২০১৯ সালে জানা যাবে সুন্দরবনে বাঘের প্রকৃত সংখ্যা

বন্যপ্রাণ বাংলাদেশ রাজ্য
শেয়ার করুন

ইবতিসাম রহমান

Published on: আগ ১৩, ২০১৮ @ ২০:১৮

এসপিটি নিউজ, ঢাকা, ১৩ আগস্টঃ সারা বিশ্বে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির উপর জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেখা গিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার বাঘের বসতিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা খুব ভালো নয়। এখানে চোরাশিকারি আর বনদস্যুদের অত্যাচারে বাঘের মৃত্যু ঘটে চলেছে। যার ফলে বাঘের সংখ্যা সেভাবে বাড়ছে না। তবে এবছর ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে সুন্দরবনের বাঘ গণনা হয়। চলতি বছরের শেষ দিকে বা ২০১৯ সালে জানা যাবে সুন্দরবনে বাঘের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে।

২০১৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বাঘ সম্মেলনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাঘ রক্ষায় সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনেও বাঘের সংখ্যা ৯০-এর কাছাকাছি চলে এসেছে বলে ভারতের গণমাধ্যমগুলো প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে। ২০১৬ সালের ৭ নভেম্বর টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে সুন্দরবনে ভারতের অংশে বাঘের সংখ্যা ছিল ৭৬। পরের বছর ২০১৬ সালে বাঘ বৃদ্ধি পেয়ে ৮৫টি হয়েছে।

সুন্দরবনে বাঘ গণনায় যুক্ত একটি সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনে সাতক্ষীরা অংশের বাঘের অবস্থা কিছুটা ভালো। সেখানে বাঘের বসতি তুলনামূলক বেশি। সেখানে বাঘের খাদ্যের পরিমাণ বেশি। চোরা শিকারিদের উৎপাত তুলনামূলক কম। অন্যদিকে, খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চলে বাঘের অবস্থা খুবই করুণ। বনদস্যু ও শিকারিদের তৎপরতা সেখানে অনেক বেশি।

বাঘের সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন মত
বন বিভাগ বিভিন্ন সময়ে বাঘের সংখ্যার ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছে। বন বিভাগের হিসাবে বাঘের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া ও কমে যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। ২০০৪ সালে বন বিভাগ জানিয়েছিল, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা ৪৪০।

২০০৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান ক্যামেরা-পদ্ধতিতে বাঘ গণনা করে জানান, বাঘের সংখ্যা ২০০। দুটো হিসাবই সঠিক ধরে নিলে বলতে হয়, মাত্র দুই বছরে বাঘ ২৪০টি কমে গেছে।

২০১০ সালে বন বিভাগ ও ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশের যৌথ গণনায় বাঘের সংখ্যা হয় ৪০০ থেকে ৪৫০। এই তথ্যও সঠিক ধরলে বলা যেতে পারে, চার বছরে বাঘের সংখ্যা বেড়ে ২০০৪ সালের অবস্থায় ফিরে গেছে।

এবার দেখা যাক, পাঁচ বছর পরের এক হিসাবে বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা কত এসেছে। ক্যামেরা-পদ্ধতিতে ২০১৫ সালে সুন্দরবনের বাঘ গণনা জরিপে বন বিভাগ জানায়, বাঘের সংখ্যা ১০৬। আর বাংলাদেশ ও ভারত মিলিয়ে পুরো সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১৭০ বলে জানানো হয়। পরের বছর ২০১৬ সাল থেকে বন বিভাগ ও ওয়াইল্ড টিম বাঘ গণনা কাজ করে। এরপর ভারতের পক্ষ থেকে সুন্দরবনের পশ্চিমবঙ্গ অংশে বাঘের সংখ্যা ১০০ বলা হয়, কিন্তু বাংলাদেশের ফলাফল অজানাই রয়ে গেছে।

বাঘের সংখ্যা জানতে বন বিভাগ ও ওয়াইল্ড টিমের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেও সুনির্দিষ্ট কো্নও উত্তর পাওয়া যায়নি।

প্রথমে কথা হয় প্রধান বন সংরক্ষক সফিউল আলম চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ২০১৫ সালে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘ ছিল ১০৬টি। পরে বন বিভাগের বাঘ গণনায় পাওয়া গেছে ১২২টি। তাঁর মতে, বাঘের সংখ্যা এখন বেড়ে ১৩০-এর কাছাকাছি হয়েছে। বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য বন সংরক্ষক জাহিদুল কবীরের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।

তবে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা কমেছে, নাকি বেড়েছে, তা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি বন সংরক্ষক জাহিদুল কবীর। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘আমার কথা হচ্ছে, সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা কমেনি। স্থিতিশীল রয়েছে।’

বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ ও বন্য শূকর। আগে ছিল মহিষ। এখন তা নেই বললেই চলে। বর্তমানে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে ৬০ হাজার থেকে কিছু বেশি হরিণ থাকতে পারে। সাধারণত পাঁচশো হরিণের জন্য একটি করে বাঘ থাকে বলা হয়। সেই হিসাবে সুন্দরবনে ১২০টির মতো বাঘ থাকতে পারে।

যেসব জায়গায় বাঘ গণনা হয়েছে

ক্যামেরা ট্র্যাপিং ও ট্রেইলিং পদ্ধতিতে সাধারণত আমাদের দেশে বাঘ গণনা করা হয়ে থাকে। যেসব পয়েন্টে বাঘের আনাগোনা বেশি, সেখানে গাছের সঙ্গে লাগিয়ে রাখা হয় স্থিরচিত্র তোলার ক্যামেরা। যখন বাঘ চলাচল করে, তখন ওই ক্যামেরায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছবি উঠতে থাকে। প্রতিটি বাঘের ডোরাকাটা দাগের ভিন্নতা রয়েছে, ছবি দেখে তা আলাদা করা হয়। প্রতিটি পয়েন্টে বাঘের ছবি নিয়ে সংখ্যা গোনা হয়। গাণিতিক পদ্ধতিতে সুন্দরবন এলাকার পুরো আয়তনের ওপর ভিত্তি করে সেই সংখ্যা থেকে মোট বাঘের একটা আনুমানিক হিসাব কষা হয়।

ট্রেইলিং পদ্ধতিতে বাঘের হাঁটাচলার পথে পায়ের ছাপ দেখে বাঘের সংখ্যা গণনা করা হয়। ডোরাকাটা দাগের মতো বাঘের পায়ের ছাপেও ভিন্নতা রয়েছে। ছাপের নমুনা সংগ্রহ করে বাঘের মোট সংখ্যার হিসাব করা হয়।

বাঘ গণনা প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বাঘের বসতি বেশি—এমন তিনটি এলাকায় ক্যামেরা ট্র্যাপিং ও ট্রেইলিং করা হয়েছে। এই অঞ্চলগুলো হলো সাতক্ষীরায় সুন্দরবনের পশ্চিমাঞ্চলের কিছু এলাকা, খুলনায় সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্ট এবং বাগেরহাটের কটকা, কচিখালী ও সুপতি এলাকা। এর মধ্যে সাতক্ষীরায় ২০১৭ সালে এবং খুলনা ও বাগেরহাটে এ বছর এই দুই পদ্ধতিতে বাঘ গণনার কাজ করা হয়েছে। এর থেকে পাওয়া বাঘের ছবি ও পায়ের ছাপ সংগ্রহ করে সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। এগুলোর মধ্য থেকে বাঘের একটি ধারণা পাওয়া গেছে। তবে এখনই তা প্রকাশ করতে চাইছে না বন বিভাগ।

ভারতে ওয়াইল্ড লাইফ ইনস্টিটিউটে (ডব্লিউআইআই) বাঘের সংগৃহীত ছবি ও পায়ের ছাপের নমুনা পাঠানো হবে। ডব্লিউআইআইয়ের মতামত পাওয়া গেলে বাঘের সংখ্যা-সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করবে বন বিভাগ। চলতি বছরের শেষ দিকে বা ২০১৯ সালে জানা যাবে সুন্দরবনে বাঘের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে।

বাঘ গণনা সম্পর্কে বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ডব্লিউআইআইয়ের সঙ্গে বন বিভাগের একটি সমঝোতা চুক্তি রয়েছে। ২০১৫ সালে বাঘ গণনার পরও সব তথ্য-নমুনা ডব্লিউআইআইয়ের কাছে পাঠানো হয়েছিল। তাদের মতামত পাওয়ার পরই সেবার বাঘের সংখ্যা জানা যায়। এবারও একইভাবে সব তথ্য ও নমুনা তাদের কাছে পাঠানো হবে।

বাঘের সংখ্যা সম্পর্কে ওয়াইল্ড টিম বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ধারণা, বাঘের সংখ্যা নিয়ে খারাপ সংবাদ নেই। আগের যে অবস্থা ছিল, সেটি যদি থাকে, সেটাও বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় সুসংবাদ। কারণ, বাঘের ওপর প্রচণ্ড চাপ—বনদস্যুদের চাপ, পাচারকারীদের চাপ। পাচারকারীরা বন বিভাগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।’

বাংলাদেশে ১৮ বছরে ৩৫টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে
২০০৯ সালে সরকার টাইগার অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করে। ২০১০ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত বাঘ সম্মেলনে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ওই ঘোষণায় স্বাক্ষরও করেছে। এতে বলা হয়েছিল, বিশ্বের ১৩টি বাঘসমৃদ্ধ দেশ প্রতি দুই বছর পরপর বাঘ গণনা করবে। বাংলাদেশ ওই ঘোষণার পাঁচ বছর পর বাঘ গণনা শেষ করেছে। ভারত ২০১৩ সালে ও নেপাল ২০১৪ সালে ক্যামেরা-পদ্ধতিতে বাঘ গণনা শেষ করে।

বন বিভাগের তথ্য, বাংলাদেশে সুন্দরবনে ২০০১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৮ বছরে ৩৫টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্য লোকালয়ে আসার কারণে স্থানীয় জনতা ১৪টি বাঘকে হত্যা করেছে। বনদস্যুদের হাতে মারা গেছে ১০টি বাঘ। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে আরও ১০টির। আর সিডরে মারা গেছে একটি বাঘ।

সুন্দরবন অঞ্চলে বসবাসকারীদের বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারলে বাঘের জীবনের ঝুঁকি কমবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক নূরজাহান সরকার। তিনি বলেন, বনজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের ছেলেমেয়েদের সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বিনা মূল্যে পড়ালেখার সুযোগ দিতে হবে। বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে না পারলে বাঘের জীবনাশঙ্কা থেকেই যাবে।ছবি-গুগল

Published on: আগ ১৩, ২০১৮ @ ২০:১৮

 


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 + 1 =