বিবিসি তুলে ধরল ভারতের প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসের সেই ঐতিহাসিক স্মৃতিকথা

দেশ
শেয়ার করুন

Published on: জানু ২৬, ২০১৮ @ ১৫:৫৬

এসপিটি নিউজ ডেস্কঃ দেখতে দেখতে আমরা আমাদের প্রজাতন্ত্র দিবস ৬৯ বছরে পা দিলাম। মহা সমারোহে এবার পালিত হল প্রজাতন্ত্র দিবস। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না আজ থেকে ৬৮ বছর আগের সেই ঐতিহাসিক প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবস কিভাবে পালিত হয়েছিল। সেদিনের অনুষ্ঠানে কি কি হয়েছিল। কারা কারা ছিলেন সেদিনের অনুষ্ঠানে। সেই অনুষ্ঠানকে ঘিরে কে কি বলেছিলেন-এমন কত কি। বিবিসি সংবাদ মাধ্যম সেই ঐতিহাসিক স্মৃতিকথাই সুন্দরভাবে গেঁথে ফেলেছেন আমাদের জন্য। জানুন সেই সব স্মরণীয় ঘটনার কথা।

৬৮ বছর আগে ভারতের রাজধানী দিল্লীতে ভারতের প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপিত হয়েছিল, যা ছিল খুবই আকর্ষণীয়।ঐদিনে, পুরনো দুর্গের সামনে ব্রিটিশ স্টেডিয়ামে প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই জায়গা আজকের চিড়িয়াখানা এবং স্টেডিয়ামের জায়গায় জাতীয় স্টেডিয়াম হয়েছে।দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ ভারত প্রজাতন্ত্রের প্রথম তেরঙ্গা পতাকাটি তোলেন, এরপর কুচকাওয়াজ শুরু হয়। সবার প্রথমে, বন্দুকের গুলি ছুঁড়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়, যার ফলে পুরানো দুর্গটি কেঁপে ওঠে।দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন রাজগোপালাচারি যিনি সর্বশেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের জায়গায় গভর্নর জেনারেলের পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন।

প্রজাতন্ত্র দিবসের অর্থ হলো ভারত তার ভূখন্ড থেকে বিদেশী শাসনের বেড়াজাল মুক্ত করে স্বাধীন দেশের তালিকায় নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা। রাজা ষষ্ঠ জর্জ ভারতকে তাঁর তরফ থেকে শুভেচ্ছা জানান এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন যে কমনওয়েলথের দেশগুলিতে ভারত নতুন স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে যুক্ত হবে।যদিও রাজা শীঘ্রই মৃত্যুবরণ করেন, যদিও এই শোক সংবাদে ভারতে একটি সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়।

প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসের সময়, একটি গুজব ছড়িয়েছিল যে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস প্রত্যেককে একবার ‘দিল্লি চলো’র ডাক দিয়ে সেখানে একবার উপস্থিত হতে পারতেন।

১৯৫০ সালের প্রজাতন্ত্র দিবস কুচকাওয়াজ আজকের তুলনায় যেমন জৌলুষপূর্ণ ছিল না ঠিকই কিন্তু সেদিনের সেই অনুষ্ঠান আজও ভারতীয়দের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে।স্থলসেনা, বায়ুসেনা এবং নৌসেনাবাহিনী সেইসময় কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন যদিও সেদিন সেখানে আজকের মতো ট্যাবলো ছিল না।ঠিক যেমন বর্তমানে প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ রাজপথ থেকে শুরু হয়ে লাল কেল্লা পর্যন্ত যায়, কিন্তু সেই সময় কুচকাওয়াজ স্টেডিয়ামেই অনুষ্ঠিত হত।

আকাশে বায়ুসেনার প্রদর্শনের জন্য সেসময় বিমানে জেট বা থান্ডারবোল্ট জড়িত করা হয় নি, তাদের জায়গা ডাকোটা এবং স্পিটফায়ারের মতো ছোট প্লেন ছিল।জেনারেল ফিল্ড মার্শাল কারিয়াপ্পা ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রথম প্রধান। যিনি ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন পদক পেয়েছিলেন।

সেইসময় ভারতীয় জওয়ানদের মধ্যে একটি প্রবাদ প্রচলিত ছিল-তারা হিন্দিতে বলতেন,”আজ হাম ভি আজাদ,তুম ভি আজাদ অউর হামারা কুত্তা ভি আজাদ”। তাদের আওয়াজে সেসময় এক আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল গোটা দেশ জুড়ে।

হাজী জহুরুদ্দিন ১৯০১ সালে রানী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর সময় তিনি একটি স্কুলের ছাত্র ছিলেন। প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসের সময় জামা মসজিদ এলাকার তাঁর একটি হোটেল ছিল, সেদিন হাজী একটি বিখ্যাত দোকান থেকে মিষ্টি কিনে তা এলাকাবাসীদের মধ্যে বিতরন করে খাইয়েছিলেন।তিনি চাঁদনী চক অঞ্চলে মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন, তিনি তার দোকান ১৮শতকে শাহ আলম রাজত্বকালে চালু করেন।

প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসের দিনে চাঁদনী চককে নানারঙে সজ্জিত করা হয়। লাল মন্দির থেকে শুরু করে ফতেপুর মসজিদ পর্যন্ত ফুলের মালা এবং ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকায় সাজানো হয়।ফুল বিক্রেতারা গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে বর্ষণ করতে থাকেন। মানুষ একে অপরকে অভিনন্দন জানায়, তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করেছে্ন।

শশগঞ্জে গু্রদোওয়ারে একটি বৃহৎ নোঙ্গরখানার আয়োজন করা হয়েছিল। একইভাবে, বাংলা সাহেব ও রাকাবগঞ্জে গু্রদোওয়ারে শত শত মানুষকে দেখা গেছে তারা দাঁড়িয়ে সবজি-পুরি ও হালুয়া খাচ্ছেন। কানট প্লেসের সৌন্দর্য সেইদিনই বেরিয়ে আসছিল। কেননা এটি ছিল রাজধানীর সবচেয়ে ফ্যাশনেবল বাজার।

কানট প্লেসের গলিতে নাচানাচি করতে দেখা যায় রাম লালকে। এই রাম লাল ব্রিটিশ সেনাদের পায়ে মালিশ করে দিতেন।ব্রিটিশ সেনারা শনি এবং রবি তাদের পায়ে মালিশ করানোর জন্য লাল কেল্লার কাছে রাম লালের ঘরে আসতেন।পুরনোদিনের সেই কথা স্মরণ করে রাম লাল জানিয়েছিলেন, সেদিন এক জওয়ান তার হাতে ১০০ টাকার একটি নোট গুজে দিয়েছিলেন। রাম লাল তখন সেই জওয়ানকে বাকি পয়সা ফেরত দেওয়ার জন্য তার পিছনে ছুটতে থাকেন। আর সেই জওয়ান মনে করেন যে রাম লাল বোধহয় তার কাছে আরও টাকা নেওয়ার জন্য আসছে, এই ভেবে সে তখন রাম লালের দিকে বন্দুক তাক করেন। সেদিনের ১০০ টাকা আজকের ১০০০ টাকার সমান।

ফতেপুরিতে বসবাসকারী মুসলিম পরিবার তাদের নিজ নিজ বাড়িতে সুস্বাদু খাবার তৈরি করেছিল। অনেক হোটেলে যেমন মতিয়া মহল, যেমন করিম ও জাওয়াহর, ভিক্ষুকদের জন্য বিনামূল্যে খাবার প্রদান করা হয়েছিল। কাবাব এবং দুধ বিক্রেতারা তাদের গ্রাহকদের বিপুল ছাড় দিয়েছিলেন।

রাতে  সমস্ত ব্যক্তিগত এবং পাবলিক ভবন সুন্দর সাজে সাজানো হয়। ভাইসরয় বিল্ডিং, যা আজকের রাষ্টপতি ভবনে পরিণত হয়েছে,  তাকে এক নববধূর সাজে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল।এ ছাড়াও সংসদ ভবন, নর্থ ব্লক, সাউথ ব্লক, সেন্ট্রাল সেক্রেটারি, ইন্ডিয়া গেট এবং অল ইন্ডিয়া রেডিও ভবনটি সমস্ত আলো দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল।নয়াদিল্লির বড় হোটেলে এবং রেস্টুরেন্টে নাচ-গান অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাদের মধ্যে প্রধানত ডেভিস এবং গেলনড হোটেল ছিল। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ক্লাব দ্বারা সঞ্চালিত নাচের উপস্থাপনা সব জায়গায় আলোচিত হয়েছিল।এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য সেন্ট জর্জ ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের প্রিন্সিপালের মেয়ে আগ্রা থেকে দিল্লি এসেছিলেন। তিনজন মেয়ের সৌন্দর্য নিয়ে চারদিকে আলোচনা শুরু হয়েছিল।

সেখানে অনেক যুবক যুবতী মেয়েদের প্রতি নজর দিতে শুরু করেছিলেন। মেয়েরা উঁচু হিল এবং স্কার্ট পড়ে ছিল। একই সময়ে, জিমি পেরেরার নামে এক যুবকের দাঁত ভেঙে গেছিল। আসলে সেদিন ওই যুবকের বান্ধবীর দিকে নজর দিয়েছিল অপর একটি ছেলে, যে মেয়েটিকে উত্যক্ত করছিল। তা দেখে সেই ছেলেটির সঙ্গে জিমির মারামারি হয়। তখন তার দাঁত ভেঙে যায়।

অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি স্যার হেনরি গডী এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক অ্যান্টনি বক্তৃতা দেন, তিনি জনগণকে একটি নতুন রিপাবলিকান রাষ্ট্রের সাথে অভ্যর্থনা জানান এবং দেশটির প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার পান।এরমধ্যে সবচেয়ে যে দিকটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছিল, তা হল রাষ্ট্রপতি ভবনে আয়োজিত এক নৈশভোজ। যেখানে উপস্থিত ছিলেন পন্ডিত নেহেরু, তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধী রাজেন্দ্র প্রসাদ, তাদের সঙ্গে সর্দার প্যাটেল, মওলানা আজাদ, সরদার বলদেভ সিং ও কাপুরথালা রাজকুমারী অমৃত কৌরের মতো অনেকেই।

কাশ্মিরী গেট এলাকায় বসবাসকারী পন্ডিত রামচন্দ্রর বয়স ছিল ৯০ বছর। পুরনো স্মৃতি আউরে তিনি বলেন, দিল্লিকে এমন অবস্থায় তিনি কোনওদিন দেখেননি। এমনকি রানী ভিক্টোরিয়ার গোল্ডেন জুবিলি অনুষ্ঠানেও না।

স্যার হেনরি গিদনি ঐসময়ে একটা কত্থা বলেছিলেন, যা অস্বীকার করা যাবে না। তিনি বলেন, ভারত এমন ভূমি যেখানে সভ্যতা তার চরম শিখরে পৌঁছেছে, এখন সে একই সভ্যতার অর্জনের দিকে এগিয়ে যাবে। হেনরি ১৮৭৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি উত্তর-পূর্ব ভারতে ব্রিটিশ অভিযানে অংশগ্রহণ করেন।

Published on: জানু ২৬, ২০১৮ @ ১৫:৫৬

 


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

73 + = 78