তারাপীঠের ‘শ্রেষ্ঠ’ স্থান উদয়পু্রে সুপ্রাচীন কালীমায়ের মন্দি্রের ইতিহাস আজও অজানা বহু মানুষের কাছে

Main দেশ ধর্ম ভ্রমণ রাজ্য
শেয়ার করুন

Published on: নভে ১২, ২০২৩ at ১৬:৪৯
Reporter: Aniruddha Pal

এসপিটি নিউজ, তারাপীঠ, ১২ নভেম্বর: আমাদের বাংলায় আজও এমন অনেক সুপ্রাচীন কালীমায়ের মন্দির আছে যার ইতিহাস আমাদের অনেকেই জানি না।সুপ্রাচীনকালের সেসব কালীমন্দির বা শক্তিপীঠ আজও রয়ে গিয়েছে প্রচারের অন্ধকারে। তেমনই একটি হচ্ছে তারাপীঠের অদূরে উদয়পুরে কালীমায়ের মন্দির। যে মন্দির ও মূর্তিকে ঘিরে জড়িয়ে আছে বশিষ্ঠ মুনি এবং বামাক্ষ্যাপাবাবার নাম।রয়েছে এর এক অদ্ভূত ইতিহাস। কালীপুজোর আগের দিন শনিবার পৌঁছেছিলাম উদয়পুরে কালীমায়ের মন্দিরে। সেখানেই দেখা হয়েছিল মন্দিরের পুরোহিত স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সংবাদ প্রভাকর টাইমস-কে জানালেন উদয়পুরে কালীমায়ের ইতিহাস।

উদয়পুরে কালীমায়ের মন্দিরের পুরোহিত

উদয়পুরে কালীমায়ের মন্দিরের পুরোহিত স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন- “আমরা তিন পুরুষ আমি আমার বাবা এবং আমার দাদু এই মন্দিরে পুজো করে আসছি। এই যে দীপান্বিতা কালীপুজো- বাংলা কথা হচ্ছে ইষ্টদেবী কালীতারা। আগে কালী তারপর তারা।কারণ তারাপীঠের সব পান্ডা সবাই কিন্তু এই মন্ত্রে দীক্ষিত। এই অমাবস্যায় সবচেয়ে বড় করে পুজো পাঠ হয়। প্রচুর বলিদান হয়। প্রচুর লোকের সমাগম হয়।”

উদয়পুরের সঙ্গে বামাক্ষ্যাপাবাবার এক নিবিঢ় সম্পর্ক

এই উদয়পুরের সঙ্গে বামাক্ষ্যাপাবাবার এক নিবিঢ় সম্পর্ক রয়েছে।, সেকথা উল্লেখ করতে গিয়ে পুরোহিত স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন- “প্রথমতঃ বামা ছিল ক্ষ্যাপা। সবাই কি বলত, বামা ক্ষ্যাপা। বামাক্ষ্যাপা সজ্ঞানেই থাকত শ্মশানে। মন্দিরেও যেত। ঠিক সময় যখন হয়ে গেল তখন তারা মা কি বললেন- তুমি উদয়পুরে যাও। তখন তিনি উদয়পুরে এলেন। উদয়পুরে এসে তখন তাঁর দীক্ষা হল। তখন ধ্যানে বসলেন। এখান থেকে ধ্যানে সিদ্ধিলাভ করে তারপর তারাপীঠ যান। তারপীঠের শ্রেষ্ঠ জায়গা এটা। এটা বহু পুরনো মন্দির। এর বয়স ঠিক কত এটা কেউ বলতে পারবে না। এখানে অন্নের ভোগ হয় না। ফল, মুড়কি, সুজি এসব ভোগ হয়।কিন্তু মায়ের কাছে যা প্রার্থণা করবে মা হয়তো সেটাই মঞ্জুর করবে।”

বামাক্ষ্যাপা ও রামকৃষ্ণ

“বামাক্ষ্যাপা সাধক বামদেব তখন ক্ষ্যাপা বোলে ওকে খুব মারধর করত পান্ডারা। একদিন ওর মনে ধিক্কার হল যে আর এখানে থাকব না। উনি চলে যান কাশি। কাশিতে কেউ অভুক্ত থাকে না। কিন্তু ও তিনদিন থাকল কিন্তু একটা দানাও কিন্তু পায়নি। ওখান থেকে গেল দক্ষিণেশ্বর। তখন রামকৃষ্ণ পিছন থেকে তাকিয়ে দেখছেন বামা দাঁড়িয়ে। তখন জিজ্ঞাসা করছেন- কি রে বামা, তুই এখানে। হ্যাঁ, আমি তোমার কাছে চলে এলাম। তখন রামকৃষ্ণ বলছেন- চলে এলি, খা। পেট ভরে ওকে খাওয়ালেন। একটা-দুটো দিন সেখানে রইলেন। রামকৃষ্ণকে বামা বলছে- আমি এখানে থেকে যাব। আমি এখান থেকে আর যাব না। তখন ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলছেন- শোন, বামা তুই চলে যা। তোর মা তোর জন্য অপেক্ষা করছে। তখন বামা বলে ওঠে- না, তোমার মা কত সুন্দর দেখতে। আমি এখানেই থাকব। কার্তিক মাসে অমবস্যায় আদেশ করেন- তোর ইষ্টদেবীর কাছে চলে যা। তখন ওখান থেকে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখছে সেই দক্ষিণেশ্বরের কালী। পিছনে তাকিয়ে বামা দেখে ঠাকুর রামকৃষ্ণ দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞাসা করছেন- কিরে বামা পেয়ে গেলি? বামা বলে ওঠে- সব পেয়ে গেছি। সেই থেকে দক্ষিণাকালীরূপে পূজিতা হয়ে আসছেন উদয়পুরে।

উদয়পুরে কালী মা দক্ষিণদুয়ারী আর তারাপীঠে তারামা উত্তরদুয়ারী

তীর্থভূমি তারাপীঠের লেখক ও সেবাইত প্রবোধ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সংবাদ প্রভাকর টাইমস-এর কাছে তুলে ধরলেন এক সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। “কালী আর তারা অভেদ দেবী হিসাবে বলা হয়েছে। চন্ডীতে বলা হয়েছে কালী আর তারার মধ্যে কোনও প্রভেদ নেই। তারাপীঠে আছে তারা মা। আর উদয়পুরে আছে কালী মা। তারামা বসে আছেন উত্তরদুয়ারী হয়ে। আর উদয়পুরে কালী মা বসে আছেন দক্ষিণদুয়ারী হয়ে। তারাপীঠে তারা মা উত্তরদুয়ারী। কালী সাধারণতঃ দক্ষিণদুয়ারী হয়। উদয়পুরে দক্ষিণদুয়ারী আছে।”

“কিন্তু তারাপীঠে তারামা উত্তরদুয়ারী কেন? উত্তরচীনাচার তন্ত্রে বলা আছে- যপেত তারা কালী পীঠে তারাপীঠে চ কালী। অর্থাৎ যদি কেউ তারাপীঠে এসে কালী সাধনা করে এবং উদয়পুরে এসে তারা সাধনা করে তাহলে সে মন্ত্রসিদ্ধ হবে। সেই কারণেই তারাপীঠের সেবাইত এবং পান্ডারা তারাপীঠ থেকে উদয়পুরে এসে কালীমায়ের কাছে তারা সাধনা করে। এখানকার পুরোহিত, সেবাইত এবং ভক্তবৃন্দ যারা থাকেন তারাপীঠে গিয়ে কালীসাধনা করেন। এটা হচ্ছে পরম্পরা। তারাপীঠের যেমন একটা ইতিহাস আছে উদয়পুরেরও সেরকম একটা ইতিহাস আছে।” বলেন প্রবোধবাবু।

এই সিদ্ধিলাভের জন্য তারাপীঠ আর উদয়পুর সমানভাবে জাগ্রত

সেই ইতিহাসের উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন-“আজ থেকে দীর্ঘ হাজার হাজার বছর আগে সেই রামায়নের সময় বশিষ্টকে তারাঅভিষ্টসিদ্ধ বলা হয়। সেই তারাকে যখন জয়দত্ত সদাগর কর্তৃক প্রতিষ্ঠা করা হয় সেখানে তারামায়ের পাশে কালীমাও অবস্থান করে দশ মহাবিদ্যার সনাতন দেবী হিসাবে। তারাপীঠে যেমন তারামায়ের পুজো হয় উদয়পুরে তেমনি কালীমায়ের পুজো হয়। এই চিরাচরিত প্রথা চলে আসছে। বামাক্ষ্যাপা আটলা গ্রামে সিদ্ধিলাভ করেছেন। তিনি তার সিদ্ধিলাভের মধ্য দিয়ে তারাপীঠকে যেমন জাগিয়েছেন, উদয়পুর পাশাপাশি থাকার ফলে উদয়কালী হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। পর্যটন মানচিত্রে এই স্থানটি এখনও সেভাবে আসেনি। তবে অদূরভবিষ্যতে আবার স্বমহিমায় উদয়পুর প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠবে। এর অতীত ইতিহাস সম্বন্ধে যদি ঘাটা যায় তাহলে দেখা যাবে তারাপীঠ মহাশ্মশনা ছিল ২০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে। সেখানে বহু পঞ্চমুন্ডির আসন ছিল। যেমন আসন ছিল তারাপীঠে। আসন ছিল মুণ্ডমালিনী তলাতে। আসন ছিল উদয়পুরে কালীমায়ের থানে। এখানে যেমন সাধক সিদ্ধিলাভ করেছেন বশিষ্টমুনি ওখানেও সিদ্ধিলাভ করেছেন। এখানে সাধক সিদ্ধিলাভ করেছেন প্রথম আনন্দনাথ। এখানে সিদ্ধিলাভ করেছেন রানী ভবানীর দত্তকপুত্র রামকৃষ্ণ রায়। ব্রজপতি কৈলাসপতি বাবা।মোক্ষদানন্দবাবা।সিদ্ধিলাভ করেছেন বামাক্ষ্যাপা বাবা। এই সিদ্ধিলাভের জন্য তারাপীঠ আর উদয়পুর সমানভাবে জাগ্রত।”

Published on: নভে ১২, ২০২৩ at ১৬:৪৯


শেয়ার করুন