ফিগেস যখন চন্দ্র বোসের মৃত্যুর নাটক সাজাতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই ঘটল আরও এক নাটকীয় ঘটনা

এসপিটি এক্সক্লুসিভ দেশ বিদেশ রাজ্য
শেয়ার করুন

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস-কে নিয়ে আলোচনা-বিতর্কের শেষ নেই। তাই ১২৫ বছর পরও তাঁকে নিয়ে ভারতবাসীর উৎসাহ-আবেগে এতটুকু ঘাটতি পড়েনি। শুধু একটাই খেদ- তা হল, এত বছর পরেও নেতাজির মৃত্যু ঘিরে বিতর্ক আজও রয়ে গেল। তাঁর পরাক্রম, বীরত্ব, আদর্শ এসব নিয়ে আমরা গালভরা কথা বললেও আজও তাঁর জন্মদিনকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হল না। দেশ স্বাধীন হলেও নেতাজি দেশে ফিরলেন না নাকি তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হল না। নেতাজিকে কেন এত ভয় ? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি আমরা। আজ থেকে আমরা তাই অনুসন্ধানমূলক ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছি। আজ তাঁর প্রথম পর্ব।

লেখক- সুমিত গুপ্ত  

সময়টা ছিল ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাস। লন্ডনের কোনও এক শহরতলীর শান্ত সকাল। ইংল্যান্ডের পাবলিক রেকর্ডের দফতরে তখন কাজ করছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ড. পূরবী রায়। কাজের সূত্রে ইংল্যান্ডে আছেন। একটু বেলার দিকে ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। মনে তাঁর সংশয়ের মেঘ। কি জানি! কার্যোদ্ধার হবে তো! চার প্রান্তের থেকে ভেসে এল বাজখাই পুরুষকণ্ঠ। ডক্টর রায় জানতে চাইলেন, “এমআই ২ অফিসার কর্ণেল ক্লাউদে হিউটয় বলছেন?”

কর্ণেল বললেন,” হ্যাঁ, আপনি কে?” নিজের পরিচয় দিয়ে ড. রায় সোজাসুজি বললেন, ” সুভাষ চন্দ্র বোসের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা ছিল। আপনার সাক্ষাৎ চাই।” বিরক্ত হয়ে কর্ণেল বললেন, “চন্দ্র বোস ইজ ডেড। চ্যাপ্টার ক্লোজড। বোসের মৃত্যু নিয়ে কোনও কথাই বলব না।” মরিয়া হয়ে ড. রায় বললেন, ” আমি তো বোসের মৃত্যু নিয়ে কোনও আলোচনা চাইছি না। আমার হাতে রাশিয়ান আর্কাইভের কিছু সিক্রেট ডকুমেন্ট আছে। সেগুলো নিয়েই বসতে চাই। অবশ্যই আপনি যদি আগ্রহী হন তাহলে!” কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন জাঁদরেল আর্মি ইন্টেলিজেন্স অফিসার কর্ণেল হিউটয়। ড. পূরবী রায় বুঝলেন, মাছে টোপ গিলেছে। যতই হোক ব্রিটিশ রক্ত তো, যাবে কোথায়। কর্ণেল হিউটয় সন্দেহের সুরে বললেন, “এ পেপার্স তুমি পেলে কোথায়?” ড. রায় জবাব দিলেন, রাশিয়ায়। সোভিয়েতের ভাঙনের পর সব আর্কাইভ-ই এখন মুক্ত।” কর্ণেলের গলার স্বর বদলে গেল। তিনি বললেন, “সামনের রবিবার তুমি কি ফ্রি আছো? থাকলে আমার বাড়িতে এসো। লাঞ্চের নিমন্ত্রণ রইল।”

যথাসময় হিউটয়ের বাড়িতে পৌঁছলেন ড. পূরবী রায়। লাঞ্চের পর ড. রায়কে নিজের স্টাডি রুমে নিয়ে গেলেন হিউটয়। দেওয়ালের গায়ে একটা পুরনো কাঠের শেলফ। চাবি ঘোরালেন কর্ণেল। পাল্লা খুলতেই চমকে উঠলেন ড. রায়। গোছা গোছা পুরনো ফাইল থরে থরে সাজানো। প্রায় লাফিয়ে উঠলেন প্রফেসর রায়। তাঁকে থামিয়ে দিয়ে কর্ণেল মাথা নাড়লেন। বললেন, উহুঁ! ইউ আর নট অ্যালাউড ইভন টু টাচ দেম। দেখো, এগুলো সবই চন্দ্র বোসের ফাইল। এখন আমার কাস্টডিতে আছে।” কিছুক্ষণ পর কথায় কথায় হিউটয় ড. রায়কে হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা বলো তো প্রভিশনাল আজাদ হিন্দ গভর্নমেন্টের বিপুল সম্পত্তি কোথায় গেল?” ড. রায় বললেন, “এর উত্তর তো আপনি দেবেন। আমি কি করে জানবো।” হিউটয় আবার বললেন,”তোমাদের কারেন্সিতে সত্তর হাজার কোটি টাকা। এত টাকা কোথায় গেল?”

হিউটয়ের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চলুন ফিরে যাই ১৯৪৫ সালে। সেদিন ছিল ২৩ আগস্ট। একটি জাপ সামরিক বিমানে চেপে ব্যাংকক থেকে সায়নন হয়ে মাঞ্চুরিয়ার দাইরেন সীমান্ত পেরিয়ে সোভিয়েতের ওসস্কে পৌঁছলেন সুভাষ। রাশিয়ার মাটিতে তাঁর পদার্পনের খবর সোভিয়েত আর্মি আর এনকেভেদের উচ্চ পদস্থ আধিকারিকদের মারফত পোঁছলেন ক্রেমলিনে। নড়েচড়ে বসলেন জে ভি স্ট্যালিন। ১৯৪১ সাল থেকেই বোসের উপর নজর রেখে চলেছিল কেজিবি। আজ গোটা পৃথিবী ঘুরে সাহায্যের আশায় রাশিয়ায় পৌঁছেছেন সেই বোস। সুভাষের রাশিয়ায় পৌঁছনোর খবর অচিরেই আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবী জুড়ে।রেঙ্গুনে নেতাজির একদা ঘনিষ্ঠ সহযোগী আন সাঙ প্রকাশ্যে বিবৃতি দিলেন, “নেতাজি বেঁচে আছেন এবং ভীষণ ভাবেই বেঁচে আছেন।”

১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, বভেম্বর। আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দিদের মুক্তির দাবিতে নতুন করে তেতে উঠছে ভারতবর্ষের মাটি। ঘনিয়ে উঠছে নৌ-বিদ্রোহীদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। ব্রিটিশরা ততক্ষণে বুঝে নিয়েছে এ দেশে তাদের আর বেশিদিন থাকা চলবে না। আইএনএ আত্মসমর্পন করলেও, নেতাজি হার মানেননি। তাঁর অগ্নিমন্ত্র ছড়িয়ে দেশের ঘরে ঘরে। তাই তিনিই ব্রিটিশ শাসকদের পয়লা নম্বর শত্রু। তাদের দিনের ছায়া এক রাতের দুঃস্বপ্ন। চন্দ্র বোস রাশিয়ায়, এ খবর তাই বভিন্ন সিক্রেট সোর্স মারফত শিগগিরই পৌঁছল লন্ডনে বৃটিশ আর্মি ইন্টেলিজেন্সের সদর দফতরে কর্ণেল জে জি ফিগেসের কানে। খবরের সত্যতা নিয়ে তাঁর সংশয় ছিল। তাই গোটা ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে তিনি নিজে টোকিও পৌঁছলেন নিজের দুই অধস্তন আধিকারিক ডেভিস ও ফিনেয়কে ব্যাংকক আর তাইওয়ানে পাঠালেন চন্দ্র বোসের সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহ করতে। ডেভিস ও ফিনেয় ফিরে এসে ফিগেস-কে যে রিপোর্ট জমা দিলেন, তাতে তাঁর চোখ কপালে উঠল। টোকিও ইন্টেলিজেন্স দফতরে বসে নেতাজির বিষয়ে তাঁর উর্ধ্বতন কর্তাদের কাছে কৈফয়ত দিতে তিনি বাধ্য ছিলেন। কিন্তু ডেভিস ও ফিনেয়র রিপোর্ট অনুযায়ী লন্ডনের বড় কর্তাদের জবাব দেওয়ায় মতো কোনও সদুত্তর তাঁর ছিল না। কারণ, ডেভিস, ফিনেয়র রিপোর্টও বলছিল, চন্দ্র বোস রাশিয়ায়। তাইহোকুর দুর্ঘটনা একটি সাজানো ‘ডিসেপশন’ মাত্র। নিজের চাকরি বাঁচাতে দায়ে পড়ে আঙুল বাঁকালেন ফিগেস। ডেভিস, ফিনেয়র রিপোর্ট চেপে দিয়ে টোকিও সরকারকে মেসেজ করতে কোমর বাঁধলেন তিনি। সৃষ্টি করলেন নেতাজির তথাকথিত মৃত্যুর একটি অসাধারণ গল্প, একটি বিমান দুর্ঘটনার নিখুঁত প্লট। ফিগেসের দরকার ছিল একটি পাকাপোক্ত ডেথ রিপোর্টের। নেতাজির ডেথ সার্টিফিকেট জোটানো সম্ভব ছিল না। যে ঘটনা ঘটেইনি তার পুলিশ রিপোর্ট অথবা ক্রিসেশন সার্টিফিকেট পাওয়া ছিল অসম্ভব।

এই ঘটনার কিছুদিন পরেই নেতাজির মৃত্যুর রিপোর্ট প্রকাশ করল জাপ সরকার। রিপোর্ট প্রকাশ হ’ল দু’টি। একটি রিপোর্ট জমা পড়ল ১৯৪৬ সালের জুলাই মাসে। সই করলেন ডক্টর সুরুতা। অন্যটির খবর এল সেপ্টেম্বরে তাতে সই ছিল ডক্টর ইয়োশোসির। ফিগোস যখন চন্দ্র বোসের মৃত্যুর নাটক সাজাতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই ঘটল আরও এক নাটকীয় ঘটনা। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে। লর্ড মাউন্টব্যাটেন নেহেরুকে মালয় ও সিঙ্গাপুরে পাঠালেন সেখানকার গভর্নরদের সংগে কথা বলে আইএনএ-র সম্পত্তির ভাগাভাগির রফা করতে। কিন্তু রফা হবে কার সঙ্গে কি শর্তে, কিছুই জানা গেল না। তখন সবে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। জয়ী দেশগুলি বিজিতদের উপর সুবিধা মতোন শর্ত চাপিয়ে আপোষ-মীমাংসায় ব্যস্ত। এই অবস্থায় আইএনএ-র সম্পত্তি নিয়ে সোভিয়েত বা আমেরিকার কেউই খুব একটা মাথা ঘামালো না। সেই সুযোগে টোকিওয় বসে ফিগেস আর মালয়, সিঙ্গাপুরে মেহেরু-মাউন্টব্যাটেন কি কলকাঠি নাড়ছেন তাও সকলের চোখ এড়িয়ে গেল।

গোটা ছবিটা একটু স্পষ্ট হল পাঁচ বছর পর। ১৯৫১ সালের ২১ মে। ওই তৎকালীন টোকিও মিশনের প্রধান কে কে চেট্টুর কমনওয়েলথ রিলেশনস সেক্রেটারি শ্রী বিএন চক্রবর্তীকে একটা নোট লিখে পাঠালেন। ওই নোটে আইএনএ সম্পদ লুঠের দুই মূল পান্ডার দিকে অভিযোগের আঙুল তুললেন তিনি। প্রথম সন্দেহভাজন আজাদ হিন্দ সরকারের প্রচারমন্ত্রী এস এ আইয়ার, দ্বিতীয়জন টোকিও ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগের প্রধান মুঙ্গা রামামূর্তি। দু’জনই একদা নেতাজির ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং পরবর্তীকালে তাঁর বিশ্বাসহন্তা। ওই বছরই ২০ অক্টোবর আরও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করলেন চেট্টুর। তিনি জানালেন, কোনও এক সময় নাকি জাপান সরকার মিশনকে গোপনে জানিয়েছিল প্রচুর সোনা-দানা ও মূল্যবান রত্ন ভর্তি অনেকগুলি বাক্স ছিল নেতাজির কাছে। কিন্তু তার মধ্যে মাত্র দু’টি স্যুটকেস নিয়ে মাঞ্চুরিয়াগামী একটি ভাঙাচোরা বিমানে অনুমতি তাঁকে দিয়েছিল জাপ সরকার। প্রশ্ন হল, বাকিগুলি গেল কোথায়?ক্রমশঃ


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

9 + 1 =