
এই প্রতিবেদনটি সংবাদ প্রভাকর টাইমস-এর মুদ্রন সংস্করণের ‘ডিসেম্বর-জানুরারি ২০১৬’ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। তারই প্রথম পর্ব আজ পাঠকদের জন্য পুনরায় উপস্থাপিত করা হল। এই প্রতিবেদনটি লেখার সময়কালে স্বামী বিশ্বনাথানন্দ মহারাজ বাগবাজারে মায়ের বাড়ির অধ্যক্ষ ছিলেন, ছিলেন উদ্বোধন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক-ও। বর্তমানে মহারাজ বেনারস রামকৃষ্ণ মঠে আছেন। শ্রীশ্রী মায়ের পায়ে জানাই আমাদের শ্রদ্ধা ও প্রণাম।
স্বামী বিশ্বনাথানন্দ
একটি স্মৃতিচারন দিয়ে শুরু করা যাক। লাবণ্য কুমার চক্রবর্তী মায়ের দীক্ষিত সন্তান। ১৯১২ সালের নভেম্বর মাস-মা কাশিতে আছেন লক্ষী নিবাসে। ‘শ্রীম’ও আছেন কাশীতে।শ্রীম লাবণ্যবাবুকে বললেন, ‘মা আছেন লক্ষী নিবাসে-প্রণাম করে আসুন।’ এবার লাবণ্য কুমারের নিজের মুখে শুনি।”একটি কোণে আপাদমস্তক মোটা বস্ত্রে আবৃত করিয়া একটি প্রাণী অনুমান করতে পারি। নিজেদের মধ্যে কথা বলিতে লাগিলাম, একটু শব্দও করিলাম, কিন্তু কোনো সাড়া নাই, অগত্যা একটু দূরে থাকিয়া প্রণাম করিলাম। এই প্রাণীটি কে তাহা বুঝিতে কষ্ট হয় না। পায়ের অবস্থান বুঝিতে না পারিয়া পদধূলির আশা ত্যাগ করিয়া নামিয়া আসিলাম। সঙ্গী দুজনও আসিলেন।মনটা ভারী খারাপ।….বিশ্বনাথের গলিতে বিপরীত দিক হইতে আগত মাস্টার মহাশয়ের সহিত দেখা হইল।…(তিনি) জিজ্ঞাসা করিলেনঃ “মা-কে দর্শন করা হল?” আমি ব্যথিত কণ্ঠে বলিলাম, “মাস্টার মহাশয়, প্রণাম দূর থেকে হয়েছে। দর্শন হয়েছে একটি কাপড়ের পুঁটলির।” “সে কি!” বলিয়া তিনি সব কথা জানিয়া লইলেন।কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেনঃ “আপনি একা ছিলেন?””না, আরও দু’টি যুবক।” “আপনার পরিচিত?” “না আপনার কথা শুনে তারাও গিয়েছিল মাকে দেখতে।” মাস্টার মহাশয় হাসিয়া ফেলিলেন। বলিলেন,”সঙ্গ দোষে আপনার মাতৃ দর্শন হয় নাই। আপনি গিয়েছিলেন মাতৃ দর্শনে, আর ওরা গিয়েছিল পরমহংসের স্ত্রীকে দেখতে, পরমহংস তো নাম করা লোক–তাঁর স্ত্রী কেমন দেখবে।”
পরের দিন গঙ্গা স্নান করে পুজোর উপকরণ নিয়ে আবার গেলেন লাবণ্যকুমার। গিয়ে দেখলেন সদর দরজায় একজন অবগুণ্ঠিত স্ত্রী লোক গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যেন মনে হচ্ছে যে কারও প্রত্যাশায় তিনি অপেক্ষা করছেন।লাবণ্যকুমার তাঁর সমীপবর্তী হয়ে, তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বল্লেন,”তুমি মা?” “হ্যাঁ বাবা আমি তোমার মা” “আমাদের মা?” “হ্যাঁ বাবা আমি জগতের মা”। মনে পড়ে মা অন্য এক সময় তাঁর মাতৃত্বের স্বরূপ প্রকাশ করেছিলেন, “আমি গুরুপত্নী নই, আমি পাতানো মা নই-আমি সত্যিকারের জননী।” আমাদের স্মৃতি শাস্ত্রে মায়ের একটি সংজ্ঞা আছে-“আদৌ মাতা, গুরু পত্নী, ব্রাহ্মণী রাজ পত্নীকা–ধেনু ধাত্রী তথা পৃথ্বী সপ্তৈতা মাতরঃ স্মৃতা।”
মায়ের চরিত্র মাধুর্য্য, ঈশ্বর নির্ভরতা, নিরাভিমানিতা, সহ্য শক্তি, সকলের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। এই ঈশ্বর নির্ভরতায় একটি উদাহরণ। ১৮৮১ সালের মার্চ মাসে শ্রীমা, তাঁর মা শ্যামাসুন্দরী ও রামেশ্বরের কন্যা লক্ষী দক্ষিণেশ্বরে এলেন-কোনও খবর না দিয়ে।এদের দেখে হৃদয় অকারণ দুর্ব্যবহার করে ও ‘কেন এসেছ-কি জন্য এসেছ?’ এই প্রশ্নে বিব্রত করতে থাকে। হৃদয় অহঙ্কারে পরিপূর্ণ হয়ে ঐ সময় ঠাকুরের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করত। অপ্রত্যাশিত এই ব্যবহারে–বিশেষ করে ঠাকুরও হৃদয়ের এই ব্যবহারের কোনো প্রতিবাদ না করায় শ্যামাসুন্দরী শ্রীমাকে নিয়ে জয়রামবাটী ফিরে যান। শ্রীমা যাবার সময় মনে মনে মা কালীকে প্রার্থণা করেন, “মা যদি কোনো দিন আনাও তো আসব। এর প্রতিফল পেয়েছিল হৃদয় কয়েক মাস পরে কালীবাড়ি হতে হৃদয়কে বিতাড়িত হতে হয়েছিল। এই সময়ের কিছুদিন পর ঠাকুর তাঁর সমাধিতে মগ্ন থাকতেন–ভাইপো রামলাল কোনো খবর নিত না, ঠাকুরের সময়ে খাওয়া-দাওয়া হত না- তাই ঠাকুর বার বার মা কে আসার জন্য জয়রামবাটিতে খবর দিতে লাগলেন-কামারপুকুরের লক্ষ্মন পাইনকে দিয়ে বলে পাঠালেন, “এখানে আমার কষ্ট হচ্ছে।রামলাল মা কালীর পূজারী হয়ে বামুনের দলে মিশেছে- এখন আমাকে আর অত খোঁজ করে না।তুমি অবশ্য আসবে, ডুলি করে হোক, পালকি করে হোক, দশ টাকা লাগুক, বিশ টাকা লাগুক আমি দেব। ঠাকুরের এইসব সংবাদ পেয়ে আমি শেষে আসলুম। এক বছর আসিনি”, মায়ের এই ঈশ্বর নির্ভরতা বরাবর ছিল। সম্পর্ক কেমন ছিল?একদিন বলরামবাবুর সঙ্গে কথা হচ্ছে। “আচ্ছা(আমার) আবার বিয়ে কেন হল বল দেখি!স্ত্রী আবার কিসের জন্য হল? পরনের কাপড়ের ঠিক নেই- আবার স্ত্রী কেন?বলরামবাবু চুপ করে আছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ থালা থেকে একটু তরকারী তুলে নিয়ে খেতে খেতে বলছেন, এরজন্য -এর-জন্য হয়েছে। নইলে কে আর এমন করে রেঁধে দিত। শুনে সবাই হাসছেন। আবার ঠাকুর বলছেন-আজ ওরা অর্থাৎ মা ও অন্যান্যরা রামলালদের বিয়ে উপলক্ষে কামারপুকুর চলে গেল-দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলুম কিছু মনে হল না- কে গেল তো কিছুই মনে হল না- তারপর কে রেঁধে দেবে বলে ভাবনা হল। ঠাকুরের অন্ন ব্যঞ্জন প্রস্তুত কেমন হবে- মায়ের যে বিষয়ে বিশেষ-ধারণা ছিল- বসে খাওয়ানও নিত্যকর্ম ছিল- আর মা ঐ সময়টিতে স্বামী সান্নিধ্য লাভ করতেন।ঠাকুরও অবশ্যই অপেক্ষা করে থাকতেন মায়ের শারীরিক সুস্থতার খবরাখবর নিতে। পারস্পরিক অনুরাগ, নির্ভরতা ও ঐশ্বরিক সম্পর্ক কেমন হতে পারে এ এক অদ্ভূত দৃষ্টান্ত। পরবর্তীকালে মায়ের মুখে শুনি, “কি মানুষই এসেছিলেন। কত লোক জ্ঞান পেয়ে গেল।কি সদানন্দ পুরুষই ছিলেন। হাসি, কথা, গল্প, কীর্ত্তন চব্বিশ ঘণ্টা লেগেই থাকত। দক্ষিণেশ্বরে আনন্দের হাট বাজার বসে যেত। ছবিটি বেলুড় রামকৃষ্ণ মঠের সৌজন্যে