বেঁচে ওঠা

Main রাজ্য সাহিত্য
শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতিঃ অনুরিমা পাল একজন স্কুল ছাত্রী। নৈহাটি সেন্ট লিউক’স ডে স্কুলে্র অষ্টম শ্রেণিতে পাঠরত। ছবি আঁকা তার নেশা। পাশপাশি নানা ধরনের লেখালেখিতেও তার সখ আছে। ‘বেঁচে ওঠা’ তার লেখা প্রথম গল্প। সংবাদ প্রভাকর টাইমস চায় সে এভাবে লেখার মাধ্যমে জাগিয়ে তুলুক এমন আরও অনেক গল্প কাহিনি।

Published on: নভে ১৪, ২০২০ @ ১২:০৬ 

-অনুরিমা পাল

গ্রামের নাম বীরা। এখানে অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় বিশেষ নিয়ম পালন করা হয়। এই দু’টি দিনে গ্রামে উনুন ধরানো হয় না। এমনটাই চলে আসছে। এই দিনে গ্রামের মানুষ ছাতু খেয়ে আর দান করে দিন কাটায়।

এমনই এক অমাবস্যার রাতে গ্রামের মধ্যে জঙ্গলের ভিতর এক কালীপুজোর করবে স্থির করে। আর সেই পুজোয় একজনকে বলির জন্য খুঁজছিলেন।কিন্তু তাঁর মধ্যে প্রশ্ন জাগে- যাকে সে বলি দেবে তাকে কিভাবে এখানে নিয়ে আসবে? কারণ, সেইদিনই ছিল অমাবস্যা। একদিনে বলির জন্য একজনকে খুঁজে বের করা বেশ কঠিন কাজ। তাহলে…

যদিও কাপালিকের অনেক ক্ষমতা। বনের সমস্ত জন্তু-জানোয়ার থেকে শুরু করে ভূত-প্রেত সকলেই তাঁর অধীনে। তিনি যেমনটা বলেন তেমনটাই মেনে চলে তারা। কিন্তু বলির জন্য লোক কিভাবে সে নিয়ে আসবে এই ভেবে তাঁর মন অতিষ্ট হয়ে উঠলো।

এবার তাঁর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। কাপালিক ঠিক করলো ভূতের সাহায্য নেবেন। তখনই তিনি ভূতের সর্দারকে ডাকলেন। কাপালিকের ডাকে সেই মুহূর্তে সেখানে হাজির হয়ে গেলো ভূত সর্দার।

-আদেশ করুন হুজুর। বলল ভূত সর্দার।

-এই মুহূর্তে কাউকে এখানে বলির জন্য ধরে আনতে হবে।কাপালিক বললেন।

-আপনার তো অনেক ক্ষমতা, তা এই সামান্য কাজটুকু আপনি করুন না।-ভূত সর্দার বলল।

-পারলে আর তোদের ডাকতাম না। কাপালিক বলে ওঠেন।

-ঠিক আছে, বলে কাপালিকের কাছ থেক বিদায় নিল ভূত সর্দার।

ভূত সর্দার পড়লো মহা সমস্যায়। কারণ, সে ছিলো খুব অলস প্রকৃতির। বসে বসে গল্প করে আর খায়-দা-ঘুমোয়। কাপালিকের নির্দেশে বেকায়দায় পড়লো সে। ভূত সর্দার বুঝলো এ থেকে একজনই তাকে সাহায্য করতে পারে আর সে হচ্ছে তার বউ পেত্নী।

পেত্নীকে ভূত সর্দার সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে নিজে গল্প করতে চলে গেলো। আর পেত্নীও বেরিয়ে পড়লো বলির জন্য লোক ধরে আনতে।

পেত্নী প্রবেশ করলো সেই বীরা গ্রামে। সেই গ্রামেই থাকতো মাধব নামে এক ব্যক্তি। সে চাল ভেজে বিক্রি করে সেই টাকায় সংসার চালাতো। সেদিনও সে চাল ভাজছিল। এই সময়, কে যেন বলে ওঠে- ওরে থাম, পঞ্চাশ বস্তা চাল পাঁচ দিনে ভেজে দিতে হবে। ভালো টাকা পাবি। আর শোন, কালকের মধ্যে দু’বস্তা চাল ভেজে দিতে হবে। অন্যথা যেন না হয়। এ কথা বলে রাজার সেপাইরা সেখান থেকে চলে গেলো।

মাধবের সব শুনে তো মাথায় হাত। হ্যাঁ, এটাও ঠিক এতদিনে তার কপাল ফিরেছে বটে। কিন্তু এজন্য তো হাড় ভাঙা খাটুনি। এত অল্প সময়ে এ কাজ কিভাবে সম্ভব? মনের মধ্যে প্রশ্ন উঁকি দিতে থাকে মাধবের।

এখন সে কী করবে! সবাই নাচ-গান আনন্দ করছে আর মাধব মনের দুঃখে বসে বসে চাল ভাজছে।মাধবের মাথায় আবার আর এক চিন্তা তাড়া করে বেড়াচ্ছে। শর্মা মশাইয়ের কাছ থেকে টাকা ধার করেছিল। তিনি আজ রাতেই আসবেন টাকা নিতে।

পেত্নী মাধবের সব কাণ্ডকারখানা লক্ষ্য করছিল। পেত্নীর মনে হলো- এর মনে যখন এত দুঃখ তাহলে একেই বলির জন্য নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। যেমনটা ভাবা তেমনতাই কাজ। পেত্নী তখনই মাধবের বউয়ের রূপ নিয়ে মাধবের সামনে উপস্থিত হল।

-এই শুনছো! তোমার যা কাজ তা আজকের মধ্যে শেষ হবে না। তার চেয়ে বরং তুমি আমার সঙ্গে এক জায়গায় চলো। যেটুকু চাল ভেজেছো তা দিলে মোহর পাওয়া যাবে। শর্মা মশাইয়ের টাকাও শোধ হয়ে যাবে। গ্রামের মধ্যেই একটা জায়গা, বেশি দূরে নয়। মাধবের বউয়ের রূপ নেওয়া সেই পেত্নী বলে ওঠে।

-মাধব একথা শুনে বলে- এখন এত মোহর লাগবে না। সারা দিন আজ খুব খেটেছি। আজ রাতে ঘুমোবো।

পেত্নী রেগে গিয়ে বলে ওঠে- সারাদিন খেটে এক পয়াসাও তো মিললো না। যাওবা খোঁজ নিয়ে একটা হদিশ নিয়ে এলাম, এখন বলছো যাবে না। আবারও বলছি, তুমি কি যাবে?

মাধব দেখলো, বউ রেগে গেছে, সে তখনও জানে না যে এ এক পেত্নী। বউয়ের বেশ ধরে তার কাছে এসেছে।তাই বউ মনে করে মাধব বুঝলো, এখন যদি না যাই তাহলে বউ খুব রেগে যাবে। তাই সে যেতে রাজী হয়ে গেল।

এবার পেত্নী মাধবকে সঙ্গে নিয়ে গভীর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে নিয়ে যেতে থাকলো। পথ চলতে চলতে পেত্নী ভাবতে থাকলো যে যতবারই লোক আনি ততবারই তো কাপালিক তাকে বলি চড়ায়। এই চলতে থাকলে আমাদের তো কিছুই জুটবে না।আমরা তাহলে কাকে ঘাড় মটকে খাবো।

জঙ্গল ক্রমেই আরও গভীর হতে থাকে। রাতের অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। মাধবের গা ছম ছম করছে। পেত্নী তখন ভেবে নিয়েছে এখনই এর ঘাড় মটকে খাব। এই ভেবে যেই না পেত্নী মাধবের ঘাড় মটকাতে গেছে তখন এক ঝটকায় মাধবের শরীরের ভিতর ঢুকে যায়। আসলে মাধবের শরীরে একটা তাবিজ ছিল। তাবিজ শরীরে থাকার ফলে কোনও ভূত-প্রেত মাধবের শরীরের কাছে ঘেঁষতে পারতো না। কিন্তু আজ সেই তাবিজ খুলে মাটিতে পড়ে যেতেই পেত্নী মাধবের মধ্যে ঢুকে যায়।

এখন পেত্নী ভর করে মাধবের শরীরে। সে এখন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে মাধব পৌঁছে যায় কাপালিকের কুটিরে। কাপালিক মাধবকে দেখে বলে ওঠে- কোথায় মানুষ আর কোথাওই বা ভূত? ভূতের সর্দার সেই মুহূর্তে সেখানে হাজির হয়ে যায়। সে সব বুঝে যায়। কি ঘটেছে। তখন সে মাধবকে দেখিয়ে বলে- এ তো অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক পেত্নী।

কাপালিক তখন তাঁর সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে বলে- তুই যেই হোস না কেন, ওর শরীর থেকে বেরিয়ে আয়, না হলে এর ফল কিন্তু ভয়ানক হবে। এই শুনে পেত্নী তখন মাধবের শরীরের ভিতরে থেকেই কাপালিককে মারতে এগিয়ে যায়। দুজনের মধ্যে লড়াই চলে দীর্ঘ সময় ধরে।এরপর মাধব মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এই সময় মাকালীর সামনে থাকা শঙ্খটা কাপালিক ছুঁড়ে মারে। শঙ্খের আঘাতে পেত্নী মাধবের শরীর থেকে বেরিয়ে আসে।

পেত্নীকে পেয়ে ভূতেরা তখন অন্য রূপ ধরে। তারা ঠিক করে সবাই মিলে মাধবের ঘাড় মটকে খাবে। যেই না তারা মাধবের দিকে এগিয়েছে ঠিক তখনই মাকালীর মূর্তির থেকে একটা আলোর রশ্মি চারিদিকে ছড়িয়ে যায়। সেই তেজে সব ভূতেরা মুক্তি পায়। ইতিমধ্যে বেঁচে ওঠে মাধবও। প্রাণ ফিরে পায় সে। ইতিমধ্যে মূর্তির দিক থেকে নারী কণ্ঠে আওয়াজ ভেসে আসে- “ওরে, তোরা মনে রাখিস, তোরাও একসময় মানুষ ছিলি। আজ তোরা ভূত-পেত্নী হয়েছিস। আজ তোরা যদি ওকে কিছু করিস তাহলে তোদের এই মুক্তি হবে না। চিরকাল তোদের বদ্ধ হয়ে থাকতে হবে। ”

একথা শুনে ভূতেরা বলল- ঠিক আছে, মা। আমরা কিছু করবো না মাধবকে।

আবার ভেসে আসে আওয়াজ- “তোরা চারিদিকে ছড়িয়ে যা। সব জায়গায় বার্তা দে যে মাকালী রক্ত চায় না, চায় শুধু ভক্তি।”

ভূতেরা আচ্ছা বলে চলে গেল।

মাধব চোখ খুলে দেখে সে তার বাড়ির খাটে শুয়ে আছে। তবে এসবই স্বপ্ন!কী সর্বনাশ, চাল যে ভাজাই হয়নি।বউ বল- কী বকবক করছো। কাল বাড়ি ফিরতে দেরী দেখে আমি দেখতে গেছিলাম। দেখি তোমার মাথা ফাটা। রাজার লোকজন এসে বলে গেছে- শরীর তোমার ভালো নয়। তাই দশ দিন বেশি সময় দিয়েছে। আর তোমাকে ৫০টাকা দিয়ে গেছে। মাধব চুপ করে গেলো। সে বুঝতে পারলো, তার হাতে কী যেন আছে। মুঠো খুলতেই দেখে জবা ফুল। বুঝতে পারলো, সবই মায়েরই ইচ্ছা। মায়ের ইচ্ছাতেই ভূতের দমন হল, তার প্রাণও ফিরলো।ফিরলো সুদিন।

মাধব তখন মনের আনন্দে গেয়ে উঠলো- ইচ্ছাময়ী তারা তুমি/ তোমার কর্ম তুমি করো মা/ লোকে বলে করি আমি।

Published on: নভে ১৪, ২০২০ @ ১২:০৬


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

63 + = 68