বাঘের ডেরায় দুই শিশুকে ছেড়ে দিয়ে গেল মা, ভয়কে জয় করে ওরা হয়ে উঠল আজ ‘ জঙ্গলকন্যা ‘

এসপিটি এক্সক্লুসিভ রাজ্য
শেয়ার করুন

সংবাদদাতা-বাপ্পা মণ্ডল                                                    ছবি-রামপ্রসাদ সাউ

Published on: মার্চ ২০, ২০১৮ @ ২২:৫৭

এসপিটি নিউজ, ঝাড়গ্রাম, ২০ মার্চ : কি ভয়ানক কাণ্ড! বাঘের ডেরায় দুই শিশু। ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে তাদের মা। তিনদিন তিনরাত খিদের জ্বালায় ছটফট করেছে। গভীর জঙ্গলে ভয়ে-আতংকে কেঁদে বেড়িয়েছে। তবু ছোট্ট দুই বোন কিন্তু একে-অন্যকে ছেড়ে চলে যায়নি। ভয় আর আতংকের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে হয়ে উঠেছে ‘জঙ্গলকন্যা’। লালগড়ের পডিহাতে ঝিটকার গভীর জঙ্গলে ৬-৭ বছরের দুই শিশু কন্যা কিভাবে যে কাটাল এতগুলি রাত তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকেই। এখন যদিও তারা বিপদ মুক্ত।

লালগড়ের যে ঝিটকার জঙ্গলে গত ২ মার্চ প্রথম বাঘ দেখা গেছিল সেই জঙ্গলে এই দুই শিশু কন্যাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যায় তাদের মা ফুলমণি। ভাঙা ভাঙা কথায় পুলিশকে তারা যেটুকু জানিয়েছে, তা হল তিনদিন আগে তাদের মা ফুলমণি এই জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। তাদের বাবা মঙ্গল হাঁসদা ছোটবেলায় তাদের ছেড়ে চলে যায়। এরপর মায়ের কাছেই থাকত তারা। কিন্তু গত শনিবার মা-ও তাদের জঙ্গলে ফেলে রেখে বেপাত্তা হয়ে যায়। যে জঙ্গলে বাঘের ভয়ে মানুষ দিনের বেলায় যেতে সাহস পায় না, যার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে ভয় পায় বাসিন্দারা, সেই জঙ্গলে তিন রাত এই দুটি শিশু কিভাবে কাটাল তা ভেবেই তোলপাড় গোটা জঙ্গলমহল। অনেকেই বলতে শুরু করেছে, বাঘটি সম্ভবত এই জঙ্গলে নেই। থাকলে কি যে হত!

শিশু দুটির একজনের নাম সুকুরমণি হাঁসদা ও অপরজন সংক্রান্তি হাঁসদা। তিনদিন জঙ্গলের পথে দৌড়ে বেড়িয়েছে দুই বোন। কিভাবে বের হয়ে আসতে পারবে তারা। কিন্তু প্রতিবারই জঙ্গলের ভিতর গোলকধাঁধায় হারিয়ে ফেলেছে পথ। ফলে এক অজানা আতংক আর ভয় তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। তারা নিজেরাই জানত না আগামী সময় তাদের কাছে কি বার্তা বয়ে আনবে? তারা বাঁচতে পারবে, না কি সত্যি তারা নিজেরাই বাঘের খাবার হয়ে যাবে।

ভাবুন বাঘের ডেরায় দুই শিশু কন্যা একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। জঙ্গল বরাবরই বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে রাতে। সেই স্থানে ৬-৭ বছরের দুটি শিশু ছুটে বেড়াচ্ছে, খুঁজে চলেছে পথ। সমানে কেঁদে চলেছে।সারা জঙ্গল যখন নিঃঝুম, নিস্তব্ধ তখন এই দুই শিশুর কান্নায় এক অন্য চেহারা নেয় রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের ডেরা হয়ে ওঠা ঝিটকার গভীর জঙ্গল। মাঝে মাঝে গাছের পাতা নড়ে উঠতেই কিংবা জঙ্গলের ঝোঁপের আড়াল থেকে খসখস আওয়াজ হলেই ছোট্ট দুই বোন একে-অন্যকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে আঁতকে উঠেছে। আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছে। সত্যি তারা নিজেরাও জানত না যে তাদের খিদের জ্বালা জুড়োবে না কি তারাই বাঘের খাবার হয়ে যাবে। এভাবে কাটতে কাটতে মঙ্গলবার ভোরের আলো ফুটেছে।

এরই মধ্যে জঙ্গলে কাঠ-পাতা কুড়োতে আসেন এক শবর দম্পতি। বাঘের ভয় তাদেরও আছে। কিন্তু পেটের জ্বালায় আর কতদিন এভাবে ঘরে বসে থাকতে হবে? কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই তারা এদিন জঙ্গলের পথে পা বাড়ায়। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটার সময় আচমকা তাদের কানে আসে শুকনো পাতার উপর দিয়ে কিছু একটা হেঁটে যাওয়ার শব্দ। ভয়ে আঁতকে ওঠে শবর দম্পতি। পা টিপে টিপে যেদিক থেকে আওয়াজটা আসছিল সেদিকে এগিয়ে যায়। সেদিকে একটু এগোতেই তারা যা দেখে তাতে তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। এ কি দেখছে তারা, এ যে বাঘ নয় দুটি শিশু কন্যা ছল ছল চোখে হেঁটে বেড়াচ্ছে, গভীর জঙ্গলে এরা এল কিভাবে।জড়িয়ে ধরেন দুটি শিশুকে।

কার্তিক ও সরস্বতী শবর নামে ঐ দম্পতি শিশু দুটিকে উদ্ধার করে সোজা লালগড় থানায় নিয়ে আসেন। থানায় এসেও সমানে কেঁদে চলছিল শিশু দুটি। খেতে দিলেও কিছু মুখে তুলতে চায়নি। আইসি অরুনবাবু শিশু দুটিকে সন্তান স্নেহে বসিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুই তাদের খাওয়াতে পারেননি। পরে তারা অবশ্য চকলেট-বিস্কিট খায়। ঠিক হয়েছে শিশু দুটিকে মেদিনীপুর হোমে রেখে আসা হবে।

যে পরিস্থিতির মধ্যে শিশু দুটি তিন রাত বাঘের ডেরায় কাটিয়ে এল তা সত্যিই বড় বিস্ময়ের। যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও কিছু ঘটে যেতে পারত। শিশু দুটির কাছে হার মেনেছে ভয়-আতংক। এ এক পরম বিস্ময়কর ঘটনা। বলছে সবাই।

Published on: মার্চ ২০, ২০১৮ @ ২২:৫৭

 


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

70 + = 72