পুজোয় ঘুরে আসুন শ্রীমায়াপুরধাম, মিলবে দারুন অনুভূতি

Main দেশ ধর্ম ভ্রমণ রাজ্য
শেয়ার করুন

Published on: অক্টো ১৮, ২০২৩ at ২০:০৯
লেখক: রসিক গৌরাঙ্গ দাস

এসপিটি বিশেষ প্রতিবেদন:  শুভ্র কাশের বন। নীল আকাশ। শিশির সিক্ত শিউলি। পেজা তুলোর মতো মেঘের আনাগোনা। শ্রাবণ সিক্ত প্রকৃতি অপরূপা। যেন আনন্দময়ীকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।ঘরে ঘরে মহানন্দের প্লাবন। শরতের নির্মল রৌদ্রজ্জ্বল প্রকৃতির স্পর্শে প্রাণের উচ্ছ্বাস। শারদীয়া উৎসব মুখর দিনগুলি হয়ে উঠবে রোমাঞ্চকর। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে মন চায় কোথাও বেরিয়ে পড়তে। স্বল্প সময়ে স্বল্প খরচে একবার ঘুরেই যান না? সবান্ধবে সপরিবারে একবার পরখ করে দেখেই যান না? শহরের কোলাহল থেকে দূরে, সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত পরিবেশ, মানুষের হাতে গড়া মন্দিরময় শ্রীমায়াপুর ধাম। পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরে, কলকাতা থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে। রাস্তার ধারে ধারে গাছের ছায়ায় আলপনা আঁকা। গঙ্গার তীরে তীরে অসংখ্য কাশ ফুলে মুক্ত বাতাসের হিন্দোলে মন উদাস হয়ে যায়। সীমাহীন সবুজের সমারোহে – যা আপনাকে দিতে পারে অন্য অনুভূতি। এমন অনিন্দ্যসুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ যে কোনও মানুষকে বেঁধে ফেলতে পারে যখন তখন। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড, যেখানে পতিত পাবন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর প্রচারিত কৃষ্ণনাম সমগ্র বিশ্বকে এক সূত্রে গাঁথতে পেরেছে।

এখানে ভাগীরথী-কুলকুল ধ্বনিতে বয়ে চলেছে মহাসাগরের দিকে, অপরপ্রান্তে জলঙ্গী-নদী অফুরন্ত জলরাশি নিয়ে মিলেছে এখানে। দুই নদীর সঙ্গম স্থলে চাঁদনী রাতে নৌকা বিহার আপনাকে দিতে পারে অনাবিল আনন্দ। দুই নদীর জলধারার রঙ-ই আলাদা।

মায়াপুর-নবদ্বীপের প্রধান আকর্ষণ ইসকন-শ্রীমায়াপুর চন্দ্রোদয় মন্দির। যেখানে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পঞ্চতত্ত্ব-বিগ্রহ( শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু, শ্রীঅদ্বৈত আচার্য, শ্রীগদাধর পন্ডিত এবং শ্রীবাস পন্ডিত)। এই পাঁচ বিগ্রহের মিলিত ওজন ১৭,০০০ কেজি। উচ্চতা বেদি সমেত ৯ ফুট সম্পূর্ণ নিখাদ অষ্টধাতু দ্বারা নির্মিত হয়েছে তামিলানাড়ুর কুম্ভকোনমে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ বিগ্রহগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন ওয়ার্ল্ড গিনেস বুকে নাম ওঠার অপেক্ষায়। এছাড়া রয়েছে রাধাকৃষ্ণ, অষ্টসখী ও নৃসিংহ দেবের বিগ্রহ এবং ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য এ সি ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের অপূর্ব সুন্দর বিগ্রহ। সারা বিশ্বের শ্রদ্ধালু ভক্তি ভাবনার মানুষ ছুটে আসেন এখানে শান্তির সন্ধানে, অমৃতের সন্ধানে। মায়াপুর পরিণত হয় মিনি ওয়ার্ল্ডে। সকলের মুখেই উচ্চারিত হয় হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র। এ যেন এক অন্য জগৎ।

দর্শনীয় স্থানঃ প্রভুপাদের পুষ্প সমাধি মন্দির, পশ্চিমবঙ্গের মন্দির সমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত। এ মন্দির এশিয়া মহাদেশের মধ্যে মর্মর আস্তরণে বর্নাঢ্য বৃহত্তম গম্বুজ অভ্যন্তরের জন্য বিখ্যাত। মন্দিরের দোতলায় আছে প্রভুপাদের জীবন ও কর্মকান্ডের উপর আধারিত এক অনিন্দ্য সুন্দর প্রদর্শনী।

গুরুকুলঃ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ছাত্ররা এখানে বৈদিক পদ্ধতিতে পড়াশোনা করে।

গোশালাঃ বিভিন্ন জাতের ৫০০তি গরু আছে। এখানে গো সংরক্ষণ করা হয়। প্রতিটি গরুকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এখানে সযত্নে পালন করা হয়।

ভজন কুটিরঃ ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য প্রভুপাদ প্রথম এই কুটিরেই থাকতেন। এখানে ১৯৭২ সাল থেকে সারা বছর ধরে নন স্টপ হরিনাম সংকীর্তন চলছে বিশ্ব কল্যানের জন্য এবং শ্রীশ্রী গৌরনিতাই বিগ্রহের নিত্য পুজো হচ্ছে।

এছাড়া রয়েছে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী ও শিক্ষা সম্বন্ধীয় প্রদর্শনী। প্রভুপাদের আবাসগৃহ। ইসকন মন্দিরের আরতি, দর্শন, সন্ধ্যারতি, পূজার্চ্চনা- অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর এবং নয়নাভিরাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভক্তবৃন্দের সম্মিলিত সংকীর্ত্তন আপনাকে দেবে অনাবিল আধ্যাত্মিক আনন্দ।

গড়ে উঠতে চলেছে বৈদিক প্ল্যানেটরিয়ামঃ পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলায় ইসকনের প্রধান কেন্দ্র মায়াপুরে গড়ে উঠতে চলেছে বিশ্বের বৃহত্তম হিন্দু মন্দির (Vedic Planetarium)। ২০১০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এই মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু হয়। এই মন্দিরের উচ্চতা ১১৩মিটার। এই মন্দিরটিতে রয়েছে ৩টি গম্বুজ। এই প্ল্যানেটরিয়ামে প্রধান গম্বুজটি বিশ্বের যেকোনও ধর্মীয় কাঠামোর দীর্ঘতম এবং প্রশস্ত গম্বুজ। এই প্ল্যানেটরিয়ামে ভগবদগীতার বিব্রণ অনুসারে মহাবিশ্বের সৃষ্টি তত্ত্বকে চিত্রিত করবে।

কি কি দেখবেন মায়াপুর ও তার সংলগ্ন এলাকায়

বহিরাগত দর্শনার্থীদের রাত্রি যাপনের সুন্দর ও নিরাপদ সুব্যবস্থা রয়েছে অতিথি ভবন ও ধর্মশালায়।প্রায় তিন হাজার অতিথি থাকতে পারেন মন্দির চত্ত্বরে। অতিথিদের জন্য সুস্বাদু-উত্তম নিরামিষ ভোগ প্রসাদের ব্যবস্থা আছে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার ভক্তবৃন্দ ভোগ প্রসাদ করে থাকেন। তা ছাড়া মন্দির চত্বরে রয়েছে দেশ-বিদেশের খাবার সমৃদ্ধ গোবিন্দ রেষ্টুরেন্ট সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শ্রীধাম মায়াপুর মন্দিরময় পরিবেশে থেকে দু-পা হেঁটে গেলে গ্রামের মনোমুগ্ধকর পরিবেশে দেখতে পাবেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান, মাসির বাড়ি, শ্রীবাস অঙ্গন, ভক্ত চাঁদকাজীর সমাধি, ঐতিহাসিক বল্লাল সেনের ঢিপি, মায়াপুরের গঙ্গা মায়ের মন্দির ও রাজাপুরের প্রসিদ্ধ জগন্নাথ মন্দির ইত্যাদি। গঙ্গার অপর পাড়ে রয়েছে সোনার গৌরাঙ্গ, মহাপ্রভু মঠ, বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্মস্থান ইত্যাদি।

কৃষ্ণনগরে রয়েছে রাজবাড়ি, মৃৎশিল্পের পীঠস্থান ঘূর্ণি, রসনা তৃপ্তির জন্য পরখ করে দেখতে বপারেন কৃষ্ণনগরের সরভাজা, সরপুরিয়া এবং নবদ্বীপের ক্ষীর, দই।

এবার পুজোয় আসুন মায়াপুরে। শহরের কোলাহল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, নিখাদ শান্ত, নির্মল পরিবেশে ইসকন মন্দির সেজে উঠেছে অতিথিকে স্বাগত জানাতে।

পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, নিখুঁত সাজানো ফুলের বাগান, ফোয়ারা কেয়ারি, মোহময় কৃষ্ণনাম পৌঁছে দেবে শান্তির সাম্রাজ্যে। মন্দিরে অবস্থান কালীন প্রতিটি মুহূর্ত অতিথিদের মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে চিরদিন।

পথ নির্দেশিকা:

১) কলকাতার ধর্মতলা থেকে মায়াপুর আসার বাসের ব্যবস্থা আছে।

২) শিয়ালদহ কিংবা নৈহাটি স্টেশন থেকে কৃষ্ণনগর বা নবদ্বীপ ট্রেনে আসতে পারেন।কৃষ্ণনগর স্টেশনে এসে সেখান থেকে অতো কিংবা টোটোয় চেপে সোজা মায়াপুর ঘাট। ঘাট পেরিয়ে মায়াপুর।

৩) হাওড়া ও ব্যান্ডেল সেটেশন থেকে নবদ্বীপ ট্রেনে আসতে পারেন।

৪) কৃষ্ণনগর থেকে বাসে মায়াপুর এবং নবদ্বীপ আসা যায়।

৫) নবদ্বীপ ও মায়াপুরে নৌকায় যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে।

৬) আর সমস্ত মন্দির ও স্থানীয় স্থান ভ্রমণের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিতে পারেন-রিকশা, টোটো অথবা ভ্যান গাড়ি।

তাই নিশ্চিন্ত মনে মায়াপুর ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়ুন এবং সেই সঙ্গে তীর্থভ্রমণের সাধ পূরণ করুন।

মায়াপুর চন্দ্রোদয় মন্দিরের প্রবেশদ্বার।
মায়াপুর ইসকনে প্রবেশের মুখে ভজন কুঠিরে চলছে অখণ্ড হরিনাম সংকীর্তন।
মায়াপুর ইসকন প্রাংগনে তীর্থযাত্রীদের অনুদন্ধান কেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে বহু ভক্ত।
মায়াপুর ইসকন -এ চন্দ্রোদয় মন্দিরে যাওয়ার।
মায়াপুর ইসকন এ কোঠায় কি আছে তার দিক নির্দেশ।
মায়াপুর ইসকন পরিক্রমায় প্রতিষ্ঠাতা ভক্তিবেদান্ত প্রভুপাদ ও গৌর-নিতাই।
মায়াপুর ইসকনে হাতি পরিক্রমা।
মায়াপুর ইসকন চত্বরে একাধিক স্থানে প্রসাদের কাউন্টার।
এমনই একটি কাউন্টার রাধেজ প্রসাদম।

লেখক পরিচিতি: মায়াপুর ইসকনের জনসংযোগ আধিকারিক

Published on: অক্টো ১৮, ২০২৩ at ২০:০৯


শেয়ার করুন