‘সবার দ্বারা গেরুয়া হয় না। গেরুয়া তারাই পরে যারা গেরুয়াকে সম্মান দিতে জানে।’
‘মিডিয়া বিজেপির পকেটে চলে গেছে। আপনি মরে গেলে মিডিয়ার কাছে বিচার পাবেন না।’
বাংলার মনীষিদের পায়ের তলায় দাঁড়িয়ে বলছি- ‘দরকার হলে আমাকে মেরে দিন আমার কিচ্ছু চাই না।’
‘একটা প্ল্যান চলছে বাংলাকে গুজরাট বানিয়ে দেওয়ার।’
Published on: জুন ১১, ২০১৯ @ ২১:০৩
এসপিটি নিউজ, কলকাতা, ১১জুন: এক মাসেরও কম সময়ে কলকাতায় বিদ্যসাগর কলেজে ভেঙে ফেলা পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নতুন মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যবস্থাপনায় এই মূর্তি বসানো হল কলেজে। এই উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। যেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন বাংলার বিশিষ্ট মানুষজন। আর এই মূর্তি স্থাপনের অনুষ্ঠানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিজেপির পাশাপাশি সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধেও নিজের ক্ষোভ উগরে দিলেন। সেই সঙ্গে বাংলার সংস্কৃতিকে বাঁচাতে রাজ্যের সমস্ত শ্রেণির মানুষকে জোট বাঁধারও আহ্বান জানালেন তিনি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন-“ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে দিয়ে বর্ণপরিচয়কে মুছে ফেলা যায় না। রাজা রামমোহন রায়কে দুটো গালাগালি দিয়ে তাকে মুছে ফেলা যায় না।যারা এসব করছে আমি জেসাস ক্রাইস্টের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলি- ঈশ্বর ওরা জানে না ওরা কি করছে, ওদের তুমি ক্ষমা করো। এটা তো এমন নয় যে একটা বাচ্চা না জানা অবস্থায় ভেঙে দিয়েছে। একটা বাচ্চা ভেঙে দিয়েছে বেচারা জানে না। একটা বাচ্চা কাচের গ্লাস ভাঙলে তাকে আমরা চড়-থাপ্পড় মারি। আর বুড়ো খোকারা যখন ভাঙে তখন কি করতে হয়! তখন নতুন করে চিন্তা করতে হয়। এটা ভাঙা নয়, আমাদের কৃষ্টিকে আঘাত করা। আমাদের সংস্কৃতিকে আঘাত করা। আমাদের জাগরণে আঘাত করা। আমাদের নবজাগরণে আঘাত করা। বাংলার মননে-দর্শনে-চিন্তনে বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি-সভ্যতা বাংলাটাকে গুলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা।”
চারজন মনীষির ব্রোঞ্জের মূর্তি গড়া হচ্ছে
“আজকে আমরা একটা ছোট্ট কাজ করেছি। আম সেদিন নিজে দেখতে এসছিলাম। এরপর আমরা ঠিক করেছি আরও চারটে ব্রোঞ্জের মূর্তি গড়ব। বিশাল মূর্তি গড়তে আমরা পারব না। কারণ, চার হাজার আট হাজার কোটি টাকা দিয়ে মূর্তি গড়ে জায়গাও যা লাগে জমিও যা লাগে তাতে হৃদয় দিয়ে স্পর্শ করা যায় না। আমরা যেটুকু করব হৃদয় দিয়ে স্পর্শ করে ছোঁব। আমরা কলেজ স্ট্রিটের এই জায়গাটাকে ঘিরে যেখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আছে, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, বিদ্যাসগর কলেজ আছ্ হেয়ার স্কুল অনেক কিছু আছে- আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সামনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিদ্যাসাগর কলেজের সামনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ব্রোঞ্জের মূর্তি বসাবো। আর একজন নজরুল ইসলাম। কারণ, রবীন্দ্র-নজরুল বাদ দিয়ে বাংলার চেতনা, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার কৃষ্টি চলে না। এই চারটি ব্রোঞ্জের মূর্তি আমরা বানাতে দিয়েছি।” বলেন মমতা।
বিজেপিকে দুষলেন মমতা
এরপর ক্ষোভে ফেটে পড়েন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেন- “আমি বিজেপি নই। আমায় কথাগুলো বলতে হচ্ছে সরি- এখানে বলা হয়তো উচিত ছিল না। আপনারাই তো করেছেন। আজকে যিনি হোম মিনিস্টার তার র্যালি ছিল সেদিন। কেন আপনারা ভ্যান্ডালিজম করলেন।কেন আপনারা বিদ্যসাগরের মূর্তি ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। তারপর বললেন ফেসবুকে করেননি। সব ডকুমেন্ট আছে। গেরুয়া ঝান্ডা রামকৃষ্ণ মিশনও পরে, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ পরে। সংস্কৃতি কলেজের অধ্যাপকও পরে আছে। সবার দ্বারা গেরুয়া হয় না। গেরুয়া তারাই পরে যারা গেরুয়াকে সম্মান দিতে জানে।
প্রশ্ন তুললেন-মূর্তি ভেঙেছে কারা?
আর মাথায় ফেট্টি বেঁধে কেউ যদি ভাবে- আমি আধুনিক কিছু একটা হয়ে গেছি ওইভাবে সংস্কৃতি বদল হয় না। শুনুন, আমরাও এখানে জিতেছিলাম ৩৪ বছর পড়ে। কার্ল মার্ক্সের মূর্তি আমায় ভাঙতে হয়নি। লেনিনের মূর্তি আমায় ভাঙতে হয়নি। আম্বেদকরের মূর্তি ভেঙেছিল কারা? মার্ক্সের মূর্তি ভেঙেছিল কারা? লেনিনের মূর্তি ভেঙেছিল কারা? তারা বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙবে, কখনও রাজা রামমোহন রায়কে গালাগালি দেবে। কখনও বাংলার সংস্কৃতিকে গালাগালি দেবে। কিন্তু এবার আমাদের একটু রুখে দাঁড়ানোর দরকার আছে। একটা মূর্তি ভেঙে দিয়ে গেছে তাই একে লাগিয়ে দিয়ে গেলাম এটাই শেষ কথা নয়। শেষ কথা একটা মূর্তি ভাঙার মধ্য দিয়ে আমাদের হৃদয়ে একটা চেতনার উন্মেষ হয়েছে, তবে কি আমাদের সংস্কৃতিটাকে ভেঙে দিচ্ছে। তবে কি আমাদের ভাষাটাকে ভেঙে দিতে চায়? তবে কি আমাদের জাগরনটাকে ভেঙে দিতে চায়? তবে কি বাংলাকে গুজরাট বানাতে চায়? এই কোশ্চেনটা আমার মাথার মধ্যে আসছে। অনেকের মধ্যে আসছে কেউ ভয়ে বলতে পারছে না।”
পরিষ্কার কথা এটাই- বাংলা গুজরাট নয়।গুজরাটের মানুষকে আমরা ভালোবাসি। দাঙ্গাবাজদের ভালোবাসি না। তাতে যদি আমায় জেলে যেতে হয় কি যায় আসে- অনেকেরই তো মার খেয়েছি জীবনে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চমকানি, ধমকানি। এসব দেখতে দেখতে রাতের পর রাত আমাদের ঘুমটাই নষ্ট হয়ে যায়।
উগরে দিলেন বাংলা সংবাদ মাধ্যমের উপর সমস্ত ক্ষোভ
“আমি কোনও মৃত্যুকে সাপোর্ট করি না বিশ্বাস করুন। একটা নির্বাচনে কয়েকটা সিট পেয়ে তাও কিভাবে পেয়েছে জানি না।সেগুলো আস্তে আস্তে বেরোবে ব্যাগ থেকে তো বেড়াল বেরোবে। তার মধ্য দিয়ে এই খুনোখুনি। আমার বাংলা কত শান্ত বাংলা। সেদিন সিনেমা জগতের একজন বড় অভিনেতা আমার বাড়িতে এসেছিলেন। দিল্লিতে গেছি আমায় জিজ্ঞাসা করছে কেয়া বাঙালি কা হর আদমি কা হাত মে স্টেইন গান হ্যায়? ওইসব চড়াচ্ছে বিজেপি। আপনারা বলুন তো- আমাদের মেয়েরা রাস্তায় বেরোবে। রাস্তাঘাট সব বন্ধ। সবার হাতে স্টেইন গান। আর যাদের বাংলাকে প্রোটেকশান দেওয়া উচিত বাংলার মিডিয়া তারা দেয় না। আই অ্যাম সরি টু সে- কোনও মিডিয়াই দেয় না। মিডিয়া বিজেপির একেবারে পকেট পুরে গেছে। মিডিয়া বিজেপির পকেটে চলে গেছে। আপনি মরে গেলে মিডিয়ার কাছে বিচার পাবেন না। কিছু করার নেই, বিজেপি সব মিডিয়া কিনে নিয়েছে।”
চক্রান্তের অভিযোগ তুললেন মুখ্যমন্ত্রী
“ইন্সটিটিউশন বিচারালয় আমি আর কিছু বললাম না। যে যে জায়গাগুলোতে বিচার পাওয়ার দরকার সবই যদি বন্ধ হয়ে যায় মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এটা মাথায় রাখবেন। এটা একটা বড় চক্রান্ত। যারা ভেঙেছে তাদের কোনও আফশোষ নেই। তারা বলে দিচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস ভেঙেছে। তৃণমূল কংগ্রেস ভাঙলে তাদের থাপ্পড় দিতাম- এত সাহস জয় কি করে? আমার পার্টিটা আমার কন্ট্রোলে। যে কোনও রাজনৈতিক দলের কাজ হচ্ছে আগে সামাজিক ভিত তৈরি করার আগে মানবিক ভিত তৈরি করা। আগে মানুষ তৈরি হওয়া, আগে শিক্ষা-সংস্কৃতি জানা। তারপর একটা বাচ্চা মায়ের কোলে দুধ খাচ্ছে তাকে মেরে দিয়ে আসলাম এটা কোনও সংস্কৃতি নয়।”
খুন নিয়ে ক্ষোভ
“গতকাল রাতে দু’জন মুসলিমকে খুন করে দিয়েছে ভাটপাড়াতে। আজকেও সকালবেলায় গলসিতে একজন কর্মী খুন হয়েছে। তার আগে দিনহাটায় খুন হয়েছে আমাদের ছেলে। গলসিতে খুন হয়েছে আমাদের ছেলে। জগদ্দলে কাল আমাদের দু’জনকে খুন করেছে। দু’মাসের বাচ্চাকে খুন করে দিয়ে চলে আসছে।”
ক্ষোভ প্রকাশ রাজ্যপালের ভাষণের বিরুদ্ধেও
“রাজ্যপাল ইন্ডিয়া টুডেকে বললেন রাজনৈতিক ভাষন। আমি তাকে সম্মান করি। কিন্তু তাঁর ভাষণকে সম্মান করি না। প্রত্যেকের সংবিধানের একটা সীমারেখা আছে আমারও আছে। ১০জন মারা গেছে নির্বাচনের পর থেকে। তার মধ্যে আমাদের সাতজন। মনে রাখবেন ১০টি পরিবারকেই আমরা সাহায্য করব। কোনও মৃত্যুকেই আমরা সমর্থন করি না।”
জোট বাধার আহ্বান মুখ্যমন্ত্রীর
কিন্তু কেন এ জিনিস হবে।বাংলাকে বদনাম করা হচ্ছে। প্ল্যান করে করা হচ্ছে। আমি বাংলার মনীষিদের পায়ের তলায় দাঁড়িয়ে বলছি- দরকার হলে আমাকে মেরে দিন আমার কিচ্ছু চাই না, আমি জীবনে লড়তে লড়তে এই জায়গায় এসেছি। আমার এতে দয়া-মায়া নেই নিজের জন্য। আমি নিজের জন্য কোনও কাজ করি না। আমার সবটাই মানুষের জন্য। আমার এক সেকেন্ড লাগবে ছাড়তে।আমি শুধু বাংলাকে ভালোবাসি। বাংলার সাহিত্যিক, শিল্পী, চলচ্চিত্র কবি থেকে শুরু করে সকলে জোট বাঁধুন। বাংলাকে যদি বাঁচাতে চান বাংলার সংস্কৃতিকে যদি বাঁচাতে চান তবে জোট বাঁধুন। একটা প্ল্যান চলছে বাংলাকে গুজরাট বানিয়ে দেওয়ার। বাংলা গুজরাট নয়। আর গুজরাটও বাংলা নয়।”
উত্তরপ্রদেশে গত সাত দিনে ২৫জন যাদব খুন হয়েছে। অনেক বাচ্চাকে খুন করেছে কেউ জানতে পারছে। একটা কাগজে বেরোবে না। ফেসবুক, ফেকবুক, হোয়াটস্যাপ হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে।
ক্ষমাপ্রার্থী মুখ্যমন্ত্রী
বিদ্যাগরকে নিয়ে যে বর্বরতা প্রদর্শন হয়েছে তাতে আমরা লজ্জিত, আমরা মর্মাহত। আমরা ক্ষমা চাইছি। এই লজ্জা ডাকবার জায়গা নেই।
বিদ্যাসাগরকে সম্মান
“বিদ্যাসগর কলেজে মিউজিয়াম করে দবে। রাজ্য সরকারের কাছ থেকে ওদের এক কোটি টাকা দিচ্ছি। ১৮৮২ ঘাটাল বিদ্যাসাগর উচ্চ বিদ্যালয় হেরিটেজ বইদ্যালয় হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। সেটা বিদ্যাসাগর মহাশয় ৫০০টাকা দান করেছিলেন। সেটার জন্যও ৫০ লক্ষ টাকা সরকার দিচ্ছে। বীরসিংহ গ্রামে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বসতবাটি হেরিটেজ বিল্ডিং হিসেবে ঘোষণা করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গিয়েছে। এছাড়াও বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত বীরসিংহ ভগবতী বিদ্যালয় তাকেও হেরিটেজ বিল্ডিং করে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হল। বাদবাকি কাজগুলো আমরা ২০০ বছর উপলক্ষ্যে করে দেব।” বলেন মমতা।
Published on: জুন ১১, ২০১৯ @ ২১:০৩