খাদ্যবিজ্ঞানকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠল বিজ্ঞানমেলা থেকে

Main দেশ বন্যপ্রাণ বিদেশ রাজ্য স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান
শেয়ার করুন

Published on: ডিসে ২৬, ২০২৪ at ২৩:৩১
Reporter: Aniruddha Pal & Dr. Soumitra Pandit

এসপিটি নিউজ, কলকাতা, ২৬ ডিসেম্বর: মাছ, মাংস, ডিম থেকে প্রাণিজ খাদ্যের ভূমিকা নিয়ে এক সুন্দর আলোচনায় উঠে এল অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। সেখানে যেমন পাঠ্যপুস্তকে খাদ্যবিজ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব তোলা হল ঠিক সেরকম ভাবে উঠে এল প্রানিজ খাদ্যের প্রোটিন ভেজিটেবল জাতীয় খাবারের প্রোটিনের তুলনায় চেয়ে বেশি। রেসিপি হিসাবে মাংসের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের পরিমান এতটাই কম যে তা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য।

দুগ্ধশিল্প বিশেষজ্ঞ ড. অসিতাভ শুর ভেজিটেরিয়ানদের শ্রেণীবিন্যাস করেন

কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু হল তৃতীয় আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় স্মারক বিজ্ঞান মেলা। শোভাযাত্রার মধ্যে দিয়ে এদিন এই মেলা ও প্রদর্শনীর সূচনা হয়। এরপর সেখানে স্বাস্থ্যের জন্য প্রাণীজ খাদ্যের ভূমিকা বিষয়ে এক আলচনা চক্রের আয়োজন করা হয়। আলোচনা সভাটি সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন দুগ্ধশিল্প বিশেষজ্ঞ ড. অসিতাভ শুর। তিনি আলোচনার শুরুতে মাচ-মাংস,দুধ, ডিম, মধু স্বাস্থ্যের জন্য কততা প্রয়োজন এবং তাতে কোনও অসুবিধা আছে কিনা তা নিয়ে শুরু করেন। তিনি এই প্রসঙ্গে নন-ভেহিটেরিয়ান আর ভেজিটেরিয়ানের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেন। নিজেকে নন-ভেজিটেরিয়ান বলে ভেজিটেরিয়ানদের সম্পর্কে প্রশ্নচিহ্ন তোলেন। বলেন যে ভেজেটেরিয়ান অনেক রকমের হয়।  শুধু দুধ খাবে কিন্তু তারা বলে নাকি ভেজিটেরিয়ান। এরা হল ল্যাকটো ভেজিটেরিয়ান। ল্যাকটো ওহো ভেজিটেরিয়ান- মানে দুধ-ডিম খাবো কিন্তু ভেজিটেরিয়ান। পেজিটেরিয়ান- তারা হল মাছ খাবে কিন্তু ভেজিটেরিয়ান। ফ্লেক্সিটেরিয়ান- তারা হল বাড়িতে মাছ-মাংস খায় না। কিন্তু বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে হোটেলে গিয়ে খায়। এই ভেজিটেরিয়ানের সংখ্যা বিশ্বে সবচাইতে আমাদের দেশে বেশি।  আমাদের দেশে মোট জনসংখ্যার ২০-৩৯ শতাংশ হল ভেজিটেরিয়ান।  তবে এটা সব মিলেমিশে। ১৯৪৪ সালে ডোনাল্ড ওয়াটসন নামে এক ব্যক্তি বললেন প্রাণিজাত কোনও কিছুই ব্যবহার করা যাবে না। দুধ, ডিম মধু এমনকি উল ব্যবহার করা যাবে না। তাদের একটা গ্রুপ তৈরি হল- এদের নাম হল ভেগার। এরপর এল ‘পেটা। এরপর তিনি বিশেষজ্ঞদের কাছে প্রশ্ন রাখেন যে মাচ, মাংস, ডিম কি খাওয়া যাবে? সেই প্রশ্নের উত্তর দেন একে কে উপস্থিত বিশেষজ্ঞরা।

মাছ খাওয়া প্রসঙ্গে যা বললেন অধ্যাপক প্রসেনজিৎ মালি

অধ্যাপক প্রসেনজিৎ মালি এই প্রসঙ্গে বলেন-“মাছের মধ্যে পারদ, ফর্মালিন রয়েছে‘- এ কথা ঠিক যে এগুলো আমরা একাধিক গবেষণা পত্রে দেখতে পেয়েছি। এটা যে একেবারে মিথ্যে তাও নয়। এগুলো মাছের মধ্যে জমা হওয়াকে বলা হয় বাই-অ্যাকুম্মোলেশন। এটা কিন্তু দীর্ফদিন ধরে হয়। এগুলো হয় মাছের লিভারে, মাছের অন্ত্রে, মাছের চর্বিতে, সবশেষে মাছের মুখে। অনেক বছর ধরে হয়। একটা সময় দেখা যায় যে মাছের দেহে যা থাকার কথা তা সীমা ছাড়িয়ে গেছে।  আমাদের দেশে এক বছরের মধ্যে মাছগুলিকে বাজারজাত করা হয়ে থাকে। এই অল্প সময়ের মধ্যে মাছের মধ্যে জমা বাস্তবে সম্ভব নয়।  দেখতে হবে মাছি বসা মাছ যাতে না কেনা হয়। এটা বাদ দিয়ে মাছ খাওয়া যেতেই পারে।“

প্রতি সপ্তাহে ৫০০ গ্রাম করে রেড মিট খাওয়া যেতে পারে-অধ্যাপক শুভাশিস বিশ্বাস

অধ্যাপক শুভাশিস বিশ্বাস বলেন- “প্রতি সপ্তাহে ৫০০ গ্রাম করে রেড মিট খাওয়া যেতে পারে। শারীরিক সমস্যা থাকলে ডাক্তারের কথা শুনে আপনি এটা নাও খেতে পারেন। মাংসের থেকে ন্যুনতম ২০ শতাংশ প্রোটিন আপনি পাবেন। ছোটরা ১০০ গ্রাম মাংস একদিন বা দুদিন অনায়াসেই খেতে পারে। সেটা পোলট্রি হতে পারে কিংবা রেড মিট হতে পারে। ৫০-৮৫ গ্রাম মাংস খাওয়া যেতে পারে।“

অ্যান্টিবায়োটিক ফ্রি চিকেন আমাদের দেশে ৯৮ শতাংশ হয়- মদন মাইতি

পশ্চিমবঙ্গ পোলট্রি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মদন মাইতি চিকেন ও ডিমের বিষয়ে বলেন-  “ভারত সরকার ঘোষণা করেছে যে রাজ্যগুলির মধ্যে মাংস বিশেষ করে চিকেন উৎপাদনে  সারা দেশে প্রথম হয়েছে। সারা দেশে ডিম উৎপাদনের হার ৩.৮ শতাংশ সেখানে আমাদের রাজ্য ৮ শতাংশ গ্রোথ নিয়ে ডিম উৎপাদন করছে। ২০০৫ সালে ভুট্টার উৎপাদন ও তার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বলতে বলা হয়েছিল। কিন্তু আমদের রাজ্যে এর প্রয়োজনীয়তা কতটা তা আমরা জানি না। আমি এই নিয়ে একটা তথ্য দিয়ে এসছিলাম। ওটা ৯০ শতাংশ সিওর হতে পারে ১০০ শতাংশ কোনওভাবেই না। তাই এসব ডাটা থেকে একটু পিছনে যেতে হবে। ভারত আজ চিকেন উৎপাদনে চতুর্থ এবং ডিম উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে চলে এসছে। এগুলো রিল আর ইউ্টিউবের ইয়ার্কি মেরে হয়নি। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি যে আমাদের দেশের ডাক্তারবাবুরা ভেটেরিয়ানরা বিশ্বের মধ্যে ভাল জায়গায় আছে। ’৮০ সালের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার আজ নেই। ডিম, মাংসে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে প্রোডাকশানের উন্নতি করা যাবে না। এটা আমাদের বিজ্ঞানীরা বুঝেছেন। ভারতবর্ষ একটা দেশ যেখানে বিশ্বের সব চাইতে বেশি ডিম উৎপাদন করে প্রতি মুরগিতে। ভারতবর্ষ একটা দেশ যেখানে পৃথিবীর  অন্যান্য দেশের চাইতে এই ক্ষেত্রে একটু বেশি এগিয়ে আছে। অ্যান্টিবায়োটিক ফ্রি চিকেন আমাদের দেশে ৯৮ শতাংশ হয়। আরামে আপনারা চিকেন এবং ডিম খাবেন কোনওরকম চিন্তা ছাড়া। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর মেডিক্যাল রি্সার্চ বলেছে যে একটা মানুষের বছরে ১১ কিলো চিকেন খাওয়া দরকার। আমরা সাড়ে চার কিলোতে পৌঁছে আছি। এখন আমরা অনেক দূর যেতে পারি। কয়েক বছর আগেও আপনারা ডিম কিনলে তার গায়ে পায়খানা লেগে থাকতে দেখতেন এখন দেখেন? দেখেন না। কারণ উৎপাদনের পদ্ধতির পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ফলে মলহীন মাংস পাওয়া যাচ্ছে। “

প্রসূতি মায়েদের ক্ষেত্রে তাদের বাচ্চার বৃদ্ধির জন্য প্রোটিন নিয়মিত খাওয়া উচিত-ডাঃ ত্রুণ কুমার সাফুই

কলকাতা কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ডাঃ ত্রুণ কুমার সাফুই যিনিএ নিজেও একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। প্রসূতি মায়েদের মাছ-মাংস খাওয়া কতটা প্রয়োজন কিংবা আদৌ কি দরকার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন- “ প্রসূতি মায়েদের ক্ষেত্রে তাদের বাচ্চার বৃদ্ধির জন্য প্রোটিন নিয়মিত খাওয়া উচিত। ডিম, মাচ, চর্বিহীন খাসির মাংস, পাঠার মাংস এগুলো অবশ্যই খেতে পারে। যা খেলে বাচ্চার কিংবা মায়ের ক্ষুতির আশঙ্কা থাকে না। এগুলো না খেলে দেখা যায় যে বাচ্চা প্রিটার্ম ডেলিভারি’ বা প্রিটার্ম বার্থ হয়ে যাচ্ছে।“

কোন প্রোটিন ৮৮ শতাংশ হজম করে ১৪০টাকায় কেউ বলতে পারবেন? অধ্যাপক বরুণ রায়

আলোচনায় সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেন বিজ্ঞানী অধ্যাপক বরুণ রায়। একই সঙ্গে তিনি এদিন অত্যন্ত এক গুরুত্বপূর্ণ দাবি তোলেন এবারের বিজ্ঞানমেলার মঞ্চ থেকে। তিনি বলেন- “খাওয়া-দাওয়া সবটাই যার যার নিজের। কিন্তু খাদ্যবিজ্ঞান নিয়ে সঠিক ধারণাই নেই আমাদের । তাই আমাদের পাঠ্যপুস্তকে খাদ্যবিজ্ঞান নিয়ে পড়ানো হয়নি। এখনও হয় না। সুতরাং সেক্ষেত্রে একটা বড় গ্যাপ আছে। সেক্ষেত্রে খাদ্যবিজ্ঞান আমাদের শিক্ষার সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।“

এরপর তিনি বলেন- “ কিন্তু এখন সামাজিক মাধ্যমে প্রচুর পরিমানে তথ্য পাওয়া যায়। তার ফলে বাচ্চা থেকে বয়স্করা খাদ্যবিজ্ঞান সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানতে পারছে। কিছু কিছু ভুল তথ্য এদিক-ওদিক থেকে আসে। সেগুলো সরিয়ে দিলে চারিদিক থেকে অনেক কিছু জানা যায়। প্রোটিন খাবার দু’রকম ভাবে হয়-এক, অ্যানিমেল সোর্সে আর এক রকম হয় ভেজিটেবল সোর্সে। আমার শরীরে কতটা প্রোটিন দরকার সেটা যতক্ষন পর্যন্ত না সে জানতে পারছে ততক্ষণ তার শরীরে কিন্তু প্রোটিনের ঘাটতি থেকে যায়। আমার শরীরের ওজন ৭০ কেজি হলে আমার প্রোটিনের প্রয়োজন কিন্তু ৭০ গ্রাম। যার যত ওজন তার ঠিক ততটাই প্রোটিন দরকার। আপনি যা ডিম খাচ্ছেন তার ৮৮ ভাগ হজম হচ্ছে। মাংসের ক্ষেত্রে ৬৫ আর মাছের ক্ষেত্রে ৭০ ভাগ। সুতরাং ভেজিটেবল প্রোটিনের দিকে যদি যান তাহলে সেটা মাত্র ৩০ শতাংশ। এর বেশি হজম যোগ্যতা নেই। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ভেজিটেবল প্রোটিন হল খুবই নিম্ন মানের প্রোটিন। উন্নত মানের প্রোটিন হল অ্যানিমেল প্রোটিন। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় দেখা যায় এগ্রিকালচা্র খাতে অনেক বেশি অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। এটা ঠিক যে দেশের মানুষের খাবারের প্রয়োজন। এটা ঠিক তবে এ দিয়ে কিন্তু সামাজিক গঠন হয় না। প্রোটিন কমে যাওয়া মানে রোগ-ভোগের পরিমান বেড়ে যাওয়া। একটা বাচ্চা চোখে দেখতে পায় না। হাত বেঁকে যায়। এটা প্রোটিনের অভাবে হয়। আগে থেকে যদি নজর দেওয়া হয় তাহলে সেই খরচা বাঁচানো যায়। রেসিপি হিসাবে মাংসের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের পরিমান এতটাই কম যে তা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। কোন প্রোটিন ৮৮ শতাংশ হজম করে ১৪০টাকায় কেউ বলতে পারবেন? তেলাপিয়া মাছ ৭০ শতাংশ হজম হয়, তার দাম ২০০টাকা। ডিমের চেয়ে সস্তা সহজপাচ্চ্য খাবার পৃথিবীতে নেই। ওটাকে আপনাকে খাদ্য তালিকায় ঢোকাতেই হবে। “

Published on: ডিসে ২৬, ২০২৪ at ২৩:৩১


শেয়ার করুন