
Published on: ফেব্রু ২৬, ২০২৫ at ১৭:১৮
Reporter: Dr. Soumitra Pandit
এসপিটি নিউজ, কলকাতা, ২৫ ফেব্রুয়ারি: বিজ্ঞানের জয়যাত্রার সাথে সাথে পরিবেশের মধ্যে নানান ধরনের রোগ জীবাণু ও পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। যার ফলে মানুষ আজ দিশেহারা ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। আজ পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলগেছিয়া ক্যাম্পাসের ‘বিবেক হলে’ অনুষ্ঠিত হল এক বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা সভা। বর্তমানে গুলেন বারি সিনড্রোম (Guillain-Barré Syndrome বা GBS) নামক একটি বিরল স্নায়বিক রোগ, যেখানে শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, নিজস্ব স্নায়ুতন্ত্রের উপর আক্রমণ করে, ফলে পেশী দুর্বলতা এবং পক্ষাঘাতের মতো উপসর্গ দেখা দেয়। ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, ডেঙ্গি জ্বরের পরবর্তী জটিলতা হিসেবে GBS-এর ঘটনা ঘটছে। এমনকি ডেঙ্গি থেকে সেরে ওঠার পর GBS-এ আক্রান্ত হয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটছে।
সম্প্রতি, পুণেতে GBS-এর প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া গেছে, যা বাংলাতেও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ।তাই মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চে্ পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বিজ্ঞান সভার’ উদ্যোগে – গুলেন বারি সিনড্রোম (GBS) নিয়ে আলোচনার আয়োজন করা হয়। আজ এই অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, আধিকারিক, কর্মচারী এবং আরও নানান স্তরের বিজ্ঞান মনোযোগী বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ মিলে প্রায় 250 জন সভাগৃহে উপস্থিতি ছিলেন।
এই আলোচনা সভার উদ্বোধক, তথা পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ তীর্থ কুমার দত্ত বলেন, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গেলে বিজ্ঞান চর্চার সাথে প্রশ্ন করতে জানতে হবে। যত প্রশ্ন করা যাবে, বিজ্ঞানের নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হবে, যা আগামী দিনে ছাত্র –শিক্ষক- গবেষককে বিজ্ঞান গবেষণার নতুন দিশা দেখাবে। তাই প্রশ্ন-উত্তরে বিজ্ঞান আলোচনা ও সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনবরত এবং ধারাবাহিক বিজ্ঞান চর্চার প্রয়োজন। জি বি এস নিয়ে সকলের মনের মধ্যে যে প্রশ্ন সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য বিজ্ঞান মঞ্চের এই উদ্যোগকে তিনি সাধুবাদ জানান।
আজ এই আলোচনার মুখ্য বক্তা ছিলেন বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ তমোনাশ ভট্টাচার্য। তিনি বলেন (Guillain-Barré Syndrome বা GBS) হল একটি বিরল কিন্তু গুরুতর অটোইমিউন নিউরোলজিক্যাল রোগ, যেখানে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (ইমিউন সিস্টেম ) ভুল করে নিজের স্নায়ু কোষগুলোর উপর আক্রমণ করে। এর ফলে পেশি দুর্বল হয়ে যায়, কখনো কখনো সম্পূর্ণ পক্ষাঘাত ও হতে পারে।
এই রোগের কারণ হিসেবে তিনি জানান, সাধারণত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের পর এই রোগ দেখা দেয়। এটি মূলত ইমিউন সিস্টেমের অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার কারণে হয়। যেমন, ক্যাম্পিলোব্যাকটার জেজুনি (Campylobacter jejuni) ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, ফ্লু বা অন্যান্য ভাইরাল সংক্রমণ (যেমন: করোনাভাইরাস, জিকা ভাইরাস, Hepatitis E virus, HIV, Haemophilus influenza, Cytomegalo virus etc), অস্ত্রোপচার বা টিকাদানের পর বা অন্য কোনো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সংক্রান্ত সমস্যা।
উপসর্গ হিসেবে, পায়ের পেশি দুর্বল হওয়া (দুই পায়ে সমানভাবে বা বাইলেটারেল সিমেট্রিক্যাল) এবং ধীরে ধীরে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, ঝিনঝিন বা অসাড় অনুভূতি হতে থাকে, ভারসাম্য হারানো বা চলাচলে সমসঠাক হয়।শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া (গুরুতর ক্ষেত্রে), রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দনের পরিবর্তন ইত্যাদি।
তিনি বলেন, GBS-এর কোনও নির্দিষ্ট প্রতিষেধক নেই, তবে চিকিৎসার মাধ্যমে লক্ষণগুলো কমানো যায় এবং পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত করা যায়। সাধারণ – ইমিউনোগ্লোবুলিন থেরাপি (IVIG), প্লাজমা এক্সচেঞ্জ (Plasmapheresis) ইত্যাদি। এই রোগের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। অধিকাংশ রোগী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে, তবে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে কয়েক মাস থেকে বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে রোগীর স্থায়ী দুর্বলতা থেকে যেতে পারে।
ড. ভট্টাচার্য বলেন, খাবারের মাধ্যমে যেহেতু শরীরে এই রোগের প্রবেশ ঘটে, তাই হজম জনিত সমস্যা হলে দ্রুত ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিয়ে নুন্যতম দশ দিনের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। শ্বাস, হৃদযন্ত্র, বিভিন্ন অঙ্গের পেশীর কার্যাবলীর মধ্যে অসামঞ্জস্যতা দেখা গেলে রোগের বিস্তার ঘটে থাকে। স্টেরয়েডের মাধ্যমে এই রোগের চিকিৎসায় জটিলতা বাড়ে , তাই সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা জরুরী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইমিউনোগ্লোব্যুলিন জাতীয় শারীরিক প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে এই রোগ প্রতিরোধ করা যায়। তবে, শুদ্ধ পানীয় জল পাণ এবং ঠিকভাবে রান্না করা খাবার খেলে রোগের প্রকোপ অনেকটাই কমানো যায়। GBS-এর উপসর্গগুলির মধ্যে পায়ে দুর্বলতা থেকে শুরু হয়ে শরীরের উপরের অংশে ছড়িয়ে পড়া, পেশীতে ব্যথা এবং শ্বাসকষ্ট অন্তর্ভুক্ত। প্রাথমিক লক্ষণগুলি দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত, কারণ সময়মতো চিকিৎসা GBS-এর জটিলতা কমাতে সহায়তা করে। সুতরাং, সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে GBS-এর ঝুঁকি কমানো সম্ভব। তাই ভয় না পেয়ে সতর্ক হোন এবং জীবনের ঝুঁকি না নিয়ে নিরাপদে থাকুন।
অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন অধ্যাপক রিপন বিশ্বাস। আলোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য বর্ণনা করে বিজ্ঞান মঞ্চের কলকাতা জেলা সম্পাদক শেখ সোলেমান ও অধ্যাপক চঞ্চল দেবনাথ জানান জি. বি .এস . নিয়ে অযথা ভীত না হয়ে রোগের কারণ ও বিস্তার সঠিক ভাবে জানার জন্য এই উদ্যোগ। তিনি আরও বলেন যে আগামী দিনে এরকম আলোচনা সভা যাতে আরও বেশি করে আয়োজন করা যায় তার চেষ্টা বিজ্ঞান সভা করবে। আলোচনার শুরুতে বিজ্ঞান সভার অনলাইন পত্রিকা “বিজ্ঞান-e” প্রদর্শনের করে উপস্থিত সকলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে যুক্তিবাদী আন্দোলনে যুক্ত থাকার আহ্বান জানান বিজ্ঞান মঞ্চের কলকাতা জেলা কাউন্সিল সদস্য অধ্যাপক প্রদীপ কুমার দাস মহাশয়। স্বাগত ভাষণ দেন বিজ্ঞান সভার সভাপতি অধ্যাপক সমর হালদার এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে আলোচনার সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন অধ্যাপক জয়দীপ মুখার্জী ।
Published on: ফেব্রু ২৬, ২০২৫ at ১৭:১৮