SUNDAY HORROR: লেটুবাবুর মৌতাত

Main দেশ সাহিত্য
শেয়ার করুন

লেখকঃ সুমিত গুপ্ত

 

।।এক।।

বিকেলে পাড়ার চায়ের দোকানে ঢুকতেই লেটুবাবুর সঙ্গে দেখা। চোখ লাল, খাটো চুলগুলো খাড়া খাড়া কোটের ধুলো ঝাড়ার বুরুশের রোঁয়ার মতো উঁচিয়ে আছে। উনি বেরুচ্ছেন, আমিও ঢুকছি। এক্কেবারে মুখোমুখি ধাক্কা লাগার জোগাড়। চমকে উঠে বললাম, “আরে লেটুবাবু যে। বেরুচ্ছেন নাকি। এতো তাড়াতাড়ি!”

লেটুবাবু খাঁটি বর্ধমানিয়া স্টাইলে হাঁকার দিয়ে বললেন, “বেরুবো না ? ঘড়িতে কটা বাজ্যে? খেয়াল আছে?”

আমার হাতঘড়িতে এখন সবে পৌনে ছটা। এরই মধ্যে বাড়ি ফেরার কি আছে লেটুবাবুর । কাজের মধ্যে তো ওই ফুটকড়াই চিবুতে চিবুতে বাড়ির কেঠো তক্তায় বসে গোটা চারেক অপোগন্ড ভাইপোকে পড়ানো। মনে মনে ভাবলাম, ওই এক বড় দোষ লেটুবাবুর। ভীষণ ব্যাস্তবাগীশ আর বড্ডো মাথাগরম। চট করে রেগে যান, অবিশ্যি ঠান্ডাও হন চট করে। কোনকিছুতে একটু সবুর নেই।

বললাম, “কি বা এমন বেলা হলো! মোটে তো পৌনে সাতটা বাজে। কোনো দিন এরই মধ্যে এখান থেকে বেরোন আপনি? আজ যেই আমি দশ মিনিট লেট্ করেছি অমনি বাড়ি ফেরার তাড়া লাগলো আপনার? তা যাবেন তো যান। তবে আজ কিন্তু একটা নতুন টপিক ছিল!”

পনেরো বছর এই চায়ের দোকানে ঘর করছি লেটুবাবুকে নিয়ে । ওনার কোন রোগে কি ওষুধ সবই আমার জানা । আমার কথায় একেবারে ভিজে মুড়ির মতো মিইয়ে গেলেন লেটুবাবু । মিহি গলায় বললেন, “আর রাখো তোমার টপিক । এদিকে গতকাল আমার কি ঝক্কি যে গেলো , কি আর বলি ।এই বয়সে এসে এমন অদ্ভুতুড়ে অভিজ্ঞতা হবে ভাবতে পারিনি ভায়া ।”

চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসতে বসতে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন কি হলো আবার । কাল বিকেলেও তো কত গল্প হলো । ভট্চাজ এসেছিলো । মুড়ি তেলেভাজা আনা হলো, খাওয়া হলো । কোনো গন্ডগোল তো দেখিনি তখন আপনার মধ্যে ?”

মাথা ঝাঁকিয়ে লেটুবাবু বললেন, “আরে তখন দেখবে কি ! যা চিত্তির হয়েছে সে তো রাত্তিরে !!এখনো যেন বিশ্বাস হচ্ছে না !”

কোতুলপুর হাইস্কুলে মাস্টারি করেন লেটুবাবু । ইতিহাস পড়ান ।পুরো নাম পরেশচন্দ্র লেট । ইয়ার-দোস্তদের মুখে মুখে লেটটা “হ্রস্ব উ-কার” অন্ত পেয়েছে । তাতে অবিশ্যি লেটুবাবুর কোনো ব্যাজার নেই ।চায়ের দোকানের বন্ধুদের দেয়া এই মজলিশি নাম বেশ পয়মন্তই মনে হয়েছে পরেশবাবুর । স্কুল ফেরত প্রতি সন্ধ্যার এই আড্ডায় তাঁর খাতির প্রচুর ।কেউ না কেউ তাঁকে পালা করে ওমলেট কিংবা কাটলেট একটা কিছু খাওয়াবেই ।

মুফতে রোজ রোজ খাওয়ার লোক অবিশ্যি লেটুবাবু নন ।বিনিময়ে তিনিও বন্ধুদের গল্প শোনান । ইতিহাসের গল্প । ভদ্রলোকের পড়াশোনা অগাধ ।  লেটুবাবুর গল্পগুলোও তাঁরই মতো  জলজ্যান্ত । এই তো গতকালই। আমি একটা প্রসঙ্গ তুললাম, মানুষের জীবনে ভাগ্য বড় না কর্মফল। আমার তোলা টপিকের ঘাড়ে চেপে শুরু হলো লেটুবাবুর গল্প ।  মঙ্গোলিয়ার এক ছোট্ট বালক  “তিমুজিন” -এর বিশ্বত্রাস চেঙ্ঘিস খান হয়ে ওঠার আশ্চর্য আখ্যান । শুনতে শুনতে গা শিউরে ওঠে ।দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্ধর্ষ জুলু যোদ্ধাদের কিভাবে গ্যাটলিং-গান দিয়ে ঝাড়েবংশে সাবড়ে দিলো ইংরেজরা, সেই গল্প শুনছিলাম গত পরশু ।

তবে চায়ের দোকানে লেটুবাবুর যত কদর ইস্কুলে মোটেও ততটা নয় ।ছাত্ররা বাদে লেটুস্যারের লেকচারে বাহবা দেবার লোক সেখানে নেই ।  টিচার্স রুমে অন্যান্য স্যারদের কেউ লেটুবাবুর ইতিহাসবেত্তার কচকচি শুনতে চান না । তাই সেখানে নিজেকে গোড়া থেকেই গুটিয়ে রেখেছেন লেটুবাবু । সেধেবেজে জ্ঞ্যান জাহির করার স্বভাব তাঁর নেই । কিন্তু একেবারে বোবা সেজেই বা কাহাঁতক থাকা যায় । স্যারদের নানা কথাবার্তার জেরে মাঝেমধ্যে দু’একটা অসতর্ক মন্তব্য করে বসেন লেটুবাবু। আর যায় কোথায়। গুঁয়ে শালিক যেভাবে ওঁৎ পেতে সদ্য ডানা গজানো উইপোকা ধরে খায় ঠিক সেরকম লেটুবাবুর প্রতিটা কথা ধরে ধরে ঝাঁঝালো ফোড়ন কাটেন সায়েন্স টিচার রাশু মিত্তির। লেটুবাবুর যে কোনো সুচিন্তিত মন্তব্যের ছাল-চামড়া তুলে ডুগডুগি না বাজালে চলে না রাশুবাবুর। একে হাড়-বজ্জাত তার উপর এলাকার শিক্ষককুলের মুরুব্বি, দু’তিনটে ইস্কুল কমিটির গভর্নিং বডির মেম্বার এই রাসবেহারী মিত্তির । এমন জাঁদরেল শত্রুকে কুপোকাত করা লেটুবাবুর মতো মিনমিনে নিরীহ লোকের কম্মো নয়। শুরুর দিকে দু’চারবার ফোঁস যে করেননি তা নয়। তার ফল ভালো হয়নি।রাশুবাবুর সঙ্গে অসম তর্কযুদ্ধের মেয়াদ কোনোবারই মিনিট দুয়েকের বেশি গড়ায়নি। প্রতিবারই লাট খেয়ে ল্যাজেগোবরে হয়ে লড়াইয়ে পিঠটান দিতে হয়েছে লেটুবাবুকে। রাশুবাবুর তাঁর উপর কেন এতো রাগ তা মাথায় ঢোকেনা লেটুবাবুর। এই ক’দিন আগের কথা | টিচার্স রুমে বসে ভূগোল স্যার শাসমলমশাই অনুযোগ করছিলেন, “শিখবে কি !আজকাল ছেলেমেয়েদের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধটাই তো কমে যাচ্ছে ।”

লেটুবাবু সেই কথায় সায় দিয়ে শুধু বলেছিলেন, “শেকড় আলগা হচ্ছে শাসমলমশাই। তাই এই অবস্থা। অতীতকে সঠিকভাবে জানতে হবে , বর্তমানকে অতীতের সঙ্গে জুড়তে হবে। তবেই তো শিক্ষার শেকড়ে সংস্কৃতির মাটি লাগবে, ঐতিহ্যের জল পড়বে। শ্রদ্ধা তবেই তো জন্মাবে।”

অমনি রাশুবাবু বলে উঠলেন, “তা কে দেবে মাটি, জল? আপনি? ঘষা-মাজা সালতামামি আর কিছু রাজা-রাজড়ার কান্ডকারখানা  বেমক্কা মুখস্থ করিয়ে তো ছেলেদের বিদ্যা-বুদ্ধির শ্রাদ্ধ বাগিয়ে ছাড়ছেন ।শ্রদ্ধা আসবে কোত্তেকে শুনি ?”

শান্ত স্বরে লেটুবাবু প্রতিবাদ করেছিলেন, “শুধু কিছু সালতামামি আর রাজা-রাজড়াদের কীর্তিই ইতিহাস নয় রাশুবাবু ।ইতিহাস হলো সমাজের বিবর্তনের ইতিহাস,মানুষের ইতিহাস, তাদের লড়াই, ভাব, ভাবনা ভাষার ইতিহাস, সুখ-দুঃখ, আশাভঙ্গের ইতিহাস। সেসব তো রাতারাতি পাল্টাবার নয়। ইতিহাস পড়াতে গেলে সেসবও জানতে হয়। জানতে হয় আরো অনেক কিছু। নইলে জানা সম্পূর্ণ হয় না ।”

লেটুবাবুর মিমিক্রি করে রাশু মিত্তির বলে বসলেন, “আরে থামুন মশাই। জানা সম্পূর্ণ হয় না! কি আমার জানিয়ে রে। আপনার খালি বড় বড় কথা। আপনি কি জানেন মশায়? পড়াচ্ছেন তো ইতিহাস, তাই বেঁচে গেলেন এযাত্রা। গালগল্প মেরে চালিয়ে দিলেন। পড়াতেন যদি বায়োলজি, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথমেটিক্স, টের পেয়ে যেতেন জানা কাকে বলে। জানতে কত কষ্ট।”রাশু মিত্তিরের কথার মধ্যে এমন একটা খোঁচা ছিল যে চুপ করে যেতে গিয়েও পারলেন না লেটুবাবু ।

মৃদু হেসে বলেই ফেললেন, “আপনি তো জানেন। তা শোনান না একটু, জানা কেমন হয়। জীবনের সব হিসেবে কি ফিজিক্স কেমিস্ট্রি বায়োলজিতে মেলে রাশুবাবু?”

লেটুবাবুর মুখ থেকে এই কথাগুলোই যেন এতদিন শোনার অপেক্ষায় ছিলেন রাশুবাবু। সামনের টেবিলে রাখা একটা কাঁচের পেপারওয়েট ঘোরাতে ঘোরাতে তিনি বলতে থাকলেন, “এইটা জিজ্ঞেস করতে আপনি এতদিন লাগলেন লেটুবাবু? এই যে আপনি হাসছেন, আপনি জানেন এ কার কাজ? নিউরো ট্রান্সমিটার শব্দটা শুনেছেন কখনো? সেরেটোনিন , অক্সিটোসিন, এপিনেফ্রিন, এন্ডোরফিন এসব কি করে? খায় না মাথায় দেয়, জানেন আপনি?এই যে আপনি ডেলি দু-বেলা চক-ডাস্টার বাগিয়ে সিঁড়ি ভেঙে দোতলাতে ক্লাস নিতে যাচ্ছেন, গুনেছেন কোনোদিন কটা সিঁড়ি ভাঙেন প্রতিদিন? কত কিলো ক্যালোরি বার্ন হয় আপনার।মেটাবলিজম বোঝেন? কটা হাড় আছে আপনার দেহে বলুন তো? ২০৬টা। আপনার ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করুন না।ওরাই বলে দেবে। আচ্ছা, ক’টা মোট কব্জা ওগুলোর বলুন তো, কোনটার কি নাম ? কব্জায় কি থাকে জানেন ? সাইনোভিয়াল ফ্লুইড নাম শুনেছেন ? আপনার ওই যে বপু নিয়ে দিনরাত এখান-ওখান করছেন, কে বা কারা বইছে আপনাকে? তাদের নাম কি? খবর রাখেন? ট্যান্ডর বা অস্থি কন্ডরা কাকে বলে, দেখতে কেমন জানেন আপনি? ওই জিনিস ক’টা দেহে নিয়ে ঘুরছেন আপনি জানেন? ১৩২০ টা। আপনার লেকচারে কত আবেগ। আপনি জানেন কি ওই আবেগের নদীগুলোর নাম কি? ওরম নদী গোটা শরীরে আপনার ক’টা বইছে আপনি জানেন কী? ৭২০০০টা। লিখে রাখুন আপনার নোট বইয়ে। আজ বাড়ি গিয়ে বলবেন আপনার ভাইপোদের। আপনি নিজের শরীরের ইতিহাস-ভূগোল জানেন না, বিশ্ব ইতিহাস পড়াচ্ছেন।”এই বলে মুখ দিয়ে এমন একটা “ছোঁ!!” শব্দ করলেন, সেটা সরাসরি গিয়ে বিঁধলো লেটুবাবুর বুকে।

রাশুবাবুর কথাগুলো শুনতে শুনতে মুখের টাংরা শুকিয়ে গিয়েছিলো লেটুবাবুর। মনে হচ্ছিলো গায়ে-পিঠে হাজারখানেক শুয়োপোকা চরে বেড়াচ্ছে। সায়েন্সের নামে ছোটবেলা থেকেই ঘাম ছোটে লেটুবাবুর। কিছু কিছু আখরোট যেমন কোনো কিছু দিয়েই ভাঙা যায় না। সায়েন্সের বিষয়গুলো লেটুবাবুর কাছে বরাবরই সেই আখরোটের সমান। কোনো ক্রমে সেগুলো ম্যাট্রিক পর্যন্ত টেনেছিলেন। তারপর বিজ্ঞানের সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে মানে মানে অন্য দিকে সরে পড়েছিলেন তিনি। জোঁকের সঙ্গে নুনের যে সম্পর্ক, লেটুবাবুর সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্কও ঠিক তাই । সেজন্য সেদিন সবার সামনে রাশুবাবুর কাছে চরম অপদস্ত হয়েও মুখ নামিয়ে নিয়েছিলেন লেটুবাবু । কারো সঙ্গে একটাও কথা না বলে মনের দুঃখ মনেই চেপে বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি। ফেরার পথে বাবা জলেশ্বরের মন্দির পড়ে। খুব প্রাচীন মন্দির। লোকে বলে বাবা নাকি খুব জাগ্রত । বাবার থানে সেদিন না জানি মনে মনে কি ভেবে একটা পাথর ঝুলিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন লেটুবাবু।

।।দুই।।

ইস্কুলে যাই হোক পাড়ায় কিন্তু লেটুবাবুর জনপ্রিয়তা বাড়ন্তের দিকে । তাঁর গল্প শুনতে ইদানিং চায়ের দোকানে দস্তুরমতো ভিড় জমে । দেয়ালের টিকটিকিগুলো আরশোলা ধরা ভুলে যায় । আমাদের ঘিরে ধরা  চায়ের ছোট্ট টেবিলটা পাল্টে গিয়ে কখনো হয়ে যায় পানিপথ, কখনো থার্মোপোলী, কখনো হিদাপিস্, কখনো কলিঙ্গ আবার কখনো বা পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্র । গল্পগুলো আমরা শুধু শুনি না , গোগ্রাসে গিলি ।আর ভাবি, কত কি জানেন উনি । এই উচ্চমানের বিদ্যে-বুদ্ধি নিয়ে তিনি অনায়াসে বিদ্দজ্জনের সমাজে একজন কেউকেটা হতে পারতেন । তা না হয়ে কিনা ঘষা মাইনেতে বাংলা ইস্কুলে ছেলের পাল তাড়াচ্ছেন। একেই বলে ভাগ্য |তবে একটা জিনিস আবার এই লেটুবাবুর ধাতে আসে না । ভুত কিংবা অলৌকিকে তাঁর একেবারেই বিশ্বাস নেই । তাই ওসবের গল্পেও তিনি নেই । ভুতের প্রসঙ্গ উঠলেই তেলেবেগুনে ক্ষেপে ওঠেন লেটুবাবু । বলেন , “ওসব গাঁজাখুরি প্রলাপ শুনে কি হব্যে ? আমি যা শোনাবো তা খাঁটি ইতিহাস,শিক্ষণীয় । বইয়ের পাতায় প্রমান আছে ।”ভুতের গল্প শুনে বা শুনিয়ে সময় নষ্ট করতে তিনি নারাজ । সেই লেটুবাবুর কি হলো কাল রাত্তিরে ?

জিজ্ঞেস করলাম, “কি এমন হলো কাল রাতে? আপনার চোখ এতো লাল কেন ?শরীর গতিক খারাপ হয়েছিল নাকি ?”

নিমের পাঁচন খাওয়া মুখ করে লেটুবাবু বললেন, “যা হলো সে আর বলি কোন লজ্জায় ভায়া । ভুত, অলৌকিক নিয়ে কত ফাইট করেছি তোমাদের সাথে । কাল রাতে ওদেরই এক ব্যাটা এসে আমার কান-নাক মুলে দিয়ে গ্যাছে।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “সেকি !!”

এই বলে দু’হাত জোড় করে নিজের মাথায় একটা পেল্লাই পেন্নাম ঠুকে লেটুবাবু বললেন,”যিনি এসেছিলেন তাঁকে অবিশ্যি ব্যাটা না বলে বাবাজি বলাই ভালো।”

আমি প্রশ্ন করলাম, “কে তিনি ?”

কথার ফাঁকে গরম লিকার চা সুরুৎ করে এক চুমুক কাঁচা-পাকা গোঁফের তলা দিয়ে গলায় চালান করে লেটুবাবু বললেন, “তিনি যে কে, তা আমি এখনো জানি না। তবে তিনি যা শিকিয়ে গ্যাছেন তাতে আমার দর্পচূর্ণ হয়েছে। পেটের কিরমি মাথায় উঠেছে। এখন মনে হচ্ছে, আমি এই সবে গত কাল জন্মেছি। এতোকাল যা শিখেছি, পড়েছি, শিখিয়েছি, পড়িয়েছি সব ফালতু, আজেবাজে।”

লেটুবাবুর জবাবে আমার চোখ তো কপালে। বানানো কথায় আসর জমানোর লোক তো লেটুবাবু নন! বললাম, “বলেন কি —?”

লেটুবাবু বললেন, “তবে আর বলছি কি !”এতক্ষনে টেবিলের আশপাশে বাকি খদ্দেরদের ভিড় জমতে শুরু করেছে । দোকানের খুপরি জানালার ভাঙা পাল্লা গলে শুক্লা চতুর্দশীর লাল চাঁদ উঁকি দিচ্ছে লেটুবাবুর চোখের চশমার কাঁচে। রহস্যের হাসি হেসে তিনি বললেন,

ননদেরও ননদ আছে দিও না ননদ নাড়া

কুলোর মন্ত্রে বাতাস পাগল তুষের কর্ম সারা

লেটুবাবু হেঁয়ালি করছেন দেখে বললাম,”গতকাল রাতে কি হয়েছিল খুলে বলবেন কি ?”

টেবিলে একটা রাম থাপ্পড় কষিয়ে লেটুবাবু বললেন, “আরে সেইটা বলবো বলেই তো এতক্ষন ছটপট করছি।” তারপর একটু দম নিয়ে শুরু করলেন, “তুমি তো জানো,  দোতলায় আমার পাশাপাশি দুটো ঘর।একটা ড্রয়িং রুম কাম লাইব্রেরি , পাশেরটা শোয়ার। ঘুমুতে যাবার আগে প্রতিদিনই আমি ঐখানে কিছুক্ষন কাটাই |বইপত্র ঘাঁটি, পড়াশুনা করি। এ আমার দীর্ঘদিনের অভ্যেস। গতকাল রাত্তির আন্দাজ সাড়ে দশটা হবে। রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছি। ভাইপোরা নিচে শুতে চলে গ্যাছে। লাইব্রেরিতে মহাভারতের ওপর লেখা নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী মশায়ের একটা বই নাড়াচাড়া করছি। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের অভিশাপ আর মহারাজা যযাতির যৌবন ফিরে পাবার সেই গল্পটা আমি প্রায়ই পড়ি । গল্পে একেবারে ডুবে গিয়েছি, হঠাৎ ধূমপান করার ইচ্ছে জাগলো । লাইব্রেরি কিংবা শোয়ার ঘরে আমি ধূমপান করি না। শোয়ার ঘরের টেবিলে সিগারেটের প্যাকেট, দিয়াশলাই রাখা থাকে। সেগুলো নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠছি, হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেলো। যাহোক হাতড়ে হাতড়েই ছাদে উঠলাম। শুক্লপক্ষের রাত, আকাশটাও নির্মেঘ। তাই বিশেষ অসুবিধা হলো না। ছাদের দক্ষিণ দিকে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম।  দূরে পালেদের বাড়ির নারকেল গাছটাগুলোর মাথার উপর চাঁদ উঠেছে। সিগারেটে লম্বা লম্বা সুখটান দিচ্ছি আর সেদিকে তাকিয়ে যযাতির কথা ভাবছি। বেশ ফুর্তি ফুর্তি লাগছিলো। ছাদের উত্তর-পূর্ব কোণে একটা শান বাঁধানো বসার বেঞ্চি করা আছে। ভাবলাম ঐখানে গিয়ে এবার একটু আয়েশ করে বসি। যেই না সেদিকে ঘুরেছি অমনি বুকটা ধড়াস করে উঠলো। ওকি, ওটা ওখানে কি রে বাবা!! মানুষের মতো দেখতে একটা কিছু বেঞ্চির উপর গ্যাঁট হয়ে বসে রয়েছে মনে হচ্ছে ! চাঁদের ফিকে আলোয় যতটা সম্ভব দেখা যায়, ফের ভালো করে দেখলাম । শার্ট-প্যান্ট পরা একটা আস্ত লোক পাথরের মূর্তির মতো বসে রয়েছে । মাথাটা সামনের দিকে ঝোঁকানো । যেন গভীরভাবে কিছু ভাবছে । আমি এখান থেকে তার মুখের একটা অংশ দেখতে পাচ্ছি শুধু । টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো বাঁকানো নাক, ঝোলা পুরু ঠোঁট, সরু থুতনি। মনে হলো ওই চেহারাটা আমার মুখস্থ। আমার নাম পরেশ চন্দ্র লেট্ । ভুত-প্রেত এক ছটাকও মানি না। ভায়া বিশ্বাস করো, সেই আমারও কয়েক মুহূর্তের জন্য হাত – পা  ভারী হয়ে এলো। গলা শুকিয়ে কাঠ।বললাম, “ক্ক – কে ওখানে !!” লোকটা অমনি নিশ্চল। মনের যত সাহস আছে সব এক জায়গায় জড়ো করে আবার বললাম ,”শুনছেন ! কে আপনি !! এখানে কি –“, কথা শেষ হলো না লোকটা আমার দিকে ফিরলো । এইবার চমকে উঠে আমার হাত থেকে সিগারেটটাই পড়ে গেলো। মন থেকে সব ভয় উবে গিয়ে প্রচন্ড রাগ হলো। গলা চড়িয়ে বললাম, “একি, রাশুবাবু!এত রাতে আপনি এখানে! ছাদেই বা উঠলেন কখন, সদর তো আধ ঘন্টা হলো বন্ধ হয়ে গাচ্যে।” গমগমে গলায় লোকটা বললো, “আমি রাশুবাবু নই । সে এখন নিজের ঘরে বিছানায় নাক ডাকছে।”

কি আশ্চর্য, রাশুবাবুই বলছেন কিনা তিনি রাশুবাবু নন ?চেহারার এত মিল কারো সাথে কারো হয়?” জানতে চাইলাম, “তবে আপনি কে ?কোথায় নিবাস ?”

এবার লোকটা বেঞ্চিতে ঘুরে বসলো । তারপর বললো, “এই মুহূর্তে নাম-ধাম না জানলেও চলবে ।আসছি বহু দূর থেকে ।”

সন্দেহ জাগলো, লোকটা চোর-ডাকাত নয় তো ? চুরির মতলবে আগে থেকে ছাদে ঘাপটি মেরে লুকিয়েছিল। ধরা পড়ে গিয়ে এখন গল্প ফেঁদে পালাবার ফিকির খুঁজছে ।

জিজ্ঞাসা করলাম, “বেশ। তা কি কারণে আসা হয়েছে জানতে পারি?”

লোকটা বললো, “ভয় কাটাতে”।

আমাদের ছাদের বেঞ্চিটা অনেকটা লম্বা চওড়া। দু’জন মানুষ মুখোমুখি বসে দিব্বি আড্ডা দিতে পারে।

একটু বিরক্ত হয়েই প্রশ্ন করলাম, “কার ভয়, কিসের ভয়?”

এবার লোকটা বেঞ্চির ফাঁকা জায়গাটার দিকে ইশারা করে আমাকে বসতে বললো।

নিতান্ত অনিচ্ছা নিয়ে লোকটার সামনে গিয়ে বসলাম ।

সামনাসামনি বসে বুঝলাম, চেহারায় অবিকল রাশুবাবুর কার্বন কপি হলেও বয়সে তাঁর চেয়ে অনেক প্রবীণ।

এবার একটু নিশ্চিন্ত হওয়া গেলো, আর যাই হোক লোকটা চোর-ডাকাত নয়।

আমি বসতেই লোকটা বললো, “তুমি তো ইতিহাসের মাস্টার। ভালোই তো পড়াও শুনেছি। সাইন্সএ এতো ভয় কেন তোমার?”

এবার মনে হলো লোকটা ঠগ নয়তো! আমার ব্যাপারে সব খোঁজখবর জুটিয়ে বড়োসড়ো দাও মারার মতলবে এসেছে ।

ভয়ে ভয়ে আমি বললাম, “আমার সায়েন্সের ভয় কাটাতে আপনি এতো রাতে এদ্দুর ঠেঙিয়ে এসেছেন কেন?”

আগন্তুক বললো, “শোনো আমায় সন্দেহ করে নিজের ভালো করার সুযোগ হারিয়ো না। এমন সুযোগ কোটিতে একবার আসে। নিতে হয় নাও নয়তো আমি চললুম| নিতে নয় আমি তোমায় কিছু দিতে এসেছি।আর দিন- রাত্তির, কাছে-দূরে আমি এসবের ঊর্র্ধে।”

লোকটার কথায় খটখটে শুকনো বেঞ্চি হড়কে পড়েই যেতাম, লোকটা হাত বাড়িয়ে শক্ত করে ধরে আমায় সামলে নিলো। সেই সঙ্গে আমার মাথাটাও বোঁ করে ঘুরে গেলো ।

আমি একটু ধাতস্থ হতে লোকটা বললো, “রাশুকে একটা উচিত শিক্ষা দেয়া দরকার। অগভীর জলে সফরী ফড়ফড়ায়তে। ব্যাটার বড্ডো দেমাগ। তোমার সায়েন্সের ভয় আমি আজই কাটাবো ।”

লোকটার সহানুভূতিতে আমার মন গলে গেলো। তাই তো, লোকটা এতো ভিতরের কথা জানল কি করে?

মনে হলো, আমি বুঝি গেলাসের জলে ডুবন্ত ডেয়ো পিঁপড়ে আর সে যেন খড়কুটো ।

ধরা গলায় আমি বললাম, “সায়েন্স ! সে তো বড় শক্ত। ভয় কাটবে আমার!”

সে বললো, “অপাত্রে দান আমি কখনো করিনি। তুমি ইতিহাস পড়াও তো। সেও তো ফলিত সমাজবিজ্ঞ্যান। শক্ত লাগে?”

এ কথার কি জবাব দিই ভাবছি, লোকটা বললো, “আজকাল শুধু জানলেই হয় না। দশ জনের মাঝে কল্কে পেতে হলে বেহায়ার মতো নিজের ঢাক নিজেই পেটাতে হয় তা জানো না।”

আমাকে বোকার মতো মাথা নাড়তে দেখে আগন্তুক বললো, “ওই ছেলেগুলোকে দেখো। ওরাও কি জানে ওদের মধ্যেও কেউ কেউ একদিন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হবে? জানে না। তবু প্রানপণ চেষ্টা করছে। বাড়িঘর ছেড়ে আমার ফাইফরমাশ খাটছে। হোয়েওছে দু’একজনে। তোমাদের ইতিহাস বইয়ে, গবেষণা গ্রন্থে – ট্রন্থে সেই নাম আছে। আজ না থাকলেও কাল থাকবে।”এই বলে লোকটা ছাদের পশ্চিম কোনে চক্কত্তিদের চালতাবাগানের দিকটায় আঙ্গুল তুলে দেখালো ।

কি বলবো ভায়া, বলতেও গায়ে কাঁটা দেয়, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে আমার তো আক্কেল গুড়ুম ।

ওদিকটায় আমার ভাইপোরা ক’দিন আগেই ওদের ক্লাবের কিছু পুরোনো ভাঙা কাঠের আসবাব ডাই করে রেখেছিলো । এখন দেখি সব ফর্সা।ওই জায়গায় খুপরি খুপরি ঘর কয়েকটা। সেগুলোয় টিমটিম করে তেলের প্রদীপ জ্বলছে ।

সেই আলোয় হুমড়ি খেয়ে জনাছয়েক বাচ্চা ছেলেমেয়ে কি সব পুঁথি পড়ছে আর লিখছে ।ওদের সবার মাথা মোড়ানো, একটা করে লম্বা টিকি, পরনে সাদা রঙের পট্টবস্ত্র। এতসব কোত্থেকে এলো, কখন এলো? কই, ছাদে ওঠার সময় ওদিক দিয়েই তো আমি এলাম, তখন তো কিছু দেখিনি? মাথার ভিতরতা টনটন করে উঠলো । লোকটা কি তবে ভেলকিও জানে?

ঘাড় ফিরিয়ে আমি লোকটাকে শিশুর মতো প্রশ্ন করলাম, “আমার ছাদে ওটা কোন জায়গার সেট?ওরা কারা ?”

লোকটা বললে, “গেরো দেখছি । এতো প্রশ্ন তোমার? বেশ শোনো তবে। ওটা তোমার ছাদ নয়।আমার ল্যাবরেটরি। জায়গার নাম নাগালওয়াডি।বিধর্ব।মানে তোমরা এখন যাকে মহারাষ্ট্র বল। ছেলেমেয়েগুলো সব আমার স্টুডেন্ট।”

কথাগুলো শুনে, দিব্বি করে বলছি ভায়া, আমার দু’হাত আপনিই বুকের কাছে জোড় হয়ে গেলো ।

কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি কে?”

আমার কথায় আমল না দিয়ে আগন্তুক হাঁক দিলো, “কটুতিক্তক, আমার সবে লেখা পুঁথিগুলো এদিকে দিয়ে যাও তো ।”

বছর বারোর একটি ছেলে ওদের মধ্যে থেকে উঠে একটা বড় খুপরির খোপ হাতড়ে পেল্লাই একটা জাব্দা খাতা তুলে বগলদাবা করে নিয়ে এসে বেঞ্চিতে ধপাস করে রেখে গেলো । চাঁদের আলোয় দেখলাম প্রায় হাত দেড়েক চওড়া আর ইঞ্চি খানেক লম্বা সেটা| জিনিসটাকে বই না বলে ম্যানুস্ক্রিপ্টবলাই ভালো । কলেবরে কাশীরাম দাসের মহাভারতকেও লজ্জা দেবে। পাতাগুলো সব তালপাতার। সেগুলো খানিক্ষন একটু উল্টে পাল্টে দেখতেই মনের সব খটকা উধাও হয়ে গেলো। এ লেখা তো আজকের নয়। যে লিপিতে এ পুঁথি লেখা তা ভারতবর্ষে নাগরী লিপি চালুরও আগেকার। চক্রাকারে লেখা এ লিপির নাম “কুটিল” লিপি। অন্তত হাজার বছরের পুরোনো। দীর্ঘদিনের অনভ্যেস, তবু বারকয়েক চেষ্টা করে প্রথম পাতায় বড় বড় হরফে করে লেখা শব্দটা পড়ে ফেললাম। বাংলা করলে দাঁড়ায় “সঞ্জীবিনী সিদ্ধান্তসমুচ্ছয়”। এই বলে বই থেকে মুখ তুলে ফ্যাল ফ্যাল করে আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে আছি।

সে মুচকি হেসে বললো, “কিছু বলবে?”

জিজ্ঞাসা করলাম, “এ বই আপনার লেখা? আপনি কি প্রফেসর, মানে আচার্য।”

মাথা নেড়ে আমার কথায় সায় দিয়ে সে বললো, “তবেই বোঝো ভুল লোকের কাছে আমি আসিনি।”

আমি আর জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না, “কি নিয়ে লেখা এ বই?”

আমার কথার সোজাসুজি জবাব না দিয়ে আচার্য বললেন, “তুমি কিছুক্ষন আগে মহারাজা যযাতির কাহিনী পড়ছিলে না। এ বইয়ে আছে অনন্ত জীবন আর যৌবন ফিরে পাবার রহস্য। আমার ও আমার গুরুকুলের বহু যুগের অক্লান্ত গবেষণার ফসল এ বই। তবে এ বইয়ের সন্ধান এখনো কেউ জানেনা। স্বয়ং রাষ্ট্রকূট সম্রাট আর জনাকয় রাজ্ আমাত্য ছাড়া।”

আমি মিনমিন করে বললাম, “আমাদের কালেও এজিং নিয়ে অনেক এগিয়ে গেছে বিজ্ঞান।রাশুবাবু বলেন, জিন সিক্যুয়েন্সিঙ না কি যেন আবিষ্কার হয়েছে। আর কিছুদিন অপেক্ষা । তাহলেই নাকি জিন থেরাপিস্টরা—”

আমার কথা লুফে নিলেন আচার্য, “জিন এডিট করে টেলোমিয়ারেজের (বার্ধক্যের) জন্য দায়ী বিসিএটি১ গ্রূপের জিন এক্সপ্রেশনগুলোকে সি-আর আরএনএর এজেন্টের কাঁচি দিয়ে কুচ করে ছেঁটে ফেলবে, আর তোমরাও সঙ্গে সঙ্গে সব অমর হয়ে যাবে তাইতো ?”

আমি মাথা চুলকে বললাম, “হ্যাঁ, রাশুবাবু সেরকমই কিছু একটা বলেছিলেন বটে ।”

আচার্য বললেন, “সে গুড়ে বালি ।এতো সহজ নয় ।জিন এক্সপ্রেশন হা-ডুডু খেলার জিনিস নয় । বিপদে পড়বে তোমরা, ঘোর বিপদে ।এই জন্যই বলে, কানা গরুর ভিন্ন পথ।অহংকার জ্ঞানকে খর্ব করে । তোমরা আজ পর্যন্ত ক’টা জিন এক্সপ্রেশন খুঁজে পেয়েছো শুনি । মেরে কেটে তিন লক্ষ ! আমাদের ওই বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো খুঁজে পেয়েছে ১২ অর্বুদ, তাও খালি হাতে । তোমরা বল জিন এক্সপ্রেশন, আমরা বলি তন্ত্রসার । আলাদা আলাদা জীবতত্ত্ব মিলিয়ে নতুন জীবতত্ত্ব তৈরির কায়দা তোমরা সবে শিখছো,আর ওসব আমাদের পাঠশালায় পড়ানো হয় । তোমরা বল, জিন ওভারল্যাপিং , আমরা বলি তন্ত্র অনুপ্রাশনম। এই যা তফাৎ ।তোমরা এটম বোমা বানিয়েছো।তাকে নিমেষে নিস্তেজ করতে শেখোনি । সূর্যের তেজ কাজে লাগিয়ে তোমরা টিকে আছো। সূর্য নিভে গেলে কি করবে ? আমাদের ছাত্র ছাত্রীরা তার উপায়ও বের করেছে। তোমাদের কল্পবিজ্ঞানীরা যার নাম দিয়েছে ক্যাপসুল টেকনোলজি ।তোমরা সেল টেকনোলজি, ইন্টারনেট, কম্পিউটার স্ক্রিন এ সফটওয়্যার সিমুলেশন ব্যবহার করো ।আমাদের জ্ঞানবৃদ্ধ আচার্যরা মহাব্রহ্মসত্বে নিজেদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, মেধা, চৈতন্য সবকিছু বিলীন করে বোধিসত্ত্ব লাভ করেন। যখন খুশি নিজেদের ইচ্ছে মতো বাস্তবতা তৈরী করেন।স্থূল দেহের দরকারই হয় না।তোমাদের বিজ্ঞানীরা সবেমাত্র যাকে মেটাভার্সাল ইন্টেলিজেন্স আপলোড নামে ভাবতে শিখছে । টাইম ট্রাভেল তো দূর-অস্ত । তোমরা আজ সবে ডার্ক ম্যাটার, ডার্ক এনার্জি, ওয়ার্ম হোল,  এক্সটিক ম্যাটার এসব নিয়ে মাথা ঘামানো শুরু করেছো ।  আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছে ওসব জলভাত । এরকম আর কত বলবো! ওই দেখো– ” এই বলে এবার ছাদের পূর্ব দিকে আঙ্গুল তুললেন আচার্য ।

এতক্ষন মন্ত্রমুগ্ধের মতো আচার্যের কথা শুনছিলাম । এবার তাঁর শেষ কথাগুলো শুনে ছাদের পূর্বদিকে তাকালাম । একি কান্ড! ওখানে তো একটু আগেও আমার সাধের গাছের টবগুলো সাজানো ছিল।সেসব গেলো কই।তার জায়গায় দেখি প্রদীপের আলোয় বিরাট একটা উনুন জ্বলছে । তার উপর বিরাট একটা লোহার কড়া ।  তাতে টগবগ করে কি ফুটছে ।আচার্যের জনা আষ্টেক শিষ্য-শিষ্যা যে যার কাজ করছে । একজন হামুল দিস্তায় সন্ধব লবণের মতো কিছু একটা গুঁড়ো করছে । ক’জন কতগুলো গাছ গাছড়ার ডাল পাতা ছাড়িয়ে সাজিয়ে রাখছে আর থেঁতো করছে । আর বাকিরা কড়ায় সেই গাছ পাতা হামালদিস্তা দিয়ে গোঁড়ানো মশলা দিয়ে সেদ্ধ করছে । কি বিকট ঝাঁঝালো গন্ধ । বাপরে বাপ্ , নাক জ্বলে গেলো । তাড়াতাড়ি নাকে রুমাল চাপা দিতে যাবো, আচার্য বললেন,এস তোমায় আমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দি । তারপর আমাকে হাত ধরে ছাদের মাঝখানে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন । তারপর স্নেহ জড়ানো গলায় বললেন, “এদিকে একবার এস তো সবাই । দেখো কে এসেছেন ।” আচার্যের সব ছাত্র-ছাত্রীরা একেক করে কাছে এসে দাঁড়ালো । আচার্য বললেন, “ইনিও একজন আচার্য ।  এনাকে প্রণাম করো । একে একে তোমাদের পরিচয় দাও । ”

ছেলেমেয়েরা সবাই একে একে নাম বললো।চিত্রপুষ্পি, দ্রোধবল্ক, ময়ূরবিদলা, বালামুলিকা, ময়ূরীকা, চক্রবালা, জক্রজানানির্যাস, দীর্ঘপল্লব, মাল্যপুষ্প আর মাচিকা । পরিচয় পর্ব মিটিয়ে ওরা প্রণাম করে চুপচাপ যে যার কাজে ফিরে গেলো । আচার্য বললেন , “ওরা আমার নতুন রিক্রুট । ওদের দুটো দলকে দুটো প্রজেক্ট দিয়েছি ।একদল করছে আমার লেখা বইগুলো প্রাকৃতে ট্রান্সলেট করার কাজ আর অন্যদল গাঁজাগাছের সব কটা রসতত্ত্ব, যাকে তোমাদের বিজ্ঞানীরা ক্যানাবিনয়েড বলে, খুঁজে বের করছে ।”

মওকা বুঝে আমি আচার্যকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এতো জিনিস থাকতে গাঁজা গাছই কেন আচার্য ?”

আচার্য চুপ করে রইলেন ।

আমি ফের প্রশ্ন করলাম, “আচার্য আপনার বাকি বইগুলোর নাম কি ।”

আচার্য একটু হেসে বললেন, “না না, অত সহজে আমার পরিচয় দেব না । আমার লেখা শুধু দুটো বইয়ের নাম বলবো । তুমি বিদ্বান লোক, সেগুলোর লেজ ধরে খুঁজে বের করো বাকি বইগুলোর নাম, আমার নাম ।বইদুটো হলো জীবসূত্র আর আরোগ্যমঞ্জরী।”

আচার্যকে ছাড়তে ইচ্ছে করছিলো না , জিজ্ঞাসা করলাম, “তা না হয় করবো, কিন্তু এতো বই কাগজে না লিখে তালপাতায় লিখতে গেলেন কেন ?”

আচার্য সংক্ষেপে উত্তর দিলেন, “পরতায় পোষাতো না ।”

আরো কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছি হঠাৎ একটা জোরালো আলোর ঝলকানি । চোখদুটো টনটন করে উঠলো । সহ্য করতে না পেরে হাতের চেটো দিয়ে চোখ ঢাকলাম।আলোটা একটু সয়ে আসতে চোখের আড়াল সরালাম ।দেখি, কারেন্ট চলে এসেছে । আশেপাশে কেউ কোথাও নেই ।ফাঁকা ছাদের মাঝখানে আমি একা দাঁড়িয়ে । ছাদের পশ্চিম কোণে দিব্বি ডাই হয়ে পড়ে আছে ভাঙা আসবাবগুলো, পুবদিকে আমার গাছের টবগুলোও রয়েছে বহাল তবিয়তে । তবে এতক্ষন ধরে কি ঘটলো?  সব আমার মনের ভুল?নিজেকে নিয়ে আমার ভয় হলো । তাড়াতাড়ি শোয়ার ঘরে ফিরে এসে দরজা দিয়ে শুয়ে পড়লাম ।”

এই বলে লেটুবাবু থামলেন । কিছুক্ষন কথক আর শ্রোতারা সবাই চুপ ।আজকের গল্পটা মোক্ষম জমেছে । কারো মুখে কথা সরছে না দেখে আমিই নীরবতা ভাঙলাম।

।।তিন।।

“আজ স্কুলে গিয়েছিলেন লেটুবাবু ?”

লেটুবাবু অন্যমনস্ক ভাবে উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ । খামোখা কামাই আমি করি না । তাছাড়া রাশুবাবুকে একটা জবাব দেয়ার ছিল । আজ সাধ মিটিয়ে ওনার সায়েন্সের দেমাগ ঘুচিয়ে দিয়ে এসেছি |”গল্পের শ্রোতারা লেটুবাবুর এই কথায় জোরে হাততালি দিয়ে উঠলো ।কিন্তু আমার নজর তখন লেটুবাবুর হাতের দিকে । একটা সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে উনি নাড়াচাড়া করছেন । চা খাবার পর হয়তো একটা ধরাবার তালে ছিলেন লেটুবাবু । আমি বলে উঠলাম, “দাঁড়ান লেটুবাবু । আপনার সিগারেটের প্যাকেটটা একটু দেখি ।”

লেটুবাবু বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, নাও না একটা ।” আমি বললাম, “না না সিগারেট আমার চাই না । আমি শুধু একটু দেখবো । লেটুবাবু প্যাকেটটা আমার হাতে তুলে দিলেন।প্যাকেটটা খুলতেই বুঝলাম ব্যাপারটা । একটা সিগারেট নাকের কাছে নিয়ে শুঁকে আরো নিশ্চিত হলাম । বললাম, “লেটুবাবু আপনার শোয়ার ঘরে আপনার ভাইপোরা ঢোকে?”লেটুবাবু বললেন, “আমি সকালে ইস্কুল বেরিয়ে যাই । সারাদিন আমার সব ঘর খোলাই থাকে । ওরা দুপুরে বন্ধু বান্ধব নিয়ে আড্ডা দেয়। আমি একা মানুষ, ওদের কিছু বলিনা ।”

এবার আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, “আপনি ওদের প্রতি মাসে হাত খরচ দেন?”

লেটুবাবুর জবাব, “বড় বড় ছেলেপুলে । একটা খরচ তো আছেই । আমি ছাড়া তিনকূলে আর কে আছে ওদের । আমিই কিছু কিছু করে টাকা দিই ।”

আমি বললাম, “আর দেবেন না ।”

লেটুবাবু অবাক হলেন,”কেন?”

আমি বললাম, “ওদের ডানা গজিয়েছে । ডানা ছাটুন ।নইলে আচার্য ফিরে আসবেন ।”

লেটুবাবু তো অবাক,”মানে —!!”

আমি বললাম, “আপনার সিগারেটগুলোর কয়েকটার মধ্যে মারিজুয়ানা ভরা আছে । বোঝাই যাচ্ছে এ কাদের কাজ । আপনি গতকাল রাতে ভুল করে ওদের সিগারেট ধরিয়েছিলেন ।”

লেটুবাবু চোখ বড় বড় করে বললেন, “কি সব্বোনাশ । বল কি! কি করে বুঝলে?”

আমি বললাম, “কলেজ জীবনে ও জিনিস আমিও বার কয়েক চেখেছি। গন্ধটা বিলক্ষন চিনি । একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে আপনিও ধরতে পারতেন। লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে বুঝতে পারেন নি। দেখুন কয়েকটা সিগারেটের মুখের দিকটা মুড়ানো আর বাকিগুলোর চেয়ে আকারে ছোট।”

লেটুবাবু সিগারেটটগুলো হাতের তালুর মধ্যে নিয়ে পরীক্ষা করে বললেন, “তাই তো!”


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

+ 17 = 25