নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস-কে নিয়ে আলোচনা-বিতর্কের শেষ নেই। তাই ১২৫ বছর পরও তাঁকে নিয়ে ভারতবাসীর উৎসাহ-আবেগে এতটুকু ঘাটতি পড়েনি। শুধু একটাই খেদ- তা হল, এত বছর পরেও নেতাজির মৃত্যু ঘিরে বিতর্ক আজও রয়ে গেল। তাঁর পরাক্রম, বীরত্ব, আদর্শ এসব নিয়ে আমরা গালভরা কথা বললেও আজও তাঁর জন্মদিনকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হল না। দেশ স্বাধীন হলেও নেতাজি দেশে ফিরলেন না নাকি তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হল না। নেতাজিকে কেন এত ভয় ? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি আমরা। সংবাদ প্রভাকর টাইমস তাই অনুসন্ধানমূলক ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। আজ তাঁর দ্বিতীয় পর্ব।
Published on: জানু ২৪, ২০২১ @ ১২:১৩
লেখক- সুমিত গুপ্ত
সময় ১৯৫৫ সালের ১৫ নভেম্বর। এবার আরও বড়সড় বোমা ফাটালেন খোদ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দফতরের আওতাধীন বৈদেশিক বিষয়ক মন্ত্রকের আরও এক কর্তা আর ডি সাটে। একটি গোপন নোটে প্রধানমন্ত্রীকে তিনি জানালেন, জাপানে এস এ আইয়ারের কার্যকলাপ অত্যন্ত সন্দেহজনক।
তিনি লিখলেন, ১৯৪৬ সাল নাগাদ জাপানে অন্যান্য অনাবাসী ভারতীয়দের তুলনায় চোখে পড়ার মতো। বিলাস-বৈভবের জীবন-যাপন করতেন। কৌতুকের বিষয় এই যে সাটের এই নোটের নীচে প্রধানমন্ত্রীর সই ছিল। সেই সঙ্গে ছিল তাঁর বিদেশ সচিব সুবিমল দত্তের আরও একটি নোটিং যাতে তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় লিখেছিলেন, “প্রধানমন্ত্রী এই নোট দেখেছেন।”
এখানেই শেষ নয়, সাটের রিপোর্টে বড়সড় সন্দেহের আঙুল উঠেছিল ব্রিটিশ টোকিও মিশনের ব্রিটিশ দূতাবাসের মিলিটারি এট্যাশে জে জি ফিগেসের বিরুদ্ধেও। তাই সেই ফিগেস যিনি টোকিওয় বসে নেতাজির বিমান দুর্ঘটনার মৃত্যুর গল্প সাজিয়েছিলেন। রিপোর্টে সাটের অভিযোগ ছিল, ফিগেস নাকি এস রামামূর্তিকে লন্ডনে গিয়ে পাকাপাকিভাবে বসবাসের জন্য সাদর আহ্বানও জানিয়েছিলেন।
সাটের রিপোর্ট বলছে, ফিগেস হঠাৎ করে আর্থিকভাবে ফুলে ফেঁপে উঠলেন তা নিয়েও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া দরকার।
পাঠকের কি মনে হয়?
এস রামামূর্তির প্রতি কর্ণেল ফিগেসের হঠাৎ বদান্যতার কারণ কি?
সাটের রিপোর্ট থেকে উঠে এসেছে আরও একটি গুরুতর প্রশ্ন। সাটের রিপোর্ট পড়ে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগের লুণ্ঠিত অর্থ, নগদ সোনা-দানা, রত্নালঙ্কার উদ্ধারের কোনও চেষ্টা করেছিলেন কি নেহেরু?
যদি করে থাকেন তার প্রমাণ কোথায়?”
এই প্রশ্নের উত্তর একটাই -না। তিনি কিছুই করেন নি। উল্টে আইয়ারকে জাপান থেকে ভারতে এনে উষ্ণ সংবর্ধনা দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী।১৯৫৩ সালে এই আইয়ারকেই তিনি তাঁর পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রচার বিভাগের উপদেষ্টার পদে বসান। সম্প্রতি ভারতের জাতীয় মহাফেজখানার ডি ক্লাসিফাই হওয়া একাধিক ফাইল বলছে, ‘ আইএনএ-র লুঠ হওয়া সম্পদের দুটো ক্ষুদ্র অংশ সম্ভবত খয়রাত করেছিল নেহেরু সরকার। আইয়ারকে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রচার উপদেষ্টা করার পর তাঁকে সাত লক্ষ ডলারের একটি অনুদানও দিয়েছিলেন নেহেরু।
১৯৪৬ সালের সার্ভে সিঙ্গাপুর-মালয়ে আইএনএ-র লুণ্ঠিত সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে নেহেরু-মাউন্টব্যাটেনের প্যাঁজ-পয়জার গোপন থাকেনি। সুদূর লন্ডনে বসে সবকিছু নজর রাখছিলেন একজন। তিনি হলেন ব্রিটিশ আর্মি ইন্টেলিজেন্সের ওয়াচ-সেই কর্ণেল হিউটয়। দুঁদে মিলিটারি গোয়েন্দা অফিসার হিউটয় ভালোই জানতেন, বিপুল সোনা-দানা আর ধনরত্নের সম্ভারই আইএনএ-র সম্পদের সবটুকু নয়। সেটি একটি ছোট অংশ মাত্র। সম্পদের সিংহভাগ হল পাহাড় প্রমাণ টাকা। আর সেটা অপারেট হচ্ছে ওভারসিজ ব্যাঙ্ক আর আজাদ-হিন্দ ব্যাঙ্কের মাধ্যমে। তিনি এও জানতেন, বর্মাসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বত্র ছড়িয়ে আছে অসংখ্য রাবার বাগিচা, টিনের কারখানা আর সোনার খনি। অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী মারফত এইসব বাগান আর কারখানার অর্জিত কর্পোরেট জগতের বিপুল অর্থের একাংশের অনুদানে গড়ে উঠেছে চন্দ্র বোসের সমর তহবিল। আর সেটাই আসল মগ্ন কৈলাস। এই বিপুল অর্থের বখরা ব্রিটেনের হাতছাড়া হয়ে যাক এটা কোনওমতেই হতে দেবেন না হিউটয়। ভারত পাকাপাকিভাবে ছাড়ার আগে যতটা লুটেপুটে নেওয়া যায়, তার জন্য যা করতে হয়, তিনি করবেন।
একদিকে যখন চলছে আইএনএ-র গুপ্তধন উদ্ধার অভিযান, অন্যদিকে তখন ভিন্ন ছবি। ঠিক যেন একই কয়েনের উল্টো পিঠ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন সুভাষ। ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট নেতাজির মৃত্যু সংবাদ ইতিমধ্যেই প্রচার করেছে জাপানের ‘দোমেই’ নিউজ এজেন্সি। তারই অবলম্বনে কর্ণেল ফিগেস সাজিয়ে ফেলেছেন নেতাজির মৃত্যুর দুর্দান্ত চিত্রনাট্য। তবু রেহাই কোথায়। দেখা গেল স্বয়ং নেতাজির চেয়ে তাঁর মৃত্যুর গল্প আরও বিপজ্জনক।
চন্দ্র বোস যে ইতিমধ্যেই অশীত দেহে ওসস্কে পৌঁছেছেন রুশ আর্মি অফিসাররা সে খবর গোপনে মস্কো পাঠিয়েছেন। সেই হাওয়ায় ভেসে এসে ছড়িয়ে পড়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের ঘরে ঘরে। মানুষ নতুন আশায় বুক বাঁধছেন-নেতাজি ফিরে আসবেন, মুক্ত করবেন মাতৃভূমি। সেই সময়, ১৯৪৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর বোমা ফাটাল নয়াদিল্লির ন্যাশনাল হেরাল্ড পত্রিকা। ফ্রন্ট পেজে সুপার লিড নিউজ করল তারা- “সুভাষ চন্দ্র বোস রাশিয়ায়।”
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে সেটা ছিল একটা ভয়ংকর দুঃসংবাদ। খবরটা পেয়েই অজানা এক বিপদের গন্ধ পেল মিত্রশক্তির নিয়ন্ত্রিত সিক্রেট এজেন্সিগুলো। প্রমাদ গুণলেন নেহেরু। ৫ জানুয়ারি ১৯৪৬ -এ পাল্টা প্রতিবেদন ছাপলো মস্কো থেকে প্রাভদা পত্রিকা। আন্তর্জাতিক মহলে নেতাজির অস্তিত্বকে নিয়ে বিশেষ করে ব্রিটিশ-ভারত আর রাশিয়ার মধ্যে টানাপোড়েন বাড়তেই থাকলো। বিতর্ক যতই বাড়ে জয় হিন্দ স্লোগানের আগুন ততই হু-হু ছড়িয়ে পড়তে থাকে ভারত-উপমহাদেশের আকাশে-বাতাসে। আগস্ট বিপ্লবের ঢেউ যুদ্ধের ডামাডোলে কোনও রকমে সামাল দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। নতুন করে আরেকটা বড়সড় গোলমালের ধাক্কা হজম করার মতো কোমরের জোর আর তাদের ছিল না।
যুদ্ধে হেরে গেলেও ব্রিটিশ রাজের শিকড় আদৌ নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল আইএনএ। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ফেব্রুয়ারির শুরুতেই আরও একটা গণবিদ্রোহের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকাতে শুরু করলভারতের আকাশে। শুরু হল নৌ-বিদ্রোহ। বিচারাধীন আইএনএ বন্দিদের মুক্তির দাবিতে ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠল জনরোষ। আইএনএ-র ত্রিশ হাজার বন্দি সৈনিককে নির্মমভাবে নিকেশ করেছিল ব্রিটিশ শাসকরা। তারই প্রতিশোধ নিয়ে ভয়ঙ্কর মরিয়া হয়ে উঠেছিল আপামর ভারতবাসী। এমনই এক বিধ্বংসী দ্রোহশালের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে “নেতাজি জীবিত” এই শব্দ দুটো আর নিতে পারছিল না ব্রিটিশ রাজ ও তার ঘনিষ্ঠ কিছু ভারতীয় নেতা। তারা চাইছিল যে কোন প্রকারে নেতাজির সমস্ত গল্পের চির-যবনিকা টানতে, নিষ্কৃতি পেতে।
১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ মিলিটারি এমআই -২ অফিসার উইলিয়ামস গ্লিন জেনিকিন্স উপরতলার কর্তাদের তাড়া খেয়ে তাঁর সতীর্থদের সঙ্গে গোপন বৈঠকে বসলেন। এক দীর্ঘ বৈঠক শেষে তিনি তাঁর এক জনৈক সহকর্মীকে বললেন, “ইয়ং মেক বোস পারমানেন্টলি ডেড।”
একবার উইনস্টন চার্চিল নেতাজি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “বোস উইল বি লাইনড আপ এগেইনস্ট এ ব্রিক ওয়াল অ্যান্ড শট।” তাঁর নির্দেশে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত ব্রিটিশ সিক্রেট পুলিশের গুপ্ত ঘাতকরা বেশ কয়েকবার নেতাজিকে খুনের চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু স্ট্যালিনের লৌহশাসনের চোখ এরিয়ে রাশিয়ায় গিয়ে নেতাজিকে মারবে কে? কাজেই বাস্তবে মারতে না পেরে কাগজে-কলমে চন্দ্র বোসকে চিরতরে মুছে ফেলার তোড়জোর শুরু হল। স্বেচ্ছায় না হলেও সেই কাজে আগে থেকেই অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলেন কর্ণেল ফিগেস। কিন্তু মন থেকে সন্দেহ যায় কই। তাই ১০০ শতাংশ নিশ্চিত হতে মাঠে নামলো ব্রিটিশ গোয়েন্দা দফতর।
কমনওয়েলথের ইতিহাস বিভাগও সেই সময় চন্দ্র বোসের পরিণতি ও অবস্থান সম্পর্কে একটা নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চাইছিল। ১৯৪৬ সালের এপ্রিলে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা শুরু করলেন তদন্ত। সমস্ত কিছু খতিয়ে দেখে তাঁরাও জানলেন, নেতাজি জীবিত এবং তিনি রাশিয়ায়। ব্রিটিশ কর্তারা জেনে ফেললেও তাঁদের ভারতীয় দোসররা তখনও নিশ্চিত হতে পারছিলেন না।
এবার ‘ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল ইন্টেলিজেন্স’ গোপনে ইংল্যান্ডের ‘ডিরেক্টরেট অফ ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো’কে অনুরোধ জানাল নেতাজির বিষয়ে এক চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি করতে।১৯৪৬ সালের মে-জুন নাগাদ তাঁরাও জানালেন- নেতাজি রাশিয়াতেই আছেন। আজও সেই রিপোর্ট ব্রিটিশ কমনওয়েলথ দফতরে গচ্ছিত আছে। পরবর্তীকালে সেই রিপোর্টেরই কপি বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে সংগ্রহ করেন প্রখ্যাত গবেষক ও ঐতিহাসিক ড. পূরবী রায়। ক্রমশঃ
Published on: জানু ২৪, ২০২১ @ ১২:১৩