পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় যে কথাগুলি বললেন

Main রাজ্য
শেয়ার করুন

  • আজ থেকে ১৩২ বছর আগে ১৮৮২ সালের আজকের দিনে ১১ইজুন বাদুরবাগানে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ গিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করতে।
  • ঠাকুর বললেন-“যার ভিতরে এত প্রেম, যার ভিতর অন্যান্য মানুষের চোখের জল অনবরত ঝরছে, সেই মানুষটি কি নোনা জলের সমুদ্র হয়! তুমি তো ক্ষীর সমুদ্র।”

Published on: জুন ১১, ২০১৯ @ ২৩:৪৪

এসপিটি নিউজ, কলকাতা, ১১জুন: কলকাতায় বিদ্যাসাগর কলেজে পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নব নির্মিত মূর্তি স্থাপনের অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন প্রখ্যাত সাহিতিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়।স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংদেবের সঙ্গে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের সাক্ষাতের বিষয়টি তুলে ধরেন। একই সঙ্গে তিনি স্বামীজীর কথা টেনে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের কাজের দিকটি তাঁর মহানুভবতার বিষয়টি তুলে ধরে এক সহজ সরল প্রাঞ্জল ভাষায় নিজের কথা ব্যক্ত করেন। সংবাদ প্রভাকর টাইমস পাঠকের সামনে প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের সেই বক্তৃতার মূল বিষয় তুলে ধরল।

“স্বামী সুবীরানন্দজী একটু আগে একটি ঘটনার কথা বলেছেন। বাদুরবাগানে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ যাচ্ছেন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করতে। কি আশ্চর্য ব্যাপার ১৮৮২ সালের সে তারিখটি হচ্ছে আজকের তারিখ ১১ই জুন। তিনটে-সাড়ে তিনটের সময় তিনি দক্ষিণেশ্বর থেকে বেরোলেন সঙ্গে মাস্টারমশাই আছেন এবং আরও কয়েকজন আছেন। বিদ্যাসাগর মশাইয়ের গেটে গাড়িটি দাঁড়াল। তিনি ধীরে ধীরে নামলেন। পিছন পিছন সকলেই প্রবেশ করছেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের একটা ছোট্ট বাগান ছিল। কিন্তু সেটা খুব দারুন বাগান নয়। প্রয়োজনীয় কিছু ফুলের গাছের বাগান। তিনি তার ভিতর দিয়ে হেঁটে দোতলায় গেলেন। গিয়ে দেখলেন বিদ্যাসাগর মহাশয় ঘরের একটি কোনে একটি টেবিলের সামনে বসে আছেন।”

“ঠাকুরকে দেখে কিন্তু তিনি উঠে দাঁড়ালেন না। তাতে ঠাকুরের সঙ্গে যারা ছিলেন তাদের একটু মনক্ষুন্ন হয়েছিল। ঠাকুরই তাঁর কাছে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বললেন- বিদ্যাসাগর, তোমার কাছে এলাম। এতদিন খাল, বিল, ডোবা, নালা সবই দেখেছি। আজকে সাগরের কাছে এলাম। বললেন- খানিকটা নোনা জল নিয়ে যান। ঠাকুর সঙ্গে সঙ্গে যেন চাবুকের মতো বলে উঠলেন- এ কি কথা বলছো তুমি! তুমি কি নোনা জলের সমুদ্র! যার ভিতরে এত প্রেম, যার ভিতর অন্যান্য মানুষের চোখের জল অনবরত ঝরছে, সেই মানুষটি কি নোনা জলের সমুদ্র হয়! তুমি তো ক্ষীর সমুদ্র।” “এই কথাটি বললেন। বিদ্যাসাগর মশাই প্রথমে উঠে দাঁড়িয়েছেন- আজকের সেই দিনটি। ঠাকুর সেই দিন তিন-চার ঘণ্টা তাঁর কাছে ছিলেন। সন্ধ্যার আগে তিনি যখন বেরোচ্ছেন তখন বৃষ্টি এসেছে এবং দেখছেন তাঁর বাড়ির বাইরে গেটের কাছে একজন মাথায় পাগড়ি বাঁধা লোক দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণকায়। দেখেন বলরাম বসু। এ কি, বলরাম তুমি এখানে দাঁড়িয়ে! তখনকার দিনে কি ধরনের ম্যানারস মানুষ ফলো করতেন। ঠাকুর বললেন- তুমি ভিতরে গেলে না কেন? বললেন- বিদ্যাসাগর মশাই তো আমাকে ভিতরে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাননি, তাই আমি এখানেই দাঁড়িয়ে আছি। এগুলো হচ্ছে ইগোর ব্যাপার।”

“কথাটা হচ্ছে এই- আমরা অনেক মূর্তি ভেঙে ফেলতে পারি, কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির বহুবার বহুভাবে ভাঙা হয়েছে, কিন্তু আজও তা পুনর্গঠিত হয়ে জ্বলজ্বল করছে। তালিবানিরা আমাদের বামিয়ান বুদ্ধ মূর্তি ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে তাতে কি বুদ্ধদেব এই পৃথিবী থেকে কোনওদিন চলে যেতে পারবে? পারবেন না।”

“বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অনেকে বলছেন তিনি নাকি নাস্তিক। শ্রীম মাস্টারমশাই একদিন গিয়ে বললেন- আপনি নীতি কথা লিখেছেন প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ লিখেছেন কিন্তু ভগবানের কথা সে স্মপর্কে তো কোনও উপদেশ দেননি। তখন বিদ্যাসাগর মশাই বললেন- ও, আপনি জানেন না বুঝি! আমি খুব সাবধানে আছি।বললেন, ওই ধরো কেশব যখন মারা যাবে, তখন তো সে স্বর্গে যাবে এবার ভগবান যখন তাকে জিজ্ঞাসা করবেন যে তুমি এসব কি বলে এসেছো কেশব উত্তর দিতে পারবে না। তখন বলবে কুড়ি ঘা চাবুক লাগাও, বেত্রাঘাত করো। আর আমি তো এক পাশে দাঁড়িয়ে আছি। কেশব তখন বলছে- আমি কি করব বলুন, ওই বিদ্যাসাগর আমায় যা বলেছে আমি তাই লিখেছি। তখন সঙ্গে সঙ্গে বলবেন ওকে ৪০ ঘা চাবুক মারো। বেত লাগাও। তা ভাই আমি ধর্ম নিয়ে কাউকে উপদেশ দিতে চাই না। ধর্মের উপদেশ নিজের মনে সিঞ্চিত হবে। এবং মানুষ নিজের পথ নিজেই চিনে নেবে।”

“এই যে একটি মানুষ এই মানুষটিকে আমরা কি করে ভাঙবো? যত বার আমরা মূর্তি ভাঙবো ততবার তার মূর্তি আরও শক্তিশালী হবে। সারা পৃথিবী জুড়ে এক দল মানুষ তান্ডব করবে আর এক দল মানুষ সেই তান্ডবের শিকার হবে। বিদ্যাসাগর মশাই কতটা প্র্যাকটিক্যাল ছিলেন বর্ণপরিচয়টা হাতে নিলেই বোঝা যায়। প্রথমে দেখুন ‘অ’ দিয়ে অন্য কোনও প্রাণী পেলেন না- অ-এ অজগর আসছে তেড়ে।আমরা তার পেটে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। এরপর ‘আ’ -এ লিখছেন আ-এ এমটি খাব পেড়ে। তুমি বাগান-ঠাগান করো আমি তোমার মগডালে বসে আম খাই। আর তোমাকে আঁটি ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারি। আর পরের দিন সকালবেলায় এসে বলি- মেয়ের বিয়ে দেব বিদ্যাসাগর মশাই আমাকে দশটা টাকা দিন।”

“তারপর ইঁদুর ছানা ভয়ে মরে। ইঁদুর ছানা কারা। এটা তো তিনি নরেন্দ্রনাথকে দিয়ে বলিয়ে দিলেন। যে মরতে ভয় পায় সে-ই ইঁদুর ছানা।যে বিপদকে ফেস করতে পারবে না সে-ই হচ্ছে ইঁদুরের ছানা। ইঁদুরের ছানা দিয়ে তো জগৎ গঠিত নয়! স্বামীজী বলছেন সন্ন্যাস- সন্ন্যাস কাকে বলে জানো- সন্ন্যাস হচ্ছে মৃত্যুকে অঙ্গীকার- মৃত্যুপণ। মরণের জন্য আমি প্রস্তুত হয়ে সংসার ত্যাগ করে এই বসন ধারন করে আমি জনজীবনের জনপথে বনে ঘুরে ঘুরে বেড়াই। মানুষের দুঃখ দেখি।”

“তুমি তো ক্ষীর সমুদ্রে বিদ্যাসাগর, বলে ঠাকুর আবার বলছেন- বরুন রাজার কত সম্পদ কত সম্পত্তি তিনি জানেন না। তোমার ভিতরে কত সম্পদ তোমার ভিতর কি আছে সেটা তুমি কোনওদিনও জানতে পারবে না। যদি না আমি তোমাকে জানবার ব্যাপারে সাহায্য করি। শেষ কালটা এমন দাঁড়াল- তিনি তো জীবনপন করেছিলেন, বিধবার চোখের জল মুছিয়ে দেবেন। তিনি তখন দেশে গিয়ে দেখছেন একটি বালিকা বিধবা দেওয়ালে পিঠ দিয়ে তারই প্রতিবেশী বসে আছে তার চোখ ছলছল করছে। সেদিন ছিল একাদশী। বিদ্যাসাগর মশাই বলছেন যে তার ভাই এবং তার স্ত্রী ঘরে বসে চব্যচোষ্য ফলাহার করছে আম সহযোগে দধি সহযোগে। আমি সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এই বিধবাদের চোখের জল যতদিন না আমি মোছাতে পারছি ততদিন পর্যন্ত আমার এই বিদ্যাসাগর উপাধি এর কোনও মূল্য নেই।”

“বিদ্যাসাগর তিনি বিখ্যাত ভারতে। সমসাময়িক আরও কয়েকজন বিদ্যাসাগর ছিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর বলতে আমরা ঈশ্বরচন্দ্রকে বুঝি। যেমন স্বামীজী বলতে আমরা নরেন্দ্রনাথকে বুঝি। ঠাকুরকে বলতে আমরা যেমন শ্রীরামকৃষ্ণকে বুঝি। এই যে সারা পৃথিবীজুড়ে এক দল মানুষের উত্থান তা একটা বিশাল মূর্তি নাকি ভারতবর্ষের কোথায় স্থাপিত হয়েছে সেটা নাকি কয়েক হাজার ফুট উঁচু। তা ওই মানুষের তৈরি করা মূর্তি উঁচু হলে হবে না। আমার ভিতর আমার ছায়ায় আমার প্রতিচ্ছায়ায় আমার মধ্যে যে স্থিতি আছে আমি যদি মানুষের সামনে ধীরে ধীরে তা তুলে ধরতে পারি তখন আমি বুক ফুলিয়ে বলতে পারব তুমি নিয়ে এসো তোমার যা কিছু আছে আমাকে ভাঙার চেষ্টা করলেও আমাকে তুমি ভাঙতে পারবে না।”

“এইবার ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন বিদ্যাসাগর তুমি স্ব্যয়ম্ভু লিঙ্গ শিব কাকে বলে জানো? বললেন- আমার অত জানা নেই। বললেন সেটা হচ্ছে- এই যে দেখছো তারকেশ্বরের শিব উনি স্ব্যয়ম্ভু লিঙ্গ। এর শিকড় কাশীতে বারনসীতে ওখানকার মহাদেবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে। এদিকে কালীঘাট পর্যন্ত চলে গেছে। এই যে শিকড় মানুষের অবস্থান তার শিকড় এই মানুষের ভূমির উপর দিয়ে প্রসারিত হতে হতে এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছয় যখন তাঁকে উৎপাটিত করার চেষ্টা করলে সমূলে পৃথিবীটাই উৎপাটিত হয়ে যায়।তাতে তোমার ভাঙতে হয় ভাঙো গড়বার ইচ্ছা হয় গড়ে দেখো। কিন্তু তাকে ভাঙা যায় না।”

“শীর্ষেন্দুবাবু বলেছেন ভাবমূর্তিকে কি ভাঙা যায়? তিনি আমার ভিতরে আছেন। যখনই বুঝতে পারি আমার সঙ্গে তার চরিত্রের ম্যাচিং হচ্ছে না তখন আমি খুব সতর্ক হই। তখনই যেন উত্তেজিত উদ্বিগ্ন হই। কেন আমি তাঁর কাছাকাছি যেতে পারছি না। কাছাকাছি যেতে পারছি না বলে মালা পড়ানোর অধিকারও লাভ করিনি। তাঁর কাছে গিয়ে নিজে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে বলতে না পারি যে আমি সম্পূর্ণ পরিশ্রুত আমি সম্পূর্ণ সেই ভাবে ভাবিত যে ভাবে ভাবলে আমার চোখে জল আসে।”

“স্বামীজী বলছেন আমি সেই ভগবানকে মানি না যে ভগবান ক্ষুধার্তের মুখে একটা রুটি তুলে দিতে পারে। আমি সেই দিন পর্যন্ত পৃথিবীতে বারে বারে আসব যেদিন দেখব পৃথিবীর শেষ মানুষটি কাঁদছে না সে জীবনের উল্লাসে আনন্দে হাসছে। বিদ্যাসাগর মাশাইয়েরও সেই কথা ছিল- আমি বিধবা বিবাহ প্রবর্তন করব। আমি নারী শিক্ষার প্রবর্তন করব। আমি নিরক্ষরকে সাক্ষর করব। আমি একটা নতুন ভারত মানুষের সামনে হাজির করে দেব। সবাই তো নির্মিত জিনিসে থাকতে ভালোবাসে। কেউ কি নিজে তৈরি করে নিতে জানে? জানে না, সেই জন্যই তো আজকে আমাদের এত উদ্বিগ্ন হতে হচ্ছে এবং বারে বারে আমাদের আশাহত হতে হচ্ছে।বারে বারে দেখছি গঠন হচ্ছে আবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।”

“কিছু মানুষ এই যে অ-এ অজগর আ-এ আমটির মতো কিছু মানুষ পৃথিবীতে থাকবেই। এদের নিয়েই আমাদের কাজ করে চলে যেতে হবে। তখন কি বলতে হবে- আমি ভয় করব না ভয় করব না। দু’বেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না।”

“আমি যেন তোমাকে স্মরণ করে তোমাতে স্নিত হতে পারি। যেমন কৃষ্ণের পাশে কংস, যেমন মহাপ্রভুর পাশে জগাই-মাধাই। সকলেই থাকবে, এটাই পৃথিবী। এর মাঝ দিয়ে পথ করে চলতে হবে। হাতে যেন একটি আলো থাকে। সেটা হচ্ছে বিবেকের চৈতন্য দিক।”

Published on: জুন ১১, ২০১৯ @ ২৩:৪৪


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

+ 23 = 28