পেট্রাপোল সীমান্তে কর্মহীন ৪০০ বাহক, তিক্ত অভিজ্ঞতার সাক্ষী কলকাতার ব্যবসায়ী সহ বহু যাত্রীর

অর্থ ও বাণিজ্য দেশ বাংলাদেশ ভ্রমণ রাজ্য
শেয়ার করুন

Published on: এপ্রি ২২, ২০২২ @ ২০:১৯

Reporter: Aniruddha Pal

এসপিটি নিউজ, কলকাতা, ২১ এপ্রিল: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গতকালই সিভিল সার্ভিস ডে উপলক্ষে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, দেশে এখনও এমন অনেক আইন আছে যা কোনও কাজে আসে না। তাতে শুধু মানুষের হয়রানি হয়। এসব অব্যবহৃত আইন তুলে দেওয়া হচ্ছে, যাতে মানুষের সুবিধা হয়। অথচ, আমাদের দেশের পেট্রাপোল সীমান্তে করোনা মহামারীর সময় ৪০০জন বাহককে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ল্যান্ড পোর্ট অথোরিটি কেন্দ্র-রাজ্যের কোভিড বিধি দেখিয়ে তাদের কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আজ দেশে সর্বত্র স্বাভাবিক হয়ে এসছে। খুলে দেওয়া হয়েছে সবকিছু। কিন্তু পেট্রাপোল সীমান্তে এই সমস্ত কর্মহীন বাহকরা আজও তাদের কাজ ফিরে পাননি। স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান প্রসেনজিৎ ঘোষ সহ সীমান্তের অন্যান্য সমস্ত ট্রেড অ্যসোসিয়েশনের পক্ষে এই সমস্ত বাহকদের কাজে পুনর্বহালের  দাবি জানিয়ে এলেও আজও তার কোনও সুরাহা মেলেনি। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, পেট্রাপোল সীমান্তের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি প্রধানমন্ত্রীর চিন্তাধারাকে এড়িয়ে যেতে চাইছেন?যদিও শনিবার ফের এক বৈঠক হতে চলেছে এই বিষয়ে পেট্রাপোলে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং বলছেন- “আমরা যতই আমাদের নাগরিকদের অপ্রয়োজনীয় আইনের বোঝা থেকে মুক্ত করব, ততই তারা ক্ষমতায় প্রস্ফুটিত হবে।”পেট্রাপোলে ল্যান্ড পোর্ট অথোরিটি-র দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যানেজার কি প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণ শুনেছেন? যদি শুনে থাকেন তাহলে হয়তো বাহকদের আর বেশিদিন কর্মহীন হয়ে থাকতে হবে না। শনিবার কি তেমন কিছুর সম্ভাবনা আছে? জানতে অপেক্ষায় থাকতেই হবে।

এসপিটি-কে তিক্ত অভিজ্ঞতা শোনালেন ব্যবসায়ী মনোতোষ সাহা

এই পরিস্থিতিতে সমস্যা জটিল আকার নিয়েছে।  পেট্রাপোল সীমান্তে বাহকের অভাবে সীমান্তে দুই দেশের মধ্যে যাতায়াতকারী যাত্রীরা চূড়ান্ত ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন প্রতিদিন। বাহক না থাকায় তাদের নিজেদের মালপত্র কিংবা লাগেজ বা ব্যাগ সব কিছু নিজেদেরই বহন করে নিয়ে যেতে হচ্ছে। সম্প্রতি কলকাতার এক ব্যবসায়ী যিনি ফ্রিস্কুল স্ট্রিট ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মনোতোষ সাহা বাংলাদেশ থেকে ফেরার পথে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। সেই অভিজ্ঞতার কথা তিনি সংবাদ প্রভাকর টাইমস-এর সঙ্গে শেয়ার করেছেন।

ফ্রিস্কুল স্ট্রিট ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মনোতোষ সাহা এসপিটি-কে বলেন- “ আমি গত ৮ এপ্রিল বাংলাদেশের যশোর জেলায় গিয়েছিলাম। কোভিড মহামারীর পর কেমন পরিস্থিতি মূলত তা দেখতেই বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। সেখানে আমাকে যশোরের এমপি আপেলউদ্দিন সাহেব সম্মান জানান। সেখান থেকে আমি ১২ এপ্রিল কলকাতায় ফিরে আসি। এমপি সাহেব গাড়ি পাঠিয়ে আমাকে বেনাপোল সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেন। বাংলাদেশি যে আতিথেয়তা পেলাম তা ভাবা যায় না। এরপর তাদের লোকজন কিংবা লেবার যেখান থেকে আমাদের প্যারেড হয় সেই জায়গা পর্যন্ত পৌঁছে দেন, আমার হাতে থাকা লাগেজ বইতে তখন কোনও অসুবিধা হয়নি। কিন্তু দুর্ভোগে পড়ি ভারতে ঢোকার সময়, যখন দেখি সেখানে কেউ নেই। আমি আর কাউকে দেখতে পাই নি। তখন সময় দুপুর একটা থেকে দুটোর মধ্যে। হরিদাসপুর সীমান্তে লোকজন নেই। অর্থাৎ আমার ব্যাগ বা লাগেজ বহন করার একজনও লোক নেই। বাহক নেই একজনও। আমার হাতে ফুলের তোড়া, দু’তিনটে লাগেজ।একা অতগুলি জিনিস কিভাবে নিয়ে যাব ভেবে রীতিমতো দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। যদিও কষ্ট করে সবটা আমাকেই করতে হয়েছে।”

“অতগুলি মালপত্র আমাকেই টেনে নিয়ে যেতে হল। প্রথমে তো বিসিএফ স্ক্যান মেশিনে আমার মালপত্র সমস্ত চেক করল। এরপর আমাকে হেলথ ডেস্কে আনা হল। সেখানে আমাকে একট ফর্ম ফিলাপ করতে হল। সেখানে আমার ভ্যাকসিন ডবল ডোজ নেওয়া হয়েছে কিনা এসব লিখতে হল। ইমিগ্রেশনে পাঁচটি কাউন্টার খোলা। প্রতিটি কাউন্টারে আট-দশজন লোক। আমার হাতে দুটো ফুলের তোড়া, দুটো ব্যাগ, মিস্টির প্যাকেট আছে । আমি পারছিলাম না। এই বার কাস্টমস চেকিং হল। তারপর একটু হেঁটে আসতে হল। তারপর সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে তারপর হেঁটে এসে যশোর রোডে উঠতে হল। এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্যিই প্রথম।” – বলছিলেন মনোতোষবাবু।

ছয়ঘড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান প্রসে্নজিৎ ঘোষ জানালেন গোটা ঘটনা

শুধু মনোতোষবাবুই নয়, আজ অর্থাৎ ২২ এপ্রিল শুক্রবার সকালেও একই ছবি দেখা গিয়েছে পেট্রাপোল সীমান্তে। বাহক না থাকায় মহিলাদেরও ভারী মালপত্রের লাগেজ টেনে নিয়ে যেতে হয়েছে। কেন এমনটা হচ্ছে? কেন আজ এখানে বাহক নেই? এই সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন স্থানীয় ছয়ঘড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান প্রসে্নজিৎ ঘোষ। যিনি কোভিডের সময় থেকেই বাহকদের পাশে থেকে তাদের আন্দোলনকে সমর্থন করে আসছেন এবং তাদের সমস্যার সুরাহায় দিনরাত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এসপিটি-কে দেওয়া টেলিফোনিক সা্ক্ষাৎকারে তিনি বলেন-“ কোভিডের সময় লকডাউন শুরু হতেই বর্ডার সিল করা দেওয়া হয়েছিল। তখন থেকেই বাহকদের কাজটাই চলে যায়। এরপর লকডাউন উঠে যাওয়ার পর এক্সপোর্ট চালু করল। তারপর বর্ডার খুলল শুধুমাত্র মেডিক্যাল ভিসার উপর। এবার আমরা বললাম যে এখানে যে সমস্ত বাহক কাজ করছিল তাদের পুনরায় কাজে বহাল রাখা হোক। আমরা তারপর চিঠিপত্রও দিয়েছি।” যা যা হয়েছে তা তুলে ধরেন পঞ্চায়েত প্রধান।

  • এজন্য এখানে পেট্রাপোল জীবন-জীবিকা বাঁচাও কমিটি গড়া হয়েছে যেখানে সমস্ত ট্রে্‌ড, পরিবহন, মানি এক্সপচেঞ্জ, ক্লিয়ারিং-ফরওয়ার্ডিং থেকে শুরু করে এক্সপোর্টার-ইমপোর্টার থেকে শুরু করে অটো-ট্যাক্সি সমস্ত ট্রেডে-এরই লোকজন আছে।
  • এই কমিটি অবশেষে আন্দোলন শুরু করল। তারা দাবি জানাল যে অবিলম্বে এদের কাজে নেওয়া হোক।
  • শুধু এখানেই থেমে থাকেনি আন্দোলন। দু’দিনের বনধও হয়েছিল। এদের কাজ দেওয়ার পক্ষে বর্ডারের সমস্ত কিছু দু’দিন বন্ধ ছিল।
  • সেই সময় ল্যান্ড পোর্ট অথোরিটির ম্যানেজার ছিলেন শুভজিৎ মন্ডল। তিনি সেইসময় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের এসওপি দেখিয়ে বলেন যে করোনাকালের মধ্যে কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। পিপিই কিট বা করোনা বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। এগুলো ওরা করতে পারবে না। এসব বলে নিয়ম-নীতি দেখিয়ে তিনি বাহকদের কাজে বহাল থাকার অনুমতি দিলেন না।
  • এখন তো বর্ডারে সমস্তটাই এই ল্যান্ড পোর্ট অথরিটির অধীনে চলে গিয়েছে।
  • এখানে বিএসএফ, কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, সেন্ট্রাল ওয়ার হাউস এই সমস্তটাই ল্যান্ড পোর্ট অথোরিটির অধীনে আছে। অর্থাৎ এসবটাই দেখেন এলপিএ-র ম্যানেজার।

বর্তমান জটিল পরিস্থিতির ছবিটা ঠিক কেমন, জানালেন পঞ্চায়েত প্রধান

পঞ্চায়েত প্রধান প্রসেনজিৎ ঘোষ তুলে ধরেন পেট্রাপোল সীমান্তে বাহকদের কাজে পুনর্বহাল না করার বর্তমান জটিল পরিস্থিতির ছবিটা। তিনি বলেন-“ইতিমধ্যে আমাদের এখানে এই বিষয়ে একাধিক আন্দোলন হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একাধিক চিঠিপত্র দিয়েছি। ১৫ দিন আগেও বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের জেনারেল সেক্রেটারি উৎপল রায় এলপিএ-র কাছে একটি রিপ্রেজেন্টেশন দিয়েছেন। একটি চিঠিও দিয়েছেন। এখন যিনি এলপিএ ম্যানেজার সাইনির সঙ্গে কথাও বলছেন। তিনি জানিয়েছিলেন যে বিষয়টি দেখে ঊর্দ্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেব। সেটাও প্রায় ছ’মাস কিংবা তার বেশি হয়ে গেল। এরপরেও একটা চিঠি দেওয়া হয়েছে – সেখানে বলা হয়েছে যে আপনি কথা দিলেও তা আপনি রাখেননি। বাংলাদেশের যে সমস্ত অসুস্থ মানুষ আমাদের দেশে চিকিৎসা করাতে আসছেন তাদের লাগেজ বহনের ক্ষমতা নেই। সেটা যাতে করতে পারে তারজন্য এদের অনুমোদন দেওয়া হোক। সেই সঙ্গে যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য যাতে বজায় থাকে বিশেষ করে এটা দুই দেশের ব্যাপা্রে। এবং তখন তারা একটা শর্ত রাখল- বলা হল যে এইসব বাহকরা কাস্টমস কিংবা ইমিগ্রেশনের প্রেমিসেসের মধ্যে ঢুকতে পারবে না। বাহকরা সেটাতেও রাজী হল। আমরাও রাজী হলাম- ওরা ইমিগ্রেশন বিল্ডিং পর্যন্ত লাগেজগুলো পৌঁছে দেবে, এমনটাই ঠিক হল। সেটাতেও এখনও পর্যন্ত অনুমতি দেয়নি।”

শনিবার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হবে

“আমাদের শনিবার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হবে। আমার সঙ্গে পেট্রাপোল চেকপোস্ট ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি দীপক ঘোষ্ও যাবেন। আমরা যে শেষ চিঠিটা দিয়েছিলাম তখন উনি বলেছিলেন যে বিএসএফ-এর ১৭৯ ব্যাটেলিয়নের যিনি কম্যান্ড্যান্ট আছেন তাকেও একটা চিঠি দিন। তার কপি আমাকে দেবেন। আমি জয়েন্ট মিটিং ডাকব সেখানে আপনাদেরও ডাকবো। সেটা সাতদিনের মধ্যে ডাকার কথা ছিল। কিন্তু ১৭ তারিখ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের আসার কথা ছিল। যদিও তিনি আসেননি। এখন তিনিও আজ পর্যন্ত মিটিং ডাকেননি। ওই ম্যানেজার বলেছেন যে এই বাহকদের আইডেনটিটি থাকবে । সেই আইডেনটিটি ইস্যু করবে এলপিএ। তারা সেই আইডেনটিটি নিয়ে যাবে। রোটেশানে যাবে। এরা প্রায় ৪০০জন আছে। তবে এক সঙ্গে এতজনকে রাখা হবে না। তখন আমরা প্রস্তাব দিয়েছি যে ২৫ জন করে অনুমোদন দেওয়া হোক। কাজ তো আগে শুরু হোক। যদিও আমরা এখন তাকিয়ে আছি শনিবারের বৈঠকের দিকে।“ বলেন প্রধান প্রসেনজিৎবাবু।


শেয়ার করুন