নৃসিংহদেবের আবির্ভাব তিথি উৎসবে মেতেছে মায়াপুরের ইসকন মন্দির, এক মহান উদ্দেশ্যে আবির্ভাব হয়েছিল শ্রীহরির এই অবতারের

এসপিটি এক্সক্লুসিভ দেশ রাজ্য
শেয়ার করুন

Published on: এপ্রি ২৭, ২০১৮ @ ২১:১৪

এসপিটি নিউজ, কলকাতা, ২৭ এপ্রিলঃ শনিবার থেকে শুরু হতে চলেছে মায়াপুর ইসকন মন্দিরে নৃসিংহদেবের আবির্ভাব তিথি উৎসব। মূল উৎসব হবে ২৯ এপ্রিল রবিবার। শনিবার সকালে শুরু হবে যজ্ঞ। বেলা দশটায় এই যজ্ঞ শুরু হবে। চলবে এক ঘণ্টা মতো। বিকেলে হবে অধিবাস। আর রবিবার বিকেলে নৃসিংহদেবের অভিষেক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। এ খবর দিয়েছেন মায়াপুর ইসকন মন্দিরের জনসংযোগ আধিকারিক রসিক গৌরাঙ্গ দাস।

বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের কাছে ভগবান নৃসিংহদেবের তাৎপর্য অনেক। নৃসিংহদেবকে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর অবতার মানা হয়। এক মহান উদ্দেশ্যে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল।অনেকেই সেই মহান উদ্দেশ্যের কথা জানেন না। আসুন তাহলে জেনে নি কি ছিল সেই মহান উদ্দেশ্য।

শ্রীমদ্ভাগবদ মহাপুরান অনুসারে জানা যায়, ব্রহ্মার মানসপুত্র সনক, সনাতন, সনন্দন ও সনৎকুমার নামে ঋষিরা বৈকুণ্ঠে হাজির হন। তারা সেখানে পৌঁছে দ্বারপাল জয় আর বিজয়কে শ্রীবিষ্ণুর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছের কথা বলেন। জয়-বিজয় তাদের অতি সাধারণ বালক মনে করে তাদের ইচ্ছায় বাধা দেয়। ক্রোধে ফেটে পড়েন সেই ঋষিরা। তারা জয়-বিজয়কে অভিশাপ দেন-তোমরা এইমুহূর্তে পাপাচারী অসুরযোনিতে জন্মগ্রহণ করো। সেই সঙ্গে তারা এও বলেছিলেন, তোমরা তিনজন্ম এই অভিশাপ ভোগ করে এই বৈকুণ্ঠে ফিরে আসবে। শ্রীবিষ্ণু ঋষিদের এই অভিশাপকে সম্মান জানিয়ে তাদের অভিশাপ নিয়ে কোনও কথা বলেননি। তিনি তাঁর এই ভক্তযুগলকে উদ্ধার করতে অবতার রূপে মর্ত্যলোকে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

এরপর দৈত্য মাতা দিতির পুত্র রূপে জন্ম হয়েছিল হিরণ্যকশিপু ও হিরণ্যক্ষের। এরাই জয় আর বিজয়। ঋষিদের অভিশাপে তারা হয়ে উঠেছিল প্রবল বিষ্ণু বিদ্বেষী। প্রথমে বরাহ অবতার রূপে হিরণ্যাক্ষকে বধ করে তাকে উদ্ধার করেছিলেন। এরপর বৈকুণ্ঠের আর এক দ্বারপাল জয় যে হয়ে উঠেছিল অসুরকুলের অধিপতি আর ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সে হয়ে উঠেছিল প্রবল বিষ্ণু বিদ্বেষী।

তার চার পুত্রের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিল প্রহ্লাদ। যে আবার ছিল প্রবল বিষ্ণু ভক্ত। তার কাছে ভগবান বিষ্ণু ছাড়া কিছুই ছিল না। তিনি সর্বত্রি ভগবান বিষ্ণুকে দেখতেন।তিনি বলতেন, শ্রীবিষ্ণুর নাম-রূপ-গুণ-মাহাত্ম্য শ্রবণ, নাম সংকীর্তন, শ্রীবিষ্ণুর লীলাস্মরণ, মনে মনে তাঁর পাদপদ্মসেবা, তাঁর পুজো, স্তোত্র পাঠ, দাস্যভাবে তাঁর কাছে সমর্পন, সখ্যভাবে প্রীতি স্থাপন ও তাতে শরণাগতি এবং শ্রীবিষ্ণুর প্রতি সমর্পনভাব এই নয় লক্ষণযুক্ত বিদ্যা দ্বারাই তাঁর বাস্তবতা অর্জন করা যায়। ভক্ত প্রহ্লাদের এই কথিত ভক্তিকে নবধা ভক্তি আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। শ্রীমদ্ভাগবদ মহাপুরান অনুসারে এই নবধা ভক্তির একটি পথেই শ্রীহরিকে লাভ করা সম্ভব।

এদিকে এসব কথা তার পিতা হিরণ্যকশিপুর কাছে ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠতে থাকে। এরই মধ্যে সে ব্রহ্মার বরে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ব্রহ্মার কাছে তিনি বর চেয়েছিলেন যে তাঁর সৃষ্ট কোনও প্রাণী মানুষ অথবা পশু, জড়, দেবতা অথবা দৈত্য নাগ কারোও হাতেই যেন তার মৃত্যু না হয়। ভিতরে-বাইরে, দিনে-রাতে, ব্রহ্মার সৃষ্ট এমন কোনও জীবের হাতে অস্ত্র অথবা শস্ত্র দ্বারা পৃথিবী অথবা আকাশে৩ কোথাও যেন তার মৃত্যু না হয়। ব্রহ্মা তার ইচ্ছে পূরণ করে সেই বর দিয়ে দেন। এরপর ক্রমেই অত্যাচারী হয়ে ওঠেন হিরণ্যকশিপু।

এরই মধ্যে আকাশবানী হল-এই দুরাচারী রাক্ষসের বিষয় আমি জানি। যেদিন সে তার শান্ত পুত্র মহাপ্রাণ ভক্ত প্রহ্লাদকে হত্যা করতে যাবে সেদিন আমি তাকে বধ করব। সেই দিন চলে এল। হিরণ্যকশিপুকে ভক্ত প্রহ্লাদ বললেন-হে দৈত্যরাজ, ব্রহ্মাদি দেবগণ, স্থাবর-জঙ্গম জগতে যা কিছু সবই শ্রীহরির বশীভূত। তিনি ত্রিভূবনের প্রভু। তাই আপনি তাঁর শরণাগত হন।একথা শুনে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে হিরণ্যকশিপু বলে ওঠেন-আমিই জগৎপতি। তুই তোর জগৎপতিকে দেখা। তুই তো বলিস তোর জগৎপতি সর্বত্র, তাহলে এই স্তম্ভে দেখা যাচ্ছে না কেন? বলেই হিরণ্যকশিপু যেই তাতে আঘাত করল তখন এক ভয়ংকর শব্দে চারিদিক কেঁপে উঠল। সেই স্তম্ভের ভিতর থেকে শ্রীহরি আবির্ভূত হলেন।তিনিই সেই নৃসিংহদেব। যাঁর রূপ সিংহ আর মানুষের মিশ্রণে গড়া।

ভগবান নৃসিংহদেব এরপর হিরণ্যকশিপুকে তুলে নিয়ে দ্বারপ্রান্ত পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে নিজের জঙ্ঘার উপর রেখে নখ দিয়ে ফালাফালা করে ছিঁড়ে ফেলে বধ করেন। আর নাড়িভুড়ি গলায় মালা করে পড়েন। এইসময় তাঁর দিকে কেউ তাকাতে পারছিলেন না, এতই ভয়ংকর হয়ে উঠেছিলেন শ্রীহরি। স্বয়ং মা লক্ষ্মীও তাঁকে শান্ত করতে ব্যর্থ হন। সবশেষে ভক্ত প্রহ্লাদ তাঁকে স্তব-স্তুতি করে শান্ত করেন।

ভক্ত প্রহ্লাদ শ্রীহরি নৃসিংহদেবকে বলেন-হে প্রভু, যে অসুরকে বধ করার জন্য আপনি আবির্ভূত হয়েছিলেন সে তো বধ হয়েই গেছে। আপনি ক্রোধ সংবরণ করুন। আপনার শান্ত আনন্দময় রূপ দর্শন করার জন্য সকলেই উদগ্রীব হয়ে আছেন। আপনার ভয়ংকর রূপ দেখে আমি ভয় পাইনি। আমি শুধু উগ্র কায়াত চক্রকেই ভয় পাই। আমার একান্ত কামনা যে আপনি প্রসন্ন হয়ে সকল জীবের পরম আশ্রয় ও মোক্ষস্বরূপ আপনার শ্রীপাদপদ্মে আমায় স্থান দিন।

এরপর নৃসিংহদেব শান্ত হন। তিনি ভক্ত প্রহ্লাদকে বলেন, হে অসুরশ্রেষ্ঠ সৌম্য প্রহ্লাদ!আমি তোমার প্রতি প্রসন্ন। তোমার কল্যান হোক। তুমি আমার কাছে বর প্রার্থণা করো। ভক্ত প্রহ্লাদ তখন বলেন, হে প্রভু, আজন্ম আমি বিষয়ভোগাসক্ত, আমাকে বরদানের দ্বরা প্রলোভিত করবেন না। আমি আপনার শরণাগত হয়েছি। আপনাকে প্রণাম, আপনি সকলের অন্তরেই বিরাজ করেন। আপনি উদার শিরোমণি, পরব্রহ্ম পরমেশ্বর। নৃসিংহ রূপধারী শ্রীহরির চরণে প্রণাম নিবেদন করি। এরপর তিন নৃসিংহদেবের কাছে পিতার মুক্তির বর চান। তখন শ্রীহরি ভক্ত প্রহ্লাদকে আশ্বস্ত করে জানান, তোমার পিতা অচিরেই মুক্তি লাভ করেছে। তোমার মতো কুলপবিত্রকারী পুত্র লাভ করে পূর্বাপর একুশ পুরুষ সহ তিনি মুক্তির অধিকারী হয়েছেন।

এভাবেই হিরণ্যকশিপু শ্রীহরির দ্বারা উদ্ধার হয়ে বৈকুণ্ঠে নিজের স্থানে ফিরে যান।ঋষিদের অভিশাপ মুক্ত হন বৈকুণ্ঠের দ্বারপাল জয়। এমনটাই ছিল নৃসিংহদেবের আবির্ভাবের মহান উদ্দেশ্য। এরপর থেকে সেই দিনকে আজও নৃসিংহদেবের আবির্ভাব তিথি হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে।ভক্তবৎসল শ্রীহরির অবতার নৃসিংহদেবের জয় হোক।

Published on: এপ্রি ২৭, ২০১৮ @ ২১:১৪

 


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

7 + 1 =