আজ তারাপীঠে তারামায়ের আবির্ভাব উৎসব- কি এর ইতিহাস, জানালেন সেবাইত প্রবোধ বন্দ্যোপাধ্যায়

Main দেশ ধর্ম ভ্রমণ রাজ্য
শেয়ার করুন

Published on: অক্টো ১৯, ২০২১ @ ১৭:৫৬
Reporter : Aniruddha Pal

এসপিটি নিউজ, তারাপীঠ(বীরভূম), ১৯ অক্টোবর:   আজ থেকে ৩২০ বছর আগে তারাপীঠে তারামাকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা রামজীবন চৌধুরী। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন এই শুভ কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। সেই থেকে আজও দিনটা সমানভাবে আবির্ভাব দিবস হিসাবে উদযাপিত হয়ে আসছে। তারাপীথে আসা অনেকেই এই দিন্টির মাহাত্ম্য সেভাবে জানেন না। এই আবির্ভাব দিবসের পিছনে রয়েছে এক লম্বা ইতিহাস। অনেক না জানা কথা। এসপিটি-কে সেকথা সবিস্তারে জানালেন তারাপীঠের সেবাইত সুপ্রসিদ্ধ লেখক, সাহিত্যিক ও গবেষক প্রবোধ বন্দ্যোপাধ্যায়।

তারাপীঠ মন্দিরের সেবাইত, সুপ্রসিদ্ধ লেখক প্রবোধ বন্দ্যোপাধ্যায় এই আবির্ভাব উৎসবের নানা দিক তুলে ধরেন। কোন সময়ে তারামায়ের মুর্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। সেইসময় কাদের শাসন কাল ছিল। কে এই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেসময় কোন কোন সাধক ছিলেন। সেই সাধকরা মাকে কিরূপে পুজোর প্রচলন করেছিলেন। কেন কোজাগরী লক্ষ্মিপুজোর আগের দিন শুক্লা চতুর্দশীতে তারামায়ের আবির্ভাব উৎসব উদযাপিত হয়ে আসছে। এই দিনে মায়ের ভোগ কেমন হয়- এ সমস্ত কিছুই সেবাইত লেখক প্রবোধ বন্দ্যোপাধ্যায় তার গবেষণালব্ধ তথ্য সহযোগে এসপিটি-কে জানান। আসুন শুনি তাঁর মুখ দিয়ে।

কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কবে থেকে শুরু এই আবির্ভাব উৎসব

“তারামায়ের সাধক ছিলেন বশিষ্টদেব। তিনি তারাপীঠ মহাশ্মশানে সাধনা করে মায়ের শিবক্রোড়া রূপের দেখা পেয়েছিলেন। তারামা শ্মশানে শিলা রূপে থেকে যান। দেড় হাজার বছর আগে জয়দেব সওদাগড় প্রথম সেই শিলাকে তারামা রূপে পুজো করেন। পরবর্তীতে পাল, সেন, মুসলিম রাজত্বের পর ১৭০১ খ্রীঃ নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর সময় রাজা রামজীবন চৌধুরী শ্মশান থেকে মা-কে নিয়ে এসে তারাপীঠ মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। সেই দিনটা ছিল কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন শুক্লা চতুর্দশী। তার পর থেকে এই দিনে তারামায়ের আবির্ভাব দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে তারাপীঠে।

সেইসময় তারামা শিলাময়ী রূপে থাকতেন বিশ্রাম মন্দিরে

“সেই সময় তারাপীঠে সাধক ছিলেন প্রথম আনন্দনাথ। প্রথম সেবাইত ছিলেন কিশোর পান্ডা প্রমুখ। তখন মায়ের ধ্যানময়ী রূপ ছিল না। মা’কে বিশ্রাম মন্দিরে পশ্চিম মুখ করে বসিয়ে পুজো দেওয়া হত। এর কারণ হচ্ছে- মুলুটিতে মা তার বোন মৌলিক্ষা মায়ের দর্শন পাওয়া আর শ্মশানে ভক্ত সাধারণকে আশীর্বাদ দেওয়া। সেই দিন থেকেই এই আবির্ভাব উৎসব উদযাপিত হয়ে আসছে। এই সময় বহু বলি উৎসর্গ করা হয়। স্থানীয় বহু ভক্ত মাকে পুজো দিয়ে নিজেদের মনোবাসনা পূর্ণ করেন। এই দিনটিতে ছোটখাটো মেলাও বসত। এর পর প্রতিদিন এই শিলাময়ী মাকে রাজা রামজীবন চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে পুজো দেওয়া হত।”

তারাপীঠে পঞ্চ পর্ব পুজোর প্রচলন

“পরবর্তীতে ১৭৫৮ খ্রীঃ শিলাময়ী মায়ের ধ্যানময়ী মূর্তি যা আমরা দেখে থাকি তার প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৭৫ খ্রীঃ নাটোরের রানীভবানীর দত্তক পুত্র রাজা রাজা রামকৃষ্ণ তারাপীঠ মন্দিরের দেখভালের দায়িত্বে আসেন। তখন তারাপীঠে সাধক ছিলেন দ্বিতীয় আনন্দনাথ। ইনি তারাপীঠে পঞ্চ পর্ব পুজোর প্রচলন করেন। এই পঞ্চ পর্ব হল- একটি একাদশী, একটি পূর্ণিমা, দুটি অষ্টমী এবং একটি সংক্রান্তি।”

তারাপীঠের বর্তমান মন্দির যিনি প্রতিষ্ঠা করেন

“তাছাড়া দ্বিতীয় আনন্দনাথ তারামায়ের সঙ্গে সমস্ত দেবীর রূপের কল্পনা করে পুজোর প্রচলন করেছিলেন- সর্বেশে সর্বশক্তি সমন্বিতে ভয় ধ্বংস্থায়ীনু দুর্গে দেবী নমহস্তুতে। অর্থাৎ তারামাকে সমস্ত দেবীর সঙ্গে অভেদ কল্পনা করে তিনি তারামায়ের উপর দুর্গা-কালী-নীল সরস্বতী-জগদ্ধাত্রী-বগলা-ছিন্নমস্তা রূপের পুজোর প্রচলন করেন। এছাড়াও তিনি তারাপীঠে রথ উৎসবেরও প্রচলন করেন। তারপর ১৭০১ খ্রীঃ রাজা রামজীবন প্রতিষ্ঠিত মন্দির যখন ধ্বংসন্মুখ হয় তখন ১৮১৮ সালে মল্লারপুরের জমিদার দানবীর জগন্নাথ রায় বর্তমান মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দিরেই সাধক বামাক্ষ্যাপা সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। কিন্তু কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন অর্থাৎ শুক্লা চতুর্দশীর দিন মায়ের আবির্ভাব উৎসব যে জায়গায় হয়েছিল তার চিরাচরিত ধারা আজও সমানভাবে বয়ে চলেছে মানুষের ভক্তি সমন্বিত হৃদয়স্থলে।”

এদিন তারামা অন্নভোগ গ্রহণ করেন না

“আগের দিন ভোর তিনটের সময় মূল মন্দির থেকে বিশ্রাম মন্দিরে আনা হয় শিলামাকে। এরপর সমস্ত ভক্তদের উপস্থিতিতে মায়ের স্নানাভিষেক করিয়ে, বিবিধ বস্ত্র, মুখোশ, মুন্ডমালা, হস্তমালা এবং বিভিন্ন ফুলের মালা সহযোগে মায়ের ধানময়ী মূর্তিকে সাজিয়ে মঙ্গলারতির পর সমস্ত ভক্তদের পুজো শুরু হয়। এদিন দুপুরে মা কোনও বিশেষ অন্নভোগ গ্রহণ করেন না। সেই প্রথা মেনে এদিন তারাপীঠে মায়ের সকল সেবাইত থেকে শুরু করে ভক্তরা বাড়িতে রন্ধন করেন না। অন্ন গ্রহণও করেন না। পরিবর্তে তারা সকলেই ফল, দুধ, মিষ্টান্ন আহার করেন।সারা দিন পুজোর পর মাকে সন্ধেবেলায় বিশ্রাম মন্দির থেকে আবার মূল মন্দিরে আনা হয়। সেই শুভক্ষণ কাসর, ঘণ্টা ও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে মুখরিত হয়ে ওঠে। সেই দৃশ্য দেখার জন্য ভক্তদের উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়।”

আরতির পর মা’কে দেওয়া হয় এই ভোগ

“এরপর মা’কে মূল মন্দিরে নিয়ে গিয়ে আবার স্নানাভিষেক করিয়ে ধ্যানময়ী মূর্তিকে সাজানো হয়। মা’কে দেওয়া হয় চিড়ে, লুচি, পায়েস, মিষ্টান্ন ভোগ। এরপর মায়ের বিশেষ আরতি শুরু হয়। আরতির পর মাকে খিচুরি, পোলাও, অন্ন, পঞ্চ ব্যাঞ্জন, বলির মাংস, মাছ, ভাজা, পায়েস ইত্যাদি সহযোগে ভোগ বিবেদন করা হয়। ভক্তেরা সেই প্রসাদ সানন্দে গ্রহণ করে। সেই প্রথা বছরের পর চলে আসছে। সময়ের প্রেক্ষিতে মেলা আজ না হলেও মানুষের সেই ভক্তির রেশ আজ ও সমানভাবে প্রবহমান।”

বাঁদিকে আজকের মন্দিরের ছবি এবং ডানদিকে গর্ভগৃহে তারামা ও সেবাইত প্রবোধ বন্দ্যোপাধ্যায়(ফাইল ছবি)

Published on: অক্টো ১৯, ২০২১ @ ১৭:৫৬


শেয়ার করুন