বাংলাদেশের এক শ্রমিক নেতার গল্প

বাংলাদেশ
শেয়ার করুন

।। আতাউর রহমান ।।

Published on: নভে ৯, ২০১৮ @ ০০:২১

এসপিটি নিউজ, ঢাকা, ৯ নভেম্বর তাঁর সততা, স্বচ্ছতা, শান্তি স্থাপনে বিশেষ ভূমিকা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠা আজও ভোলা যায় না। যিনি ছিলেন বাংলাদেশের আপামর সাধারণ মানুষের কাছের মানুষ। যার হৃদয় কেঁদে উঠত সমস্ত শ্রেণির শ্রমিক ভাইদের কষ্টে। আজ ৯ নভেম্বর শুক্রবার ৬৮তম জন্মদিনে আজ মনে পড়ে বারেবার, সুন্দর হাসিমাখা মুখখানি নাম তাঁর আহসান উল্লাহ মাস্টার। সততা, স্বচ্ছতার প্রতীক তিনি কল্যাণ পথের অভিযাত্রী দুর্বার। তাইতো তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন বারবার।আসুন তাঁর গল্প শুনি।

শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার তৃণমূল পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচিত হয়ে জনসেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন মানুষের মাঝে নিশিদিন। শ্রম দিয়েছেন কর্মক্ষেত্রে, অর্জন করেছেন, সফল হয়েছেন সবসময়। ভালবাসা দিয়ে নেতা-কর্মীদের আগলে রেখে যিনি মিছিলের অগ্রভাগে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সংগ্রামে যিনি ছিলেন সব সময় অগ্রভাগে, তাঁর সেই ছবি মানস নেত্রে ভেসে ওঠে আজ বারবার। সুন্দর হাসিমাখা মুখখানি নাম তাঁর আহসান উল্লাহ মাস্টার।

জনপ্রতিনিধি, সমাজসেবক, শিক্ষক, শ্রমিক নেতা হিসেবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়-এর উচ্চারণে তিনি ছিলেন নির্ভীক। মাথা উচুঁ করে ন্যায়ের পক্ষে কথা বলতেন সবসময়। রাজপথে তিনি আগলে রেখেছেন কর্মীদের। পুুলিশের লাঠি মাথায় নিয়ে নেতা কর্মীদের রক্ষা করতেন সবসময়। অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রাজপথে থেকে আহত হয়ে তিনি হাসপাতালে গেছেন কয়েকবার। একজন শিক্ষক, একজন চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য হিসেবে এলাকার উন্নয়ন এবং সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠনে ও শান্তি -শৃংখলা প্রতিষ্ঠায় তিনি যে ভূমিকা রেখে গেছেন, তা যুগে যুগে স্মরণীয় হয়ে থাকবে সর্বমহলে। কোন অন্যায়কারীকে তিনি সহ্য করতেন না। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে তিনি ছিলেন এক বলিষ্ঠ কন্ঠ। সন্ত্রাস দমনে তিনি ছিলেন এক সাহসী বীর। নিজ হাতে ডাকাত ধরে পুলিশে দিয়েছেন কয়েকবার।

পূবাইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর কয়েকবার নিজ হাতে ডাকাত ধরে পুলিশের কাছে দিয়েছেন তিনি। এলাকাকে ডাকাতমুক্ত করতে তিনি বিশেষভাবে এলাকাবাসীকে অনুপ্রাণিত ও উদ্যোগী করেছেন। শান্তি শৃংখলা প্রতিষ্ঠায় তিনি এলাকাবাসীকে নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে সভা-সমাবেশ এবং বৈঠক করতেন সব সময়। অনেকে বলে থাকেন আহসান উল্লাহ মাস্টারের জনপ্রিয়তা ও সাহসী ভূমিকাই ছিল তার মৃত্যুর কারণ।

মৃত্যুর সময় সন্ত্রাসীদের দমনে তিনি বলেছিলেন, “এই তোরা কি করছিস’, বন্ধ কর গুলি।” একজন সৎ রাজনীতিক ও আদর্শ সমাজ সেবকের যত গুণ থাকা দরকার তার শতভাগই ছিল তাঁর মধ্যে। অনেকেই তাঁর কাছ থেকে সৎ জীবন-যাপনে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। এলাকাবাসী যে কোন সমস্যা নিয়ে সব সময় তার কাছে যেতে পারতেন ও আলোচনা করতে পারতেন। ব্যক্তিগত জীবনে কোন লোভ-লালসা তাকে এবং তার পরিবার, এমনকি তার কর্মীদেরও স্পর্শ করতে পারেনি।

১৯৯২ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান সমিতির আহ্বায়ক হিসেবে তিনি উপজেলা পদ্ধতির পক্ষে সারাদেশে আন্দোলন গড়ে তোলার কারণে গ্রেফতার হন এবং পরে আদালতের মাধ্যমে জামিনে মুক্তিলাভ করেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় রাজপথে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার ও আহত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যাবার আগে তিনি পাক বাহিনীর হাতে আটক ও নির্যাতিত হন। আহত অবস্থায় তিনি মুক্তিযুদ্ধে যান এবং সক্রিয়ভাবে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা আহসান উল্লাহ মাস্টার দেশ-মাতৃকাকে পরাধীনতার শৃংখলমুক্ত করতে সম্মুখ সমরেই শুধু অংশগ্রহণ করেননি; সদ্য স্বাধীন জাতির পুনর্গঠন কাজসহ দেশপ্রেমের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে শিক্ষা ও শিক্ষা প্রশাসনের উন্নয়ন এবং প্রায় প্রতিটি উন্নয়ন ধারায় সক্রিয় অবদান রেখেছেন।

সাংবাদকর্মীদের কাছেও তিনি ছিলেন এক পরিচিত মুখ। ১৯৯৭ সালে দৈনিক বাংলা – টাইমস ট্রাস্টের সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি বিটিএমসির ৯টি সুতা ও বস্ত্রকল সমবায় সমিতির মাধ্যমে শ্রমিকদের মালিকানা দিয়ে পরিচালনা করার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনে ভূমিকা রেখেছেন। আজো যার জন্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ বিদেশে একজন শ্রমিক বান্ধব নেত্রী পরিচিতি। ১৯৯৬ সালের সেই সময়টিতে বহু দেশে এই বিষয়টি বেশ আলোচিত ও নন্দিত হয়েছে। আজকের এই দিনে শ্রদ্ধার সাথে স্মৃতিচারণ করছি, এইভাবে যে, ‘‘একজন সৎ ও আদর্শবান রাজনৈতিক জীবন চরিত্র দেখতে যদি তোমরা সবাই চাও-তবে আহসান উল্লাহর গ্রামের বাড়ি হায়দরবাদে যাও।’’

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ কমপক্ষে ১১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সদস্য সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন। আহসান উল্লাহ মাস্টারের হত্যাকা-এর পর জাতীয় সংসদে সর্বসম্মত শোক প্রস্তাবে হত্যাকারীদের যথাযথ শাস্তি দেয়া হবে বলে আলোচনাকালে সবদলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তৎকালীন বিএনপি জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপিসহ সবাই বলেছিলেন, আহসান উল্লাহ মাস্টারের হত্যাকারী যেই হোক তাকে যথাযথ শাস্তি পেতেই হবে। মাননীয় আদালত হত্যা মামলার এক বছরের মধ্যে ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল দ্রুত বিচার আইনে মামলার প্রধান আসামী বিএনপি নেতা হাসান উদ্দীন সরকারের ছোট ভাই নূরুল ইসলাম সরকারসহ ২২ জনেক ফাঁসি ও ৬ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করেন । পরে আসামী পক্ষ এ রায়ের বিপক্ষে হাইকোর্টে আপিল করেন। পরে ২০১৬ সালের ১৫ জুন আসামিদের ডেথ রেফারেন্স, জেল আপিল ও আবেদনের ওপর শুনানি শেষে বিচার পতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের হাইকোর্ট বেঞ্চ আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলার রায় দেন। ২০১৬ সালের ৮ জুন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ উভয়পক্ষের শুনানি শেষে রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেছিলো। রায়ে আসামীদের মধ্যে ৬ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল, ৮ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ১১ জন খালাস পেয়েছে। এছাড়া দুজন বিচার চলাকালে মারা যাওয়ায় তাদের আপিল নিস্পত্তি করে দেয়া হয়েছে।

যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত অপর একজন পলাতক আসামির আপিল না থাকায় তার ব্যাপারে আদালত পূর্বের রায় বহাল রাখে। এ ব্যাপারে বাদীসহ পরিবারের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়। শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের বাবা শাহ সূফি পীর সাহেব আবদুল কাদের পাঠান ইতোমধ্যে প্রয়াত হয়েছেন। বৃদ্ধ মাতা বেগম রোসমেতুননেসা কবরের পাশে বসে গত ১৪টি বছর যাবত মামলার ফাঁসির রায় কার্যকর দেখতে চোখের জলে বুক ভাসায়। দেশবাসী অবিলম্বে রায়ের কার্যকারিতা দ্রুত বাস্তবায়ন চায় । (লেখক পরিচিতি- সাধারণ সম্পাদক ,শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্মৃতি পরিষদ)

Published on: নভে ৯, ২০১৮ @ ০০:২১


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

29 − = 26