোরা। ভালো নয়। দয়া করে যদি আমার বাড়িটা বানিয়ে দেন তাহলে খুব ভাল হয়। রাজা তখন মন্ত্রীকে ডেকে বলেন, মন্ত্রীমশাই এই ছেলেটার বাড়িটা ভালো নয়। একে একটা বাড়ি বানিয়ে দেবেন।

দ্বিতীয় বন্ধু আসতেই রাজার প্রশ্ন, তোমার কি চাই?সে তখন জানায়, রাজন, আমার বাড়িটা ভাল। তবে, বাড়িতে যাওয়ার রাস্তাটা ভালো নয়। রাজা এবার মন্ত্রীকে ডেকে রাস্তা বানিয়ে দেবার কথা বলেন।

এবার তৃতীয় বন্ধু এসেছে রাজার কাছে। রাজা তার কাছেও একই প্রশ্ন করলেন। সে বলল, রাজন, আমার কিছুই চাই না। তখন রাজা তাকে বলেন, না, না, তুমি রাজার কাছে যখন এসেছো তখন তোমাকে তো কিছু চাইতেই হবে। তখন তৃতীয় বন্ধুটা বলে, রাজন, আপনি আমার বাড়িতে এসে একদিন থাকবেন।

এরপর গুরুর প্রশ্ন-তা তৃতীয় বন্ধুটা বোকা না? কে চালাক সব থেকে বেশি। তৃতীয় বন্ধুটা। তখন রাজা মন্ত্রীমশাইকে ডাকলেন। আর নির্দেশ দিলেন-আমি এর বাড়িতে থাকব। সব ব্যবস্থা করো।

রাজা কোথায় থাকে? রাজপ্রাসাদ। রাজপ্রাসাদ তৈরি হল।

রাজা কোন পথে যাবে? রাজপথ। রাজপথ তৈরি হল।

রাজা কোথায় থাকবে? পুরো এলাকাটা উন্নত হয়ে গেল।

তাহলে এবার বল, কে বেশি বুদ্ধিমান? তৃতীয় বন্ধুটা। তোমরা এরকম বুদ্ধিমান হতে চাও না প্রথম-দ্বিতীয় বন্ধুর মতো হতে চাও।কৃষ্ণ যা ভজে সে হল চতুর। ভগবানের ভজন করা ভাল না খারাপ? ছাত্ররা বলে ওঠে ভাল।

তখন তাঁর প্রশ্ন, তাহলে করছে না কেন? এরপর তাঁর সংযোজন-কলিযুগে মানুষের বুদ্ধিটা একটু মোটা বুদ্ধি। কিন্তু কারা বুদ্ধিমান? যারা মহাপ্রভুর উপাসনা করে। তারা হচ্ছে বুদ্ধিমান। কৃষ্ণের উপাসনা করলে আমাদের জীবন সার্থক হয়। জন্ম সার্থক করি করো পরোপকার। আগে নিজের জীবনটা সার্থক করতে হবে। তারপর না পরোপকার হবে। কৃষ্ণের ভক্তি বা ভগবানের ভজনা করলে আমাদের জীবনটা পরিপূর্ণতা লাভ করে। আমাদের জীবনটা সার্থক হয়। আমাদের জীবনটা আনন্দময় হয়।

এরপর তিনি ছাত্রদের কাছে প্রশ্ন রাখেন-কৃষ্ণ আছে? কারা কারা মানে কৃষ্ণ আছে? কৃষ্ণ ভগবান আছেন? কারা কারা দেখেছে কৃষ্ণকে?

তিনি বলতে থাকেন-একবার এক রিপোর্টার প্রভুপাদকে জিজ্ঞাসা করেন, প্রভুপাদ, আপনারা তো এত কৃষ্ণ কৃষ্ণ করেন, কৃষ্ণ না থাকলে কি হবে?যদি কেউ এসে বলে কৃষ্ণ নেই তাহলে তোমাদের দুঃখ হবে না? হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ করি-কৃষ্ণই নাই। তখন প্রভুপাদ উত্তর দিচ্ছেন-যদি কৃষ্ণ না-ও থাকেন আমাদের কোনও অসুবিধা নাই। যারা কৃষ্ণ ভক্ত তারা যাতে আনন্দে থাকে। আমরা সকলে আনন্দ চাই।

তোমরা কারা আনন্দ চাও? কারা কারা দুঃখ চাও? আমরা সবাই দুঃখ চাই কিন্তু মনে মনে সবাই আনন্দ চাই। আমরা সকলে আনন্দ চাই। তোমরা ভগবানের অংশ। জীব সবসময় আনন্দ করছে। আনন্দ কোথায় পাওয়া যায়? বিগবাজারে (হাসেন)? আনন্দটাকে কত টাকা দিয়ে কেনা যায়? এই আনন্দটা হচ্ছে একটা চিন্ময় বস্তু।

তিনটে জিনিস হল সুখ-শান্তি-আনন্দ।ইন্দ্রিয়র সঙ্গে ইন্দিয় বস্তুর মিলনের ফলে যে অনুভূতি সেটাকে বলে সুখ অথবা দুঃখ। মনের অনুভূতিকে বলে শান্তি। আত্মার অনুভূতিকে বলে আমি। তোমরা সকলে জানো দেহটা আমাদের জড়বস্তু দিয়ে তৈরি। পঞ্চ মহাভূতে তৈরি। মাটি-বায়ু-অগ্নি-জল-আকাশ। এটাকে বলে স্থূল শরীর। এরপর আছে সুক্ষ্ম শরীর। মন-বুদ্ধি। এরপর হচ্ছে আত্মা। মন দ্বারা শান্তি আর আত্মা দ্বারা আনন্দ। আত্মাটা চিন্ময়। তাই আত্মার অনুভূতিটা চিন্ময়ী। এই জগতে এটা পাওয়া যায় না। শ্রদ্ধার মূল্য দিয়ে ভক্তিকে কেনা যায়। ভক্তি লাভ করলে আমরা আনন্দ লাভ করতে পারি।

আমি দাঁড়িয়ে দেখছি আর ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি এই ভেবে যে আমরা যে চড়ুইভাতি দেখি সেখানে একরকম আর এটাও এক চড়ুইভাতি-এখানে আর এক রকম। এখানে অংশ নেওয়া ছাত্ররা শুধু আনন্দ নয় চড়ুইভাতির শেষে সঙ্গে নিয়ে যাবে কিছু লৌকিক ও ভগবৎ শিক্ষাও। যা আজকের দিনে সত্যিই বিরল।

তাই প্রভুপাদ বলেছেন-ভগবান যদি নাও থাকে আর যদি ভগবান থাকে তাহলে এ জীবনে কাজ শেষ করে ভগবানের কাছে ফিরে যেতে হবে। সেখানে একটু আনন্দ আর জীবন।

যারা ভগবান মানে না ভগবানকে বাদ দিয়ে বহির্মুখী জীবন-যাপন করে তারা এমনিতেই দুঃখে আছে। ভগবানকে মানা হচ্ছে লাভ। মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবানকে স্মরণ। ভগবানের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ আমাদের স্বরূপকে জানা।জীবের স্বরূপ হল কৃষ্ণের নিত্যদাস। আমরা আনন্দ পেতে চাই। কিন্তু দুঃখ পাচ্ছি কেন? আমরা যারা দুঃখ পাই জীবনে জন্ম-জরা-ব্যধির চক্রে পড়ে গেছি। তার কারণ হচ্ছে ভুলে গেছি। ভগবৎ বহির্মুখ জীবনই হচ্ছে দুঃখের মূল।

শেষ হল গুরু-শিষ্য কথোপকথন। এবার শুরু হল ভোজন পর্ব। ব্ররহ্মচারীরা পরিবেশন শুরু করলেন। একদিকে গুর পন্ডিতরা বসেছেন। আর এক দিকে ছাত্ররা। একে একে পাতে পড়ল ভাত, সবজি ডাল, সব্জির পাকোড়া, সজনেডাটা-বড়ি-কাঁচকলা-গাঁজর দিয়ে সবজি, মিক্সড সবজি, পনিরের ডালনা, টমেটোর চাটনি, দই, দই বড়া, পাঠিশাপটা পিঠে, ইস্কনের নজস্ব তৈর রসকদম্ব।

সত্যিই এক অসাধারণ অনুভূতি নিয়ে আমিও বাড়ির পথে পা বাড়ালাম। সঙ্গে প্রাপ্তি হল এমন অনেক শিক্ষা।সবাই মিলে সমস্বরে বলে উঠল হরে কৃষ্ণ।

Published on: ফেব্রু ৬, ২০১৮ @ ১২:৫১


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

23 − 14 =