সম্রাট তপাদার
Published on: ফেব্রু ৭, ২০১৮ @ ০০:২২
মতের অমিলটা হয়েছিল ১৯৯২ সালের এপ্রিল মাসে। মহারাষ্ট্র নিবাস (কলকাতা) হলে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের নির্বাচনে। সেসময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর দাঁড়িয়ে বামফ্রন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে কংগ্রেসের মধ্যেই তৈরি হয়েছিল দু’টি উপদল। একদিকে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, সুব্রত বক্সির মতো নেতৃত্ব। অন্যদিকে ছিলেন সৌমেন মিত্র, প্রণব মুখার্জি, প্রদীপ ভট্টাচার্যের মতো নেতারা। সেদিন মহারাষ্ট্র নিবাস হল পশ্চিম বাংলার রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের আভাস দিয়েছিল। মাত্র ২ ভোটে পরাজিত হলেও নৈতিক জয় হয়েছিল মমতাদির। এই ঘটনার জলজ্যান্ত সাক্ষী ছিলাম আমি।
এই লড়াইয়ের বিভাজন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম নিয়েছিল সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস। জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তরুণ ব্রিগেড তৈরি হয়েছিল। জেলা জেলায় নতুন প্রজন্মের নেতা অখিল গিরি, শুভেন্দু অধিকারী, গৌতম দেব, ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত বক্সি, তপন দাশগুপ্ত, আকবর আলি খোন্দকার, গোপাল মুখার্জি, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, অরূপ রায়, আশিস ব্যানার্জি, শোভন চট্টোপাধ্যায়, মদন মিত্র, অনুব্রত মণ্ডলরা ঘরবাড়ি ও ব্যক্তিগত সব চাহিদা ছেড়ে দিয়ে জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে গঠন করেছিল এক শক্তিশালী ব্রিগেড। এই ব্রিগেডকে নানা অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ লড়াইয়ের পর আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এই ব্রিগেডই ক্ষমতায়।
যেহেতু ৯০-এর দশক থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার আগেই সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। তাই কিছু ঘটনা মনের মণিকোঠায় আজও গেঁথে আছে। যেমন-তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তর কলকাতার জনপ্রিয় সাংসদের পাশাপাশি যুব কংগ্রেসের সভানেত্রীও। স্কুলের গরমের ছুটির পর কলকাতা নেতাজী নগরে আমার মামার বাড়িতে ছুটি কাটাতে গেছি। গাছতলা এলাকায় কিছু বাসিন্দারা বাইরে ঘুরতে গেয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়। বেশ কয়েকজনের মৃত্যুও হয়। সেই পরিবারগুলির সঙ্গে রাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখা করতে আসছেন এই খবর ছড়াতেই আমিও সেখানে ছুটে যাই দিদিকে দেখার জন্য। সেখানে গিয়ে দেখি আমার মতো অনেকেই সেখানে অপেক্ষা করছেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। দিদি এলেন সাধারণ একটি মিটার ট্যাক্সি চেপে। সাথে ছিলেন সুব্রত বক্সী। সেই প্রথম দিদিকে দেখা।
এটা নেহাতই একটা ছোট ঘটনা নয়। কারণ, আমি যখন দেখলাম ট্যাক্সিচালক দিদিকে নিয়ে এসেছেন, কিন্তু ভাড়া নিয়ে নেওয়ার পরও উনি দাঁড়িয়ে আছেন। কিছুটা কৌতূহল হল। তাই বজবজ সন্তোষপুরের বাসিন্দা ওই ট্যাক্সিচালকের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ভাড়া গুণে নেওয়ার পরও কেন তিনি দাঁড়িয়ে আছেন? তখন তাঁর সহাস্য উত্তর-রাতে দিদি গাড়ি পাবেন না।তাই দিদিকে পৌঁছে দিয়েই বাড়ি যাবো। এই ঘটনা রাজনীতিতে আসার পূর্বে নেত্রীর প্রতি মানুষের ভালবাসার একটা শিক্ষা দিয়েছিল।
স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত হয়ে যাই। তখন আমাদের শযোগিতা করার মতো খুব কম নেতা ছিলেন। ছাত্র পরিষদের সভাপতি তাপস রায়। অশোক দেবকে বাদ দিলে আমাদের কলেজের প্রাক্তন দুই ছাত্র শ্রদ্ধেয় অজিত পাঁজা এবং সাধন পাণ্ডের সঙ্গে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী তখনকার একটি রাষ্টায়ত্ত কোম্পানির উচ্চপদস্থ আধিকারিক পার্থ চট্টোপাধ্যায় সবসময়ই আমাদেরকে উৎসাহ ও সহযোগিতা করেছেন। কলেজের সোশ্যালে বা অন্য কোনও কাজের জন্য সাহায্য চাইতে যখনই ডালহৌসির অফিস পাড়ায় পার্থদার কেবিনে উপস্থিত হয়েছি তখনই পার্থদা সকল ছাত্র পরিষদের কর্মীদের দুপুরের খাবার ও সাহায্য না করে ফেরাননি।
১৯৯২ সালের ২৫ নভেম্বর বাংলা দেখেছিল এক ঐতিহাসিক ব্রিগেড প্যারেডের সভা। জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সেই সভা থেকেই বাজানো হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকারের বিদায় ঘণ্টা। ঐতিহাসিক এই সভায় যুব কংগ্রেস নেতা মনিন্দর সিং বিট্টা, যিনি সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে নিজের দু’পা হারিয়েছিলেন। উনি মমতাদিকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর জ্বালাময়ী বক্তব্যের মাধ্যমে সেদিনের ব্রিগেডের সভার পারদ তিনি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। প্রয়াত সন্তোষ মোহন দেবের সেদিনের বক্তব্য আজও ভুলতে পারিনি।
২১ জুলাই ১৯৯৩ সাল। ঘটনার সাক্ষী আমিও। আমাদের কলেজের সিনিয়র কৌশিক ঘোষ, তরুণ মিত্র ও জাহিদ আলি খানের নেতৃত্বে হেদুয়া মোড় থেকে আমাদের মিছিল শুরু হয়। সি আর অ্যভিনিউ টি বোর্ডের সামনে যাওয়ার আগেই আমাদের মিছিল আটকে যায় হাওড়া ও হুগলির বিশাল মিছিলের সামনে। একপ্রকার মিছিল ভেঙেই যায়। মানুষের জনজোয়ার তখন লালবাজার ও পাসপোর্ট অফিসের কাছে টি বোর্ডের সভা মঞ্চের সামনে। জনতা ও যুব কংগ্রেসের মেজাজ এবং আবেগ ছিল তুঙ্গে। দাবি ছিল-“নো ভোটার কার্ড, ণো ভোট।” এরই মধ্যে শোনা গেল মমতাদি আক্রান্ত। পুলিশ গুলি চালিয়েছে। বুকে সাহস নিয়ে কিছুটা কৌতূহল বশত সেদিন পৌঁছে গেছিলাম সভামঞ্চের সামনে। পুলিশের কঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় চোখে জ্বালা নিয়ে আহত কিছু যুব কংগ্রেস কর্মীদের পৌঁছে দিয়েছিলাম মেডিক্যাল কলেজে। সন্ধ্যাবেলায় পিজি হাসপাতালে দেখেছিলাম মদনদার তৎপরতা। রাতে তরুণদা ও কৌশিকদার সাথে পৌঁছেছিলাম উডল্যান্ড নার্সিংহোমে।
থমথমে পরিবেশ। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। কাউকেই সেখানে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। কারণ, বাংলার অগ্নিকন্যা আক্রান্ত হয়ে ঐ হাসপাতালেই জীবনের সাথে যুদ্ধ করছেন। খুব কৌশলে তরুণ মিত্র আমাকে নিয়ে পৌঁছে গেল হাসপাতালের ভিতরে। দেখা হল আকমাত্র মমতাদির ছায়া সঙ্গিনী সোনালী গুহর সঙ্গে। কিছুক্ষণ পর মমতাদিকে নিচে নামানো হল উপর থেকে। মাথা স্ক্যান করানোর জন্য। স্ট্রেচারে শুয়ে মমতাদি সোনালীদিকে বলেছিল, ‘সিপিএমের আমি শেষ দেখে ছাড়বো।’ সেদিনের মমতাদির মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণার জ্বালা আমাদের হৃদয়ে দাগ কেটেছিল। কারণ এই আন্দোলনের ফলে আমরা হারিয়ে ছিলাম ১৩জন যুব কংগ্রেস কর্মীকে। সারারাত উডল্যান্ডের ওই হাসপাতালে আমরা কাটিয়েছিলাম। পকেটে ছিল না পয়সা। কিন্তু দিদিকে দেখার পরে মনে বেঁধেছিল শক্তি ও সাহস।উবে গেছিল সমস্ত খিদে।
এরকম অনেক ঘটনার সাক্ষী থেকেছি বারেবারে। ১৯৯৪ সালে বারাসতে পুলিশের গুলি চালানোও দেখেছি সামনে থেকে। যে গুলিতে শহিদ হয়েছিলেন গোবিন্দ ব্যানার্জি। আক্রান্ত হয়েছিলেন অনেকের সাথে বারাকপুরের অলোকদাও।
২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪ সাল। কলেজ থেকে শিয়ালদা হয়ে ট্রেনে বাড়ি ফেরার সময় সাক্ষী থেকেছিলাম পুলিশের গুলি চালনার। ৬জন নিরপরাধ মানুষ শিয়ালদা স্টেশন চত্বরে শহীদের মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সারারাত তৎকালীন রাজ্য ছাত্র পরিষদের সভাপতি তাপস রায়, সজল ঘোষদের সঙ্গে রাত কাটিয়েছিলাম নীল্রতন সরকার হাসপাতালে। একটু ভোর হতেই তাপসদার বাড়িতে স্নান করে বৌদির দেওয়া জলখাবার খেয়ে কাঁধে ছাত্র পরিষদের পতাকা নিয়ে ছাত্র ধর্মঘট করতে নেমে গেছিলাম রাস্তায়।
১৯৯৪ সালের অক্টোবরে দিদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অত্যাচারিত চপলা সরদারকে নিয়ে বিচার চাইতে গেছিলেন মহাকরণে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে। বিচার তো দূরের কথা; সেদিন জ্যোতিবাবুর পুলিশ মমতাদিকে চুলের মুঠি ধরে মহাকরণ থেকে বের করে দিয়েছিল। সেদিনই দুপুরবেলায় প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করতে গিয়ে প্রথমবার গ্রেফতার বরণ করি।
১৬ আগস্ট ১৯৯০। ভবানীপুরে মমতাদি আক্রান্ত হওয়ার দিন থেকে মণীষা মুখার্জি অন্তর্ধান, বান্তলা গণধর্ষণ, ধান্তলা নারী নির্যাতন, ছোট আঙারিয়া গণহত্যা, নেতাই গণহত্যা, সিঙ্গুর আন্দোলন, তাপসি মালিক হত্যাকাণ্ড, ১৪ মার্চ ২০০৭, নন্দীগ্রামে কৃষকদের উপর পুলিশ ও সিপিএমের গুলি চালনার মতো একের পর এক ঘটনা নিয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন সংগঠিত করেছি। আন্দোলন করতে গিয়ে রক্তাক্ত হয়েছি। হাজতবাসও করতে হয়েছিল। কিন্তু পিছু হটিনি। কারণ, সবকিছুর সাথে আপস করা যায়। কিন্তু নিজের আদর্শ, সংগ্রাম ও নীতির সাথে নয় বলে আমি মনে করি।
৯০ দশকে মমতাদির তৈরি করা ব্রিগেডের মতো বর্তমান প্রজন্মকে নিয়ে তরুণ ব্রিগেড গড়তে চলেছেন যুব নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছোটবেলা থেকেই রাজনৈতিক ঘরানায় মানুষ হওয়া অভিষেক সাক্ষী অনেক ইতিহাসেরও। তাই সহজে মিশে গেছে মানুষের মানুষের মধ্যে। আজকের প্রজন্ম তাকিয়ে আছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে। কারণ, সেদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার যুব সমাজকে যে রাজনীতির পাঠ, সততা, নিষ্ঠা এবং আদর্শ দিতে পেরেছিল আজ সেটা অভিষেকের কাছ থেকেই চাইছে বাংলার বর্তমান যুব সমাজ।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলার ছাত্র-যুবদের রাজনৈতিক চাহিদা পূরণ করবেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখানো ও শেখানো পথেই আরও উন্নয়নমুখী বাংলা গড়তে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবে বাংলার ছাত্র-যুব সমাজ। ভবিষ্যতে যার নেতৃত্ব দেবেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
Published on: ফেব্রু ৭, ২০১৮ @ ০০:২২