জহারা দে লা সিয়েরা- যেখানে একজনও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি

Main কোভিড-১৯ বিদেশ ভ্রমণ
শেয়ার করুন

  • স্পেনের এই শহরটি বর্তমানে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বাকি বিশ্বের সঙ্গে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।
  • 40 বছর বয়সী মেয়র সান্টিয়াগো গ্যালভেন এই পরিস্থিতিতে দারুন ভূমিকা পালন করছেন।
  • জহারা দে লা সিয়েরা- যেখানে কোভিড-১৯ শহরের এক হাজার ৪০০ জন বাসিন্দার এক জনকেও সংক্রামিত করতে পারেনি।
Published on: এপ্রি ৪, ২০২০ @ ১৪:৫৬
Reporter: Aniruddha Pal

এসপিটি নিউজ, ৪ এপ্রিল:   ইচ্ছা থাকলে অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায় তার প্রমাণ দিয়েছে দক্ষিণ স্পেনের পাহাড়ে ঘেরা দুর্গ শহর জহারা দে লা সিয়েরা। করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ যখন গোটা বিশ্বের মতো স্পেনকেও গ্রাস করে ফেলেছে ঠিক তখন এই ছোট্ট শহরটি দেখিয়ে দিল তাদের ক্যারিশ্মা- যা এই মুহূর্তে গোটা বিশ্বের কাছে অত্যন্ত স্বস্তি আর প্রেরণার খবর। অবশ্যই শিক্ষনীয়ও বটে। শহরটি বর্তমানে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বাকি বিশ্বের সঙ্গে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।স্পেনের বাকি সব এলাকা যখন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত তখন এই শহরটিতে আজ পর্যন্ত একজনও আক্রান্ত হয়নি। যা রীতিমতো অবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনা।আমরা কী পারি না এদের মতো হতে?

এক অমূল্য সম্পদে পরিণত

তারা এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে ওই শহরের মেয়র এবং স্থানীয় সব বাসিন্দাদের সহযোগিতায়।সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এটা সম্ভব হতো না- মনে করছেন সেখানকার মানুষ।এক সময় শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পেতে এই শহরটিকে ব্যবহার করা হতো। মধ্যযুগীয় সময়ে মুরস এবং খ্রিস্টানরা এই শহরকে নিয়ে লড়াই করেছিল এবং ফরাসীরা তাদের 1822 সালে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল।এখন আন্দালুসীয় পল্লীর উপরে শহরটির অবস্থান হঠাৎ করে আরও একবার শহরটিকে এক অমূল্য সম্পদে পরিণত করেছে।

মেয়রের ভূমিকা প্রশংসনীয়

১৪ মার্চ, বিপজ্জনক করোনভাইরাস স্পেন জুড়ে ছড়িয়ে পড়তেই জহারা বাইরের বিশ্ব থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। 40 বছর বয়সী মেয়র সান্টিয়াগো গ্যালভেন এই পরিস্থিতিতে দারুন ভূমিকা পালন করছেন। তিনি প্রথমেই যে কাজটি করেছেন তা হল- শহরে ঢোকার পাঁচটি প্রবেশ পথের মধ্যে একটি ছাড়া বাকি সবগুলি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গ্যালভেন সেদিন তাঁর ভূমিকা যথাযথ পালন করেছিলেন যেদিন স্পেনে “স্টেট অব অ্যালার্ম” কার্যকর করেছিল।গোটা দেশে তিনি একমাত্র মেয়র যিনি তাঁর শহরের মানুষদের সুরক্ষিত করতে এমনই কার্যকর ভূমিকা নিয়েছিলেন, আর তাঁর সেই ভূমিকাকে শহরের সমস্ত বাসিন্দারা সমর্থন জানিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর তার ফলও এখন তারা হাতেনাতে পাচ্ছেন। করোনাভাইরাস এখন এই শহরকে দেখে অন্য রাস্তা দেখেছে। ঢোকার সাহস দেখাতে পারেনি। এখানেই বাকি বিশ্বের সঙ্গে স্পেনের এই ছোট্ট শহরের পার্থক্য।

স্বস্তির নির্যাস মিলেছে

জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান অনুসারে, স্পেনে এই মুহূর্তে সারা বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ করোনাভাইরাসে আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে- ১ লক্ষ ১৯ হাজারেরও বেশি এবং মৃতের সংখ্যা বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ- ১১ হাজারেরও বেশি।যা খুবই আতঙ্কের এই দেশের কাছে। কিন্তু এত আতঙ্কের মধ্যেও স্বস্তির নির্যাস মিলেছে এই দেশেরই এক ছোট্ট শহর থেকে। জহারা দে লা সিয়েরা- যেখানে কোভিড-১৯ শহরের এক হাজার ৪০০ জন বাসিন্দার এক জনকেও সংক্রামিত করতে পারেনি। এই শহরে থাবাই বসাতে পারেনি করোনাভাইরাস।গ্যালভেন সিএনএনকে বলেছেন, ” এই পরিস্থিতি দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে এবং আমি মনে করি এটি আমাদের কাছে এক শুভ লক্ষণ”।

মেয়রের পাশে দাঁড়িয়েছে শহরবাসী

মেয়রের এই কঠোর পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়েছেন শহরের নাগরিকরা, যাদের মধ্যে আছেন প্রবীণ নাগরিকরা। বলে রাখা ভাল যে জহারার প্রায় এক চতুর্থাংশের বাসিন্দারা 65 বছরেরও বেশি বয়স্। এখানে একজন বৃদ্ধ লোকের বাড়িতে 30 জনের বেশি সদস্য রয়েছেন।কাজেই মেয়রের এই সিদ্ধান্ত কতটা তাৎপর্যপূর্ণ ছিল সেটা এখন তারা টের পাচ্ছেন। কারণ, এখানকার বাসিন্দাদের কানে আসছে আশপাশের এলাকার ভয়াবহ খবরগুলি- যেখানে একের পর এক শহর-গ্রাম সংক্রামিত হয়ে চলেছে, ঘটে চলেছে একের পর এক মৃত্যুও।

পর্যটকদের কাছে একটি জনপ্রিয় গন্তব্য

জহারা দে লা সিয়েরা দক্ষিণ স্পেনের পাহাড়ে ঘেরা এক দুর্গের শহর। ছবির মতো সুন্দর এই শহর। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু মানুষ স্পেনে এলেই ঘুরে যান এই শহরে। পাহাড়ের খাঁজ ধরে সাদা ঘর এবং সরু রাস্তাগুলি এক অসাধারণ দৃশ্য বুনে দিয়েছে। খাড়া পাহাড়ের ধার ধরে মধ্যযুগীয় দুর্গের নীচে জলাধারের দিকে তাকালে মনে হবে কী অপূর্ব দৃশ্য। গাড়িতে করে সেভিলি থেকে এক ঘণ্টার পথ, এটি বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের কাছে একটি জনপ্রিয় গন্তব্য। গ্যালভেন সিএনএন-কে বলছিলেন যে প্রথম কয়েকদিনেই তাদের ফরাসি এবং জার্মান পর্যটকদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। আসলে তারা স্থানীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না।

শহরের একমাত্র প্রবেশ দ্বারে কড়া প্রহরা

শহরে প্রবেশের চারটি প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। খুলে রাখা হয়েছে মাত্র একটি প্রবেশ পথ। অ্যাক্সেস রোডের চেকপোস্টটিতে রাখা হয়েছে একজন পুলিশ অফিসারকে। যিনি সব ঠিকঠাক বুঝলেই তাকে শহরে প্রবেশের অনুমতি দেবেন। বহিরাগতদের প্রবেশের কোনও সম্ভাবনাই নেই। একটি চৌকি রাখা আছে। যেখানে বাইরে থেকে আসা গাড়িগুলিকে পরিষ্কার করতে বিশেষ জলের মিশ্রণের স্প্রে করা হচ্ছে। এই প্রতিরক্ষামূলক কাজে যুক্ত দু’জনকে সারাক্ষনের জন্য দায়িত্বে রাখা হয়েছে। এমনকি যানবাহনগুলির টায়ারগুলি সংক্রামিত মুক্ত কিনা তা দেখার জন্যও তারা নিয়েছে বিশেষ এক পদ্ধতি। গ্যালভেন বলেছেন, “চেকপয়েন্ট দিয়ে এমন কোনও গাড়ি আমাদের শহরে ঢোকেনি যাদের জীবাণুনাশ করা হয়নি।” এই প্রক্রিয়া তারা এখনও জারি রেখেছে।

মেয়র স্বীকার করেছেন-নাগরিকরা আশ্বস্ত

মেয়র স্বীকার করেছেন যে তাঁর এই জাতীয় পদক্ষেপগুলি 20 থেকে 80 শতাংশ কার্যকর হতে পারে তখনই যখন নাগরিকরা সহযোগিতা করতে পা্রবেন। তবে তিনি এটাও মনে করেন যে তাদের তিনি এটাও আশ্বস্ত করতে পেরেছেন সচেতন হলে এধরনের ভাইরাসকে রোখা সম্ভব। এখন তাই নাগরিকরাও বুঝতেও পারছেন যে তাদের শহরে এখন ‘অজানা’ কেউ আসতে পারবে না।

শহর স্বচ্ছ রাখতে তাদের রয়েছে বিশেষ দল

শুধু শহরে চারটি প্রবেশ পথ বন্ধ করে একটি পথে কড়া প্রহরা বসিয়েই চুপ করে নেই মেয়র গ্যালভেন। শহরজুড়ে চলছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার প্রক্রিয়াও। সেকথা জানাতে গিয়ে গ্যালভান বলেন, “প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৫টা নাগাদ প্রায় দশ জনের একটি দল শহরের সমস্ত রাস্তা,  প্লাজা এবং বাড়িগুলির বাইরের অংশকে জীবাণুমুক্ত করার জন্য কাজ করেন।এদের মধ্যে একজন হলেন স্থানীয় কৃষক আন্তোনিও আটিয়েনজা, যিনি তাঁর ট্র্যাক্টর নিয়ে রাস্তায় স্প্রে করে শহরের মধ্য দিয়ে চলে যান।

ঘরেই পৌঁছে যাচ্ছে সব অত্যাবশ্যকীয় পণ্য

বাইরে বের হলে সংক্রমন ছড়াতে পারে। তাই কেউ যাতে ঘর থেকে বের না হতে পারেন তার জন্য মেয়র নিয়েছেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। তিনি এ কাজে পশাসনের কর্মীদের কাজে লাগিয়েছেন। যেখানে ঠিক যতজন পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মী লাগবে ঠিক ততজনকেই রেখেছেন। বাকিদের বাড়িতে থাকতে বলেছেন। এর ফলে রাস্তায় লোক সমাগম একেবারেই হচ্ছে না। বাড়িতে যাতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য এবং চিকিৎসার সামগ্রী পৌঁছে যায় তার জন্য তিনি দু’জন মহিলাকে নিয়োগ করেছেন। যারা প্রতিদিন ১১ ঘণ্টা কাজ করে চলেছেন। বাড়ি বাড়ি তারা মুদি ও ওষুধ পৌঁছে দিচ্ছেন।তাদের মধ্যে একজন, 48 বছর বয়সী অক্সি রাসকন বলেন, ” নাগরিকরা বিষয়টিকে দারুনভাবে নিয়েছেন। তারা খুবই খুশি প্রশাসনের এই পরিষেবায়।”

বৃদ্ধ থেকে শিশু সকলের জন্য করা হয়েছে ব্যবস্থা

জহারা এমনই এক শহর যেখানে বয়স্ক ও শিশুদের জন্য স্থানীয় প্রশাসন বিশেষ কিছু কর্মসূচি নিয়েছে।জহরিলা মহিলা সমিতি নামে এক মহিলা সংগঠনের উপর দেওয়া হয়েছে এক বিশেষ দায়িত্ব। তারা বয়স্কদের রান্না করা খাবার সরবরাহের ভার নিয়েছেন। বাড়ির দরজায় তারা পৌঁছে দিচ্ছে সেই রান্না করা খাবার। মেয়র গ্যালভেন শিশুদের জন্য এক অভিনব ব্যবস্থা করেছেন। ঘরে থাকা শিশুরা যাতে হাফিয়ে না ওঠে তার জন্য তারা দু’টি গাড়িকে আলো আর গানের ডালি দিয়ে সাজিয়েছে। গাড়িগুলিতে আলোর সঙ্গে গানও শোনা যাবে। যা শিশুরা তাদের বাড়ির ব্যালকনি ঘরের জানালা কিংবা ছাদ থেকে দেখে আনন্দ উপভোগ করতে পারবে।

আশাবাদী মেয়র-আবার সব আগের মতো হয়ে যাবে

জহারার মতো কয়েকশো ছোট স্পেনীয় শহরগুলির অর্থনৈতিক জীবনরেখা “স্বায়ত্তশাসিত”- স্ব-কর্মসংস্থান দ্বারা পরিচালিত ব্যবসার উপর নির্ভরশীল। তাই এখানে জরুরী পরিষেবা জল, বিদ্যুৎ এবং করের দিকটা এখন জরুরী তহবিলের দিকে তাকিয়ে। এই শহরে বার ও রেস্তোঁরা যা কিনা পর্যটনের উপর নির্ভরশীল এমন ১৯টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাই এখন আর্থিক সহায়তা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে তারা তাকিয়ে এখন মাদ্রিদ কিংবা আঞ্চলিক সরকারের দিকে। একথা জানিয়ে সিএনএন-কে গ্যা্লভেন বলছিলেন- “তাঁদের এখন বড় ধরনের আর্থিক তহবিলের প্রয়োজন।” একই সঙ্গে তিনি আশাবাদী- “বিগত শতাব্দীর মতো এবারেও এই সমস্যা    দেশ কাটিয়ে উঠবে। আমরা আবার সবাই আগের মতো জায়গায় ফিরে যেতে পারবো।”

ছবি সৌজন্যেঃ সিএনএন

Published on: এপ্রি ৪, ২০২০ @ ১৪:৫৬


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

+ 79 = 81