দেশের বর্তমান সময়ে রাজা রামমোহন রায় খুবই প্রাসঙ্গিক, ২৫১তম জন্মদিনে সেটাই বললেন বক্তারা

Main দেশ ভ্রমণ রাজ্য
শেয়ার করুন

কলকাতায় টাউন হলে দাঁড়িয়ে রাজা রামমোহনের পুরনো স্মৃতিকে উসকে দিলেন সুগত বসু

Published on: জুলা ২৪, ২০২৩ @ ১৮:৪৩
Reporter: Aniruddha Pal

এসপিটি নিউজ, কলকাতা, ২৪ জুলাই: রাজা রামমোহন রায়ের ২৫১তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে রবিবার এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে পাবলিক রিলেশনস সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’র কলকাতা চ্যাপ্টার।সহযোগিতায় ছিল রাধানগর পল্লী সমিতি। সেখানে উপস্থিত বক্তারা সকলেই বলেছেন যে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজ রামমোহন রায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। অনুষ্ঠানে অ্যাওয়ার্ড অব এক্সেলেন্সি দিয়ে সম্মানিত করা হয় বিশিষ্টজনদের।

উজ্জ্বল উপস্থিতি

অনুষ্ঠানের শুরুতে দ্য হেরিটেজ স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা সঙ্গীত পরিবেশন করে। এর পর সঙ্গীত পরিবেশন করেন কলকাতা বিজনেস স্কুলের শিক্ষার্থীরা।তাদের পিআরএসআই-এর পক্ষ থেকে সম্বর্ধিত করা হয়।অনুষ্ঠানে রাজা রামমোহন রায় মেমোরিয়াল মিউজিয়াম ও রাধানগর প্ললী সমিতির পক্ষ থেকে রামমোহন সম্পর্কিত বেশ কিছু বিরল ছবি ও বই-এর প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন কলকাতায় ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশন নিক লো। এছাড়াও ছিলেন কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ইন কাউন্সিল সদস্য এবং বিধায়ক দেবাশিস কুমার, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক সুগত বসু। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ইনফিনিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান রবীন্দ্র চামাড়িয়া প্রমুখ।

আমার কাছে প্রথম আধুনিক বাঙালির নাম রাজা রামমোহন রায়-দেবাশিস কুমার

রাজা রামমোহন রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দেবাশিস কুমার বলেন- “আমার কাছে প্রথম আধুনিক বাঙালির নাম রাজা রামমোহন রায়। আমরা শুধু বলি তিনি সতীদাহ প্রথা বন্ধ করেছিলেন ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা নিবারণ বিল পাশ হয়। তিনি এটা বন্ধ করেছিলেন। কিন্তু এটুকুর মধ্যেই রাখলে রামমোহন রায়ের প্রতি আমাদের সুবিচার হবে না। প্রথম মানুষ হিসাবে মহিলাদের অধিকারের কথা বলেছিলেন। শুধু বলেননি মহিলাদের অধিকার দেওয়ার কাজ করেছিলেন। আজকের সমাজেও রামমোহন রায়ের প্রয়োজন আছে। ভারতবর্ষের নবজাগরণের অগ্রদূতের নাম রাজা রামমোহন রায়। আজ ২৫০ বছর পরে রাজা রামমোহন রায় শুধু প্রাসঙ্গিক নয় যদি আমাদের জাতির মেরুদণ্ড সোজা রাখতে হয় এই ধর্মীয় বিভাজনের মধ্য দিয়ে যদি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় তাহলে রাজা রামমোহন রায়কে নিয়ে আরও বেশি চর্চা করা দরকার।”

রাজা রামমোহন রায় পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন- নিক লো

কলকাতার ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনার নিক লো রাজা রামমোহনকে রায়কে সম্মান জানিয়ে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। সেখানে তিনি ব্রিটেন-ভারতের মধ্যে বর্তমান সুসম্পর্কের কথা তুলে ধরেন। এজন্য তিনি রাজা রামমোহন রায়কে কৃতিত্ব দেন। একই সঙ্গে এই অনুষ্ঠানে হাজির থাকতে পারার জন্য নিজের ভাব প্রকাশ করেন। বলেন- “আমার জীবনে খুবই বিরল মুহূর্ত এই প্রথম যে রাজা রামমোহন রায়ের ২৫১ তম জন্মদিনে উপস্থিত থাকতে পেরেছি। তিনি একজন অসাধারণ ব্যক্তি। রাজা রামমোহন রায় পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। আজ রামমোহন রায়ের পথ ধরেই আজ ইউনাইটেড কিংডম ও ইন্ডিয়ার মধ্যে ২০৩০ রোড ম্যাপ তৈরি হয়েছে। এটা ২০২১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভিতর চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে। আপনারা যদি রাজা রামহোন রায়কে জানেন পড়েন তাহলে দেখবেন সব কিছুই সম্ভব। তিনি তা করে দেখিয়েছেন।”

রাজা রামমোহন রায়কে নিয়ে বিশ্লেষনাত্মক বক্তব্য রাখলেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সুগত বসু

অনুষ্ঠানের একেবারে শেষে রাজা রামমোহন রায়ের উপর বিশেষ আলোকপাত করেন ইতিহাসবিদ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুগত বসু। তিনি কলকাতা টাউন হলের সঙ্গে রাজা রামমোহন রায়ের যোগসূত্রের একটি ঘটনা তুলে ধরে সেই স্মৃতিকে উসকে দেন। এজন্য তিনি তার দু’জন পরিচিত ইতিহাসবিদের প্রসঙ্গ টেনে রামমোহনের বিষয়টিকে তুলে ধরেন।

  • তিনি বলেন- “দু’জন ইতিহাসবিদের সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। একজন ছিলেন আমার পিএইচডি সুপারভাইজার কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এরিখ স্টোকস। তিনি একটি বিখ্যাত বই লিখেছিলেন ‘দি ইংলিশ ইউটিলিটারিয়ানস অ্যান্ড ইন্ডিয়া’। আরও একজন ছিলেন ক্রিস্টোফার বেইলি। তিনিও ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়ে অনেক বই লিখেছেন। দু’জনেই আজ প্রয়াত।”
  • এরপর তিনি বলে চলেন-“ক্রিস্টোফার বেইলি তার বইতে একটি বর্ণানা দিচ্ছেন- একটি রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ঘটনা যা সংঘটিত হয়েছিল প্রথমে গঙ্গার ধারে এবং তারপরে কলকাতা টাউন হলে। এখানে একটি উৎসব হয়েছিল। পর্তুগালের যে সংবিধান ভিত্তিক সরকার ঘোষিত হয়েছিল ১৮২০ সালে তার দ্বিতীয় বার্ষিকী উৎসব। ভেবে দেখুন, ভারতবর্ষ তখন ইংরেজদের শাসনে। আর পর্তুগালে যে সংবিধানভিত্তিক সরকার গঠিত হয়েছিল তার দ্বিতীয় বার্ষিকী উৎসব কলকাতা শহরে হচ্ছে।”
  • “এই উৎসবের বিবরণ কলকাতার দুটি খবরের কাগজে বেরিয়েছিল। এই খবরের কাগজগুলি হল- দ্য বেঙ্গল হরকারা এবং দ্বিতীয়টি দ্য ক্যালকাটা জার্নাল। ক্যালকাটা জার্নালের সম্পাদক ছিলেন জেমস সিল্ক বাকিংহাম।কিছুদিন পরে তাকে গ্রেফতার করে ব্রিটেনে ফেরত নিয়ে যায় তদানিন্তন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি। ক্যালকাটা জার্নাল পড়লে জানা যাবে যে এখানে অনেকে জড়ো হয়েচিলেন। তার মধ্যে ছিলেন সরকারি আমলা, রোমান ক্যাথলিক চার্চের পাদ্রী, অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষ। তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়।বেইলি লিখছেন- ভারতবর্ষের প্রথম আ্ধুনিক রাজনীতির চিন্তক ছিলেন রামমোহন রায়। এই তো হল ক্যালকাটা জার্নালের বিবরণ।”
  • “আর বেঙ্গল হরকরা লিখল- এই যে উৎসব হয়েছিল তারপর একটা বড় ভোজের ব্যবস্থা হয়েছিল। সেখানে ছিলেন ইউরোপিয়ান পর্তুগীজ যারা লিসবন ও ব্রাজিল থেকে এসেছিলেন। এছাড়াও বহু স্থানীয় পর্তিগীজ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে পর্তুগালের বিষয়ে তো আলোচনা হয়েছিল পাশাপাশি স্পেন যে ১৮১২ সালে একটি সংবিধান রচনা করেছিল সেই সংবিধানে যে লিবার্টির কথা বলা হয়েছিল যে স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছিল যে মুক্তির কথা বলা হয়েছিল সেগুলি নিয়েও আলোচনা করেছিলেন বাঙালি ভারতবর্ষের অনেক মানুষ। আয়ার্ল্যান্ডের একজন ব্যক্তি সকলেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এই সংবিধান আবার ঘোষণা করা হয়েছিল কিছু বছর পর। সেটি উৎসর্গ করা হয়েছিল রামমোহন রায়কে।” বলতে থাকেন সুগত বসু।
  • এরপর সুগত বসু রামমোহনের পড়াশুনো আর লেখালেখির বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে বলেন- আমরা যদি রাজা রামমোহন রায়ের কথা ভাবি তাহলে দেখব, উনি যে প্রথম বই প্রকাশ করেছিলেন ১৯ শতকের একেবারে গোড়ায় সেটা কোন ভাষায় লিখেছিলেন, জানেন? লেখাটা হয়েছিল ফার্সি ভাষায়। তার ভূমিকা লিখেছিলেন আরবি ভাষায়। তিনি এমন একজন পন্ডিত ছিলেন যিনি সংস্কৃত জানতেন, বাংলা তো জানতেনই, আরবি জানতেন, ফার্সি জানতেন, ইংরাজি জানতেন, ফরাসি ভাষা জানতেন, এবং সেইসব ভাষায় লিখতেও পারতেন। আমরা দেখি ১৮০৪ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত তিনি কেবল পড়াশুনো করে গেলেন। তিনি খুব বেশি লিখলেন না। পড়াশুনো করছেন। বিভিন্ন ভাষায়। তারপর ১৮১৫ সালে তিনি কলকাতা শহরে এলেন তারপর থেকে একটির পর একটি প্যাম্ফলেট লিখে চলেছেন। নানা বিষয়ে। তার মধ্যে শিক্ষা বিষয় তো আছেই।
  • “১৮২৩ সালে সালে তিনি আমহার্স্ট তখনকার গভর্নর জেনারেল তার সরকারকে চিঠি লিখে বললেন পাশ্চাত্যের নানা শিক্ষা এখানেও নিয়ে আসতে হবে। তাছাড়া তিনি অবশ্যই লিখছিলেন সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে। এবং সেই যে ১৮২৯ সালে যে বেন্টিক সতীদাহ প্রথা রদ করলেন সেটি কিন্তু লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিল যেটি ছিল আলটিমেট কোর্ট অব অ্যাপিল সেইসময়, তারা কিন্তু উলটে দিতে পারত। কিন্তু রামমোহন যে পিটিশনের ব্যবস্থা করছিলেন তার ভিত্তিতেই সেই আইনটি লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিল কিন্তু গ্রহণ করতে স্বীকার করেছিল। তাই এই সতীদাহ প্রথা রোধের পিছনে সব চেয়ে বড় ভূমিকা যদি কারও থেকে থাকে তিনি ছিলেন রাজা রামমোহন রায়।”
  • আজকের পরিপ্রেক্ষিতে রাজা রামমোহন রায় যে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন সেটা মনে রাখতে হবে। রামমোহন বিশ্বাস করতেন সংবিধান ভিত্তিক প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামো হয়তো আছে কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্র আছে কিনা সেই বিষয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। এই ক্ষেত্রেও কিন্তু রাজা রামমোহন রায় সমান প্রাসঙ্গিক।যোগ করেন সুগত বসু।

অ্যাওয়ার্ড অন এক্সেলেন্সি-তে যারা সম্মানিত

এর আগে প্রখ্যাত কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষকে অ্যাওয়ার্ড অব এক্সেলেন্সি দিয়ে সম্মানিত করা হয়। যাদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত সন্তুর বাদক পন্ডিত তরুণ ভট্টাচার্য, অভিনেত্রী ও সমাজ বদলের পথিকৃত অলকানন্দা রায়, সংগীত শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্র, গান, চলচ্চিত্র  গবেষক ড. দেবজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিনেত্রী চৈতি ঘোষাল, ব্যাকরণবিদ ও লেখক এবং রামমোহন গবেষক ড. পরেশ চন্দ্র দাস।

সব শেষে মোহন বার্তা পত্রিকা ও পিআরএসআই এর উদ্যোগে প্রকাশিত ‘রেডিও অন ১৯২৩…’ থিঙ্ক বুক ২০২৩-এর সংস্করনের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করা হয়।অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলেই এই অনুষ্ঠান আয়োজনের পিছনে পিআরএসআই-এর কলকাতা চ্যাপ্টারের প্রেসিডেন্ট সৌম্যজিৎ মহাপাত্রের প্রশংসা করেন।তিনি বলেন- ম’রাজা রামমোহন রায়ের জীবন-চর্যা নিয়ে বাংলার মানুষের যে সচেতনতা ও সেই ঐতিহ্য বজায় রাখতে যে তারা কতখানি অঙ্গীকারবদ্ধ এদিনের অনুষ্ঠানে তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল।

Published on: জুলা ২৪, ২০২৩ @ ১৮:৪৩


শেয়ার করুন