SUNDAY HORROR: বাজিমাত

Main দেশ বিদেশ সাহিত্য
শেয়ার করুন

লেখক- সুমিত গুপ্ত

Published on: নভে ১০, ২০১৯ @ ১২:২৩

সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার মধ্যেই দোকানে পৌঁছে গেলো বৈকুন্ঠ বৈরাগী। শ্মশানঘাটের সদরের পাশে ঝাঁকড়া বুড়ো ছাতিম গাছ ।তারই তলায় বৈকুন্ঠের টিনে ছাওয়া একচালা চায়ের দোকান। দোকানের দরমার ঝাঁপ অর্ধেক খোলা। দরমার ফাঁক গলে দোকানের ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে কেরোসিনের কুপির একচিলতে ক্ষীণ আলো। সাইকেলটা ছাতিম গাছে এলিয়ে দিয়ে বৈকুন্ঠ হাঁক দিলো, “জগা, জগা রে, বাতিটা একবার দেখা দিকি।” একটু পরেই ঝাঁপ তুলে কুপি হাতে বাইরে বেরিয়ে এলো একটা ছেলে। বয়স বড় জোর বছর ২০-২২ হবে। ছিপছিপে চেহারা, পরনে জিনসের প্যান্ট আর গেঞ্জি। বৈকুন্ঠের ভাইপো জগাই। করিৎকর্মা ছেলে। দিনভর দোকান সামলায় সেই। সন্ধ্যায় কাকা ফিরলে তাকে দোকানের সারাদিনের হিসাবপত্র ক্যাশ বাক্সের জমা-খরচ বুঝিয়ে দিয়ে তবে জগাইয়ের ছুটি। বৈকুন্ঠ দোকানে ঢুকতে কাকার সাইকেল হাঁকড়ে চটপট গ্রামের দিকে রওনা হলো সে।

হুগলির অজগ্রাম ভাবপুর। গ্রামের শেষপ্রান্তে বয়ে চলেছে দ্বারকেশ্বর নদী।নদীর পূর্ব পাড়ে কিছুদূর পর্যন্ত ধু-ধু করছে বালির চর। আরো খানিক তফাতে তাল-খেজুরের জটলা। এখানে ওখানে খানা খন্দ, বাদা।পলাশ আর বাবলার ঘন ঝোপ-জঙ্গল।মধ্যে মধ্যে বট-পাকুড়ের জড়ামুড়ি এলাকাটাকে আরো দুর্ভেদ্য করে তুলেছে। নদীর পূর্ব-দক্ষিণপূর্ব দিক বরাবর মাইলের পর মাইল জুড়ে একই অবস্থা। এরই একদিকে নদীর তীরে বাগারপাড় শ্মশানঘাট। লোকে বলে বাগপাড়। এককালে এই সব এলাকাতে দিনের বেলাতেও জনপ্রাণী উঁকি দিতো না। শোনা যায়, এ জায়গায় এককালে নাকি খুনে ডাকাত আর হিংস্র জংলী জানোয়ারের ভীষণ উপদ্রব ছিল। বাগপাড়ের জঙ্গলে এক সময় নাকি পাখিও ডাকতো না। বছর পাঁচেক আগেও শ্মশানের কালী মন্দিরে বিজলীবাতি ছিল না। ছোট্ট আটচালা প্রাচীন কালী মন্দির।কবেকার কেউ জানে না।এই সেদিনও মন্দিরের ভিতর দেবী বিগ্রহের সামনে টিম টিম করে জাগ্ প্রদীপ জ্বলতে দেখেছে বৈকুন্ঠ। দিনমানেও তখন শ্মশানযাত্রী ছাড়া এলাকা মাড়াতো না কেউ। হালে স্থানীয় পঞ্চায়েতের কল্যানে সরকারি সাহায্যে শ্মশানের ঘাটে ইলেকট্রিক পোল পড়েছে। মন্দিরের সংস্কার হয়েছে।এখন মন্দিরে বিজলি বাতি জ্বলে, শ্মশানেও। তবু এখনো সারা দিনে কাঠের চিতায় শবদাহ হয় হাত গুনে, কোনো কোনো দিন তাও হয় না। ইদানিং ইলেকট্রিক আসার পর শ্মশানের হাল একটু ফিরেছে। দিনে রাতে লোকের আনাগোনা বেড়েছে কিছুটা। খানিক হলেও বেড়েছে বৈকুন্ঠের দোকানের কেনা বেচা।বছর পাঁচেক আগের কথা। রাত ৯-টা বাজতে না বাজতেই দোকানের ঝাঁপ ফেলে গ্রামে ফিরত বৈকুন্ঠ। এখন রাত-বেরাতেও মরদেহ আসে। শ্মশান তল্লাটে অন্য কোনো দোকান না থাকায় বৈকুন্ঠের বিক্রিবাটাও মন্দ হয় না । কাজেই বৈকুন্ঠও দোকান খোলা রাখে রাতভর। কে জানে কোন দিন শিকে ছেঁড়ে! কেউ সেটা না জানলেও জানেন অন্তত দু’জন। নিজেরা জানুন আর নাই জানুন অন্তত জানান দিয়ে দেন আগে ভাগেই। তা চমকে ওঠার মতো ব্যাপারই বটে। প্রথমটা গতিক দেখে শুনে বৈকুন্ঠেরও পিলে চমকে গিয়েছিলো। ব্যাপারটা বুঝে উঠতেই বেশ কিছুদিন লেগে ছিল তার। এখন ধাতে সয়ে গিয়েছে দিব্বি। দু’জন মানে দুই বুড়ো। একজন হাটখোলার অবনী চাটুজ্জে। অন্যজন মহামায়াতলার তারকেশ্বর সিংহ। অবনী চাটুজ্জের বাড়ি শ্মশানের উত্তরে ভাবপুর গ্রামে।আর সিংহমশাই থাকেন, যেদিকে হঠাৎ করে পশ্চিম দিকে বাঁক নিয়েছে দ্বারকেশ্বর, সেই দিকে বিজলকণা গ্রামে। অবনীবাবুর বয়স ৭০ পেরিয়েছে। তারকেশ্বরবাবুর আরেকটু বেশি। দু’জনেই সচল এবং সুস্থ। তল্লাটের লোক জানে দুই বুড়ো একেবারে হরিহর আত্মা । দুই বন্ধুকে “দাবাবুড়ো” নামেই বেশি চেনে লোকে।

এই দুজন বৈকুন্ঠের চায়ের দোকানের দুই নিত্যদিনের খদ্দের। নিত্যদিন না বলে নিত্য রাতের খদ্দের বলাই ভালো। কারণ, বৈকুন্ঠের সঙ্গে সঙ্গে তার দোকানে ওনারাও রাত জাগেন প্রায়শই। রাত তো আর তাঁরা এমনি এমনি জাগেন না। যতক্ষন জাগা ততক্ষণ যুদ্ধ। একেবারে মরণপণ রাম-রাবনের যুদ্ধ। মুখোমুখি দুই জাঁহাবাজ যুযুধান পক্ষ, দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সত্তুরে বুড়ো।মাঝে মধ্যে ক্ষণিকের বিরাম, যুদ্ধবিরতি। সেই ফাঁকে দুই মহারথীর চা-জলপান। চায়ের সঙ্গে অল্পস্বল্প টাযেরও যোগান চালিয়ে যায় বৈকুন্ঠ। খাতির করে সিংহমশাইকে বড় কর্তা আর চাটুজ্জে মশাইকে ছোট কর্তা বলে ডাকে বৈকুন্ঠ।

শ্মশানের নিস্তব্ধ রাতে, বৈকুন্ঠের মাটির গাঁথনি আর টিনে ছাওয়া চায়ের দোকানের মাথার ওপর দিয়ে দ্রুত বয়ে যায় সময়ের স্রোত।দ্বারকেশ্বর নদের ঠান্ডা বাতাস শির শির করে ওঠে ছাতিমের পাতলা ডালে-পাতায়।তার ফাঁক দিয়ে ক্রমে দক্ষিণ-পশ্চিম দিগন্তের কালো আকাশে ঢলে পড়ে নক্ষত্রপুঞ্জ।দোকানের ভিতর মাটির দেয়ালে কেরোসিনের কুপির কাঁপা কাঁপা আলো-আবছাযার আঁকিবুকি। সেখানে একদিকে মাটির বেদিতে মুখোমুখি বসে দুই প্রবীণ দাবাড়ু| ভ্রূক্ষেপহীন। চোখ তাঁদের শতরঞ্চিতে পাতা দাবার ছকে বাঁধা।দোকানের অন্যদিকে মাটির উনুন ঘেঁষে দেয়ালে ঠেস দিয়ে চোখ ঢুলু ঢুলু বৈকুন্ঠ।নজর তার চায়ের কেটলি আর ওই দাবার ছকের দিকে।কালো-সাদা ছকে ৩২ ঘুঁটির প্যাঁচ-পয়জার বিন্দু বিসর্গও সে বোঝে না। কিন্তু হার-জিৎ বিলক্ষন বোঝে।কতক্ষনে খেলার ফয়সালা হয় সেই অপেক্ষায় তার প্রহর কেটে যায়। যুদ্ধ ক্রমে মধ্য গগনে, তারপর শেষমেশ চরমে পৌঁছায়।ফয়সালা একটা চাইই চাই।ফয়সালা হলেই তো লাভ।রাতজাগা সার্থক।বৈকুন্ঠ জানে খেলায় ফয়সালা হলেই রাতে শ্মশানে শব আসবে।চিতা জ্বলবে|সঙ্গে সঙ্গে না হোক পাঁচ-দশ মিনিট ফারাকে হলেও একটা না একটা শব আসবেই শ্মশানে।সেই সঙ্গে রাতের শ্মশানযাত্রীরা। দিনের শ্মশানযাত্রীদের চেয়ে রাতের যাত্রীরা বরাবরই বেশি ব্যবসা দেয়। চা-জলযোগ তো সবাই এই দোকানেই করে। এমনটা কি করে হয়, কেন হয় বৈকুন্ঠ জানে না, কিন্তু হয়। হয়ে আসছে গত বছর পাঁচেক, যবে থেকে এই শ্মশানে চাটুজ্জে মশাই আর সিংহমশাইয়ের রাজযোটক হয়েছে সেই ইস্তক। খেলার নিষ্পত্তি হলো অথচ ম’ড়া এলো না, এমনটা ঘটে দৈবাৎ। এ অবস্থায় খেলায় হারজিত হলেও তা ধর্তব্যে পড়েনা। সারা রাতের চা-জলযোগের খরচ দু’জনই যে যার দিয়ে দেন বৈকুন্ঠকে। তবে সেটা যে শেষ কবে ঘটেছে মনে পড়ে না বৈকুন্ঠের। অবিশ্যি খেলা ভেস্তেও যায় মাঝে-মধ্যে।বৈকুন্ঠ বুঝে যায় সে রাতে আর শবদেহের আশা নেই। ভুল করেও যদি বা আসে বৈকুন্ঠের চা-জলযোগের খরচ যে যার টা মিটিয়ে দেন  চাটুজ্জেমশাই, সিংহমশাই। প্রতি রাতে দাবা খেলা চলে বাজি ধরে দুই কর্তায়। খেলায় প্রতিপক্ষকে কিস্তি মাতও দিতে হবে, সেইসঙ্গে রাতে শ্মশানে ম’ড়াও পুড়তে হবে তবেই ধার্য হবে জিৎ।এই হলো বাজির শর্ত। সেই শর্তে যে হারবে দু’জনের সারা রাতের চা-জলযোগের খরচও তারই। এতো কিছুর সবটা বুঝে উঠতে অনেকটা সময় লেগেছে বৈকুন্ঠের।ম’ড়া এলে, দেহ সৎকার, ঘাটের কাজ, খাওয়া দাওয়া করে শ্মশান ফেরতারা চলে যায় । শ্মশানের পশ্চিম ধারে ডোম হারু বাগদীর টালির ঘরের দোরে খিল পড়ে যায়। তারপর ভোররাতের দিকে বৈকুন্ঠের টাকাকড়ি মিটিয়ে দিয়ে বাড়ির পথ ধরেন দুই নিশাচর বুড়ো।

জগাই চলে যেতেই দোকানে ঢুকে প্রথমে কেরোসিনের হারিকেনটা জ্বাললো বৈকুন্ঠ।প্রতিদিনের অভ্যেস মতো দোকানের বাঁদিকে গোবরে নিকোনো মাটির বেদিতে পরিপাটি করে শতরঞ্চি পেতে তার মাঝখানে রাখল হারিকেনটা । ডানদিকে উনুনের আঁচ ততক্ষনে নিবু নিবু। চটজলদি একঝুড়ি ধানের গোঁজ দিয়ে আগুনটাকে ফের গনগনে করে তুলল সে। কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের রাত।বাইরে বাতাসে শিরশিরে হিমেল ঠান্ডা। শ্মশানে জনপ্রাণী নেই। তাই চায়ের জল না চাপিয়ে রাতের খদ্দেরদের জন্য খাবার তৈরির জোগাড় করছিল বৈকুন্ঠ। সেই সময় দোকানের বাইরে ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে কিছুটা তফাতে জ্বলে উঠলো একটা টর্চ। কয়েকজন মানুষের অস্পষ্ট কথাবার্তা আর পায়ের শব্দ। তারপরেই দোকানের বাইরে হাঁকডাক, “কই রে বৈকুন্ঠ, চা বসা, আমরা এসে পড়েছি।” চেনা গলা পেয়েই হারিকেনটা উস্কে দিলো বৈকুন্ঠ। তড়িঘড়ি উনুনে চায়ের কেটলি চাপিয়ে ভিতর থেকেই চেঁচিয়ে বৈকুন্ঠ বললো, “আজ্ঞে, এই বসিয়েছি ছোট কর্তা। আমি তো আপনাদের কথাই ভাবছিলাম এতক্ষন।”বৈকুন্ঠের কথা শেষ হতে না হতেই দোকানে ঢুকলেন দুই প্রবীণ। দোকানে ঢুকেই কাঁধের ঝোলা হাতড়ে একটা দাবার ছক আর ঘুঁটির কৌটো বের করলেন তারকেশ্বরবাবু। তারপর সোজা মাটির বেদিতে গিয়ে জুৎ করে বসলেন তিনি। বেদিতে পরিপাটি পাতা শতরঞ্চি থেকে হারিকেনটা পাশে সরিয়ে দাবার ছক পেতে ঘুঁটি সাজাতে শুরু করলেন বড়কর্তা। কাঁধের ঝোলাটা গুটিয়ে রাখলেন বেদির এককোনে।বৈকুন্ঠের হাতে পাঁচ ব্যাটারির টর্চটা গছিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে পত্রপাঠ শতরঞ্চিতে সাজানো ছকের সামনে সিংহমশাইয়ের মুখোমুখি গিয়ে বসলেন অবনী চাটুজ্জে। নিজের পাঞ্জাবির হাতা সরিয়ে হারিকেনের অল্প আলোয় হাতঘড়িটা একবার ঝুঁকে পড়ে দেখে নিযেই তাড়া লাগলেন বড় কর্তাকে, “আটটা বেজে গিয়েছে সিংহমশাই। নিন শুরু করুন। আজ আপনার পালা|” কথা না বাড়িয়ে তারকেশ্বর কাঁপা কাঁপা আঙুলে একটা কালো ঘরের বোড়ে এগিয়ে দিলেন দু’ঘর।ব্যাস,শুরু হয়ে গেলো খেলা।

প্রতিরাতে এইভাবেই খেলা শুরু হয় দু’জনের। খেলা গড়াবে কতক্ষন কেউ জানে না। লড়াই চলে প্রায় সমানে সমানে, সেয়ানে সেয়ানে। দু’জনই হাড়েমজ্জায় পোক্ত দাবাড়ু। কেউ কারোকে সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নন।চাটুজ্জে মশাইয়ের হাতঘড়ির কাঁটাগুলোর মতোই হারিকেনের আলোয় দাবার ঘুঁটির লম্বা ভুতুড়ে ছায়াগুলোও শুধুই সরে সরে যায় মাটির দেওয়ালে। একজনের মোক্ষম চালে অন্যজনের কপালে ভাঁজ  গালে হাত পড়ে । উনুনের পাশে বসে হাঁ করে দুই কর্তার রকম সকম দেখে আর হাই তোলে বৈকুন্ঠ।

বড় কর্তা কম কথার ঠোঁটকাটা গোছের মানুষ। আর ছোট কর্তা খামখেয়ালি, ভারী আমুদে। তবে মানুষ হিসেবে দু’জনেই বড় ভালো। খদ্দের হিসেবে আরও ভালো। ধারবাকির বালাই নেই, প্রতিদিন নগদনারায়ণ। তবে ওঁদের ওই দাবার ছকের সঙ্গে শ্মশানের মড়ার কিসের যে নাড়ীর টান ভেবে ভেবেও আজ পর্যন্ত সেইটার কুলকিনারা খুঁজে পেলো না বৈকুন্ঠ। ভাবতে ভাবতে এক ফাঁকে গামছার খুঁটে দু গেলাস গরম লিকার চা আর বিস্কুট শতরঞ্চিতে সাজিয়ে দিয়ে এলো সে। এই রাতে খেলা গড়ালো ভোর রাত্তির পর্যন্ত।শেষে ছোট কর্তার এক মোক্ষম প্যাঁচে ভাঙলো বড়কর্তার রাজার শক্ত ঘাড়। গত ক’দিন ধরে লাগাতার বাজি হারছেন বড়কর্তা। তবে আজকের শোচনীয় হারটা যেন অসহ্য ঠেকলো বড় কর্তার। বারবার মাথার চুল খামচেও ছোটকর্তার সাজানো চক্রব্যূহ ভেঙে বেরিয়ে আসার রাস্তা খুঁজে পেলেন না তারকেশ্বর মশাই। শেষমেশ প্রতিপক্ষের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, “ঠিক আছে ! আজকের মতো হার মানছি। কিন্তু মনে রেখো ভায়া এর পরদিন আমিও তোমার এই অবস্থাই করবো।”বড় কর্তার কথাতে যথেষ্ট কৌতুকের খোরাক পেয়েও মনের ভাব যথাসাধ্য নিজের মধ্যেই চেপে রাখলেন অবনী চাটুজ্জে।

খেলা শেষ হলে ব্যাজার মুখে ছক আর ঘুটি গুটিয়ে ঝোলায় পুরলেন বড়কর্তা। একটা বাজখাঁই হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে তারকেশ্বর বললেন, “বয়লে চাটুজ্জে ভায়া। ভাবছি কাল একবার বাজুয়ায় মেয়ের বাড়িতে ঘুরে আসবো। এবারও পুজোর সময় বাড়িতে এসে জামাই বারবার ক’রে যেতে বলে গিয়েছে। যাওয়া আর হয়নি কো।” ছোট কর্তা বিলক্ষন জানেন, বাজুয়া তো দূরের কথা, গত পাঁচ-সাত বছরে বিজলকণা, বাগাড়পাড় বড়োজোর ভাবপুর, এর বাইরে কোথাও পা মাড়াননি  সিংহমশাই। তাঁর কথায় মুচকি হেসে অবনীবাবু বললেন, “বেশ তো দাদা যান না। তা এই বাগপাড়ের দাবার ছক ফেলে রেখে সেখানে কি আপনার মন বসবে?””দেখি মন বসে কি না।” জবাব দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন তারকেশ্বর। বন্ধুর কথায় কি একটা ইঙ্গিত পেয়ে ছোটকর্তা বললেন, “সিংহমশায়, বলি কি, দাবার ছকটা আপনি আমায় দিয়ে যান। মেয়ের বাড়িতে যদি আপনার মন না বসে সটান চলে আসবেন। আমি ছক সাজিয়ে এখানেই বসে থাকবো।”

স্বল্পভাষী তারকেশ্বর ঝোলা থেকে দাবার ছক আর ঘুঁটি বের করে শতরঞ্চিতে রাখলেন। তারপর মাথা হেলিয়ে বললেন, “বেশ তো তাই রাখো। ভোর হতে আর দেরি নেই।এবার চলো বাড়ি ফিরি।” দাম পত্তর মিটিয়ে চলে গেলেন দুই কর্তা ।

পরপর দুটো রাত পেরিয়ে গিয়েছে। বৈকুন্ঠের দোকানে শতরঞ্চিতে দাবার ছক সাজিয়ে বসে রয়েছেন চাটুজ্জেমশাই।সিংহমশাইয়ের দেখা নেই| একজন খদ্দেরকে জলখাবার দিতে দিতে বৈকুন্ঠ বলল, “এতো আকাশ পাতাল কি ভাবতিছেন ছোট কর্তা?” বৈকুন্ঠের কথায় যেন ধ্যান ভাঙল তাঁর। একটু চুপ করে থেকে অবনীবাবু বললেন, “আজ আর কিছুই ভালো লাগছে না রে বৈকুন্ঠ। তোর বড় কর্তার কাছেই তো আমার দাবা খেলার হাতেখড়ি।অথচ আমার কাছেই কি না বারবার হারে বুড়োটা।মাঝে মাঝে মনে হয় জোর করে হেরে যাই। সিংহমশাই খুশি হবেন।কিন্তু দাবা খেলায় ইচ্ছে করে কেউ কি হারতে পারে? হারজিত পুরোটাই তো ওপরওয়ালার হাতে। আমরা তো কলের পুতুল রে ।” ছোট কর্তার কথার মাথামুন্ডু কিছুই না বুঝতে পেরে বোকার মতো মাথা নাড়লো বৈকুন্ঠ। আমতা আমতা করে বললো, “আমি বলি কি ছোট কর্তা। আমারে আপনি দাবা খেলাটা শেখায় দ্যান।আজ না হয় আমার সঙ্গেই একদান —– “কথা শেষ হলো না বৈকুন্ঠের, চাটুজ্জেবাবু খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “থাম তুই । দাবা খেলার তুই কি বুঝিস?ওরে এ হলো গিয়ে রাজা-রাজড়ার খেলা । এ খেলায় কত বুদ্ধি লাগে তা জানিস?সে বুদ্ধি আছে তোর ঘটে?” অবনী চাটুজ্জের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কাছে পিঠে কোথাও একটা শেয়াল ডেকে উঠলো।তার একটানা ডাকে রাতের শ্মশানের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে গেলো।তারপর আবার সব চুপচাপ।শুধু ছাতিম গাছের চওড়া পাতা চুঁয়ে বৈকুন্ঠের দোকানের টিনের চালে সমানে হীম পড়ে চলেছে ‘টপ’ ‘টপ’ শব্দে ।শতরঞ্চিতে সাজানো দাবার ছকের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে গালে হাত দিয়ে কি যেন ভেবেই চলেছেন অবনীবাবু ।পাশে গেলাসের গরম চা জুড়িয়ে গিয়েছে অনেকক্ষন ।

প্রায় ঘন্টাদুয়েক পর মুখ খুললো বৈকুন্ঠ । সে বললো, “বড় কর্তা বোধ করি মেয়ের বাড়িতে গিয়ে নাতি নাতনিরে পেয়ে মজে গিইয়েছেন।আজও তিনি ফেরেননি।আপনি বরং বাড়ি চলে যান ছোট কর্তা।” বৈকুন্ঠের কথাগুলো কানে উঠলো না চাটুজ্জে মশাইয়ের। তিনি একভাবে বসেই রইলেন। তাঁর কেন যেন মনে হচ্ছে বড় কর্তা মেয়ের বাড়ি যাননি। আজ তিনি ঠিক আসবেন ।

চাটুজ্জেমশাই ভুল ভাবেননি। বড় কর্তা অবশেষে এলেন। রাত্তির সাড়ে দশটার পর। চোখমুখ শুকনো, চুল উস্কো খুস্কো। কাঁধের ঝোলা উধাও। গায়ের ফতুয়াটা কোঁচকানো, দোমড়ানো, আধভেজা, নোংরা কাদা মাখা। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। দোকানে ঢুকেই সটান বেদিতে পাতা শতরঞ্চিতে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লেন, একেবারে চাটুজ্জে মশাইয়ের মুখোমুখি। শুধু বৈকুন্ঠই নয় বড়কর্তার ভাবগতিকে হকচকিয়ে গিয়েছেন চাটুজ্জেবাবুও। বৈকুন্ঠ জিজ্ঞাসা করলো, “এ কি চেহারা করিছেন বড় কর্তা! শরীর গতিক খারাপ না কি?” মুখে কিছু না বলে ইশারায় বৈকুন্ঠের কাছে এক গ্লাস জল চাইলেন বড় কর্তা। জল খেয়ে তারকেশ্বরবাবু খানিক ধাতস্থ হলে পর চাটুজ্জেবাবু জানতে চাইলেন, “মেয়ের বাড়ি থেকে কবে ফিরলেন সিংহমশাই?”জবাবে বড় কর্তা বললেন, “যাবো বলেই তো বেরিয়েছিলাম।তা যাওয়া আর হলো কই।হতচ্ছাড়াটা এ-ম-ন টেনে ধরলো যে—।”বন্ধুকে ব্যাঙ্গের সুরে বললেন চাটুজ্জেবাবু, “এই বয়সে কে আপনাকে টেনে ধরলো—?তা মেয়ের বাড়ি যাননি যখন এখানে এলেই তো পারতেন।”এবার কথা এড়িয়ে গম্ভীর স্বরে তারকেশ্বরবাবু বললেন, “নাও শুরু করো চাটুজ্জে । আজ কিন্তু তোমার পালা।” চাল দিতে দিতে উপযাজকের মতো অবনীবাবু বললেন, “ফতুয়াটা তো বেশ ভিজিয়েছেন দেখছি।কি করে যে ভেজালেন মা গঙ্গাই জানেন। তা ভিজিয়েছেন বেশ করেছেন, এখন ওটা খুলে বৈকুন্ঠকে দিয়ে দিন না| উনুনের পাশে রেখে শুকিয়ে দিক। এই ঠান্ডায় ওটা পড়ে থাকলে অসুখ করবে যে।”

ছোট কর্তার শাসনে কান না দিয়ে দাবার চাল দিতে থাকলেন তারকেশ্বরবাবু। খেলার ফাঁকে দুই কর্তার চা দিতে দিতে বৈকুন্ঠর হঠাৎ মনে হলো, আর দিনের চেয়ে আজ অনেক তাড়াতাড়ি চাল দিচ্ছেন না বড় কর্তা! যেন ছোট কর্তার চাল দেয়ার অপেক্ষা মাত্র। খেলা কিছুক্ষন গড়াতে চাটুজ্জেবাবুও টের পেলেন পার্থক্যটা। আজ তাহলে কোমর বেঁধেই এসেছেন বড় কর্তা, মনে মনে ভাবলেন চাটুজ্জেবাবু। এতটুকু না ভেবে অসম্ভব তাড়াতাড়ি চাল দিচ্ছেন আজ সিংহমশাই। তাঁর প্রতিটা চাল আজ প্রায় নিখুঁত আর ছুরির মতন ধারালো। বড় কর্তার নৌকা, গজ আর ঘোড়ার উপর্যুপরি আক্রমণে আধঘন্টার মধ্যে রীতিমতো ত্রাহি ত্রাহি রব উঠলো চাটুজ্জেমশাইয়ের রাজার শক্ত দুর্গে। কি চাল দেবেন তিনি? তাঁর সমস্ত পরিকল্পনাই যেন আগেভাগে জেনে বসে আছেন সিংহমশাই।এমন অদ্ভুত ছবির মতো চাল নিজে তো নয়ই আগে কোনো দাবাড়ুকে কখনো দিতে দেখেননি অবনীবাবু। মনে মনে সিংহমশাইয়ের তারিফ না করে পারলেন না ছোট কর্তা। খেলা যত গড়াচ্ছে চাটুজ্জেমশাই বুঝতে পারছেন তাঁর অবস্থা ক্রমশ কোনঠাসা হচ্ছে।এভাবে অবিশ্যি খেলা বেশিদূর আর গড়ালো না। তারকেশ্বরের ১৮ নম্বর চালে সব নড়াচড়া যেন বন্ধ হয়ে গেলো চাটুজ্জেমশাইয়ের। চালটা কিভাবে সামাল দেয়া যায় গালে হাত দিয়ে অবনীবাবু তাই ভাবছেন। এমন সময় কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে তারকেশ্বরবাবু বললেন, চেক মেট। ভায়া এবার তুমি বাঁচার পথ ভাব।আমি ততক্ষন ঘাটে গিয়ে একটু নদীর হাওয়া খেয়ে আসি।এই বলে চায়ের গেলাসে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে দোকান ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি।ব্যস্ত হয়ে বৈকুন্ঠ বলে উঠলো, “ছোট কর্তার টর্চটা নে যান বড় কর্তা—-“।দোকানের বাইরে থেকে চেঁচিয়ে বললেন তারকেশ্বরবাবু, “লাগবে না —-।” আরো কিছুক্ষন মাথা ঘামানোর পর অবনীবাবু বুঝলেন, মোক্ষম চালে তাঁর খেলা শেষ করে দিয়েছেন সিংহমশাই। মনে মনে খুশি হয়ে উঠলেন চাটুজ্জেমশাই। ভাবলেন, কখনো কখনো হেরেও যে কি সুখ সে কি সবাই জানে? বৈকুন্ঠ কুপির আলোয় দোকানের হিসেবের খাতা লিখছিলো। অবনীবাবু তাকে বললেন, “বৈকুন্ঠ, যা বড় কর্তাকে ঘাটের ধার থেকে ডেকে নিয়ে আয়। বল, ছোট কর্তা হার মেনেছেন।”

বৈকুন্ঠ বড় কর্তাকে ডাকতে বেরিয়ে গেলে হাতঘড়িতে সময় দেখলেন অবনীবাবু। একী! সবে রাত ১১ বেজে ১০ মিনিট! মাত্র চল্লিশ মিনিট দাবা খেলেছেন তাঁরা! মাত্র ৪০ মিনিটে কিনা অবনী চাটুজ্জের দুর্গের পতন হলো! ভাবা যায়! চায়ের গেলাসে চুমুক দিয়ে তারকেশ্বর সিংহের শেষ চালগুলোর কথাই ভাবছিলেন অবনীবাবু।এমন সময় দূর থেকে তাঁর কানে ভেসে এলো, “হরি বল” ধ্বনি। কারা যেন শবদেহ নিয়ে আসছে। আওয়াজটা কাছে আসতেই দোকানে এসে ঢুকলো হারু বাগদি। সঙ্গে কয়েকজন শ্মশানযাত্রী। তাদের মধ্যে দু’একজনকে চিনতে পেরেই আঁতকে উঠলেন চাটুজ্জে মশাই।বুকটা হঠাৎ ছ্যাঁৎ করে উঠলো তাঁর। চাটুজ্জে মশাই তাঁদের কিছু জিজ্ঞাসা করবেন তার আগেই নির্বিকার নিরুত্তাপ গলায় হারু বলে উঠলো, “আপনার বন্ধু তো চলে গেলেন ছোট কর্তা।” কথাটা যেন বজ্রপাতের মতো মনে হলো অবনীবাবুর। নিমেষে মাথার ভিতরটা সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেলো তাঁর।যারা দোকানে এসেছিলো, বৈকুন্ঠ নেই দেখে তারা সবাই চলে গেল। সাজানো দাবার ছকের সামনে আধো আলো-অন্ধকারে একা পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলেন অবনী চাটুজ্জে। বেশ কিছুক্ষন পর হাঁফাতে হাঁফাতে বৈকুন্ঠ এসে দোকানে ঢুকলো। ধরা গলায় সে বললো, “বড় কর্তা মারা গিয়েছেন ছোট কর্তা। শ্মশানে তেনার বডি এয়েচে।” কিছুক্ষন দাবার ছকের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন চাটুজ্জেমশাই। কাঁপা কাঁপা গলায় বৈকুন্ঠকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছিল ওনার ?”বৈকুন্ঠ জবাব দিলো, “মেয়ের বাড়ি যাবেন বলে বেইরেছিলেন পরশু দুপুরে। নদীর ঘাটে মাঝির ভুলে পাটাতন হড়কে এক্কেরে —–।” কথা শেষ হলো না, বৈকুন্ঠর। তার চোখে পড়লো শতরঞ্চির পাশে বড় কর্তার চায়ের গেলাসটা| সেভাবেই পড়ে রয়েছে সেটা ।তখনও গরম ধোঁয়া বেরোচ্ছে তা থেকে।

Published on: নভে ১০, ২০১৯ @ ১২:২৩


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

− 3 = 1