দীঘায় আন্তর্জাতিক মানের লোকনাথ মন্দির গড়ার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা
বলরামপুর লোকনাথ মন্দিরকে তীর্থ ক্ষেত্রের পাশাপাশি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করা হচ্ছে
আগামী ২৩ জানুয়ারি রিষড়া লোকনাথ মন্দিরে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন
Published on: ডিসে ২৪, ২০২৪ at ১১:২৪
Reporter: Aniruddha Pal
এসপিটি নিউজ, বলরামপুর, (হুগলি), ২৪ ডিসেম্বর: বাবা লোকনাথের মহানাম, প্রচারক ও চাকলা ধামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নবকুমার দাস আজ থেকে ৩৫ বছর আগে বাবা লোকনাথের প্রতি নিজেকে সঁপে দেওয়ার যে শপথ নিয়েছিলেন তা এখন বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। তারই এক অংশ দেখা গেল হুগলি জেলার বলরামপুর লোকনাথ মন্দিরের বাৎসরিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। হোম-যজ্ঞ-, পুজো পাঠ, নামসংকীর্তনের মধ্য দিয়ে দিনটি মহাসমারোহে উদযাপিত হয়েছে। বাবার স্বপ্নাদেশ পেয়ে আজথেকে চার বছর আগে এই জায়গায় বাবা লোকনাথের বিগ্রহের প্রাণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুদৃশ্য মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন উত্তম দাস ও তার সহধর্মিণী পূরবী দাস। মাত্র চার বছরে এই মন্দির আজ হুগলি জেলায় শুধু নইয় রাসার রাজ্যের লোকনাথ ভক্তদের কাছে এক মহাতীর্থ হয়ে উঠেছে। সেই মন্দিরে প্রতিষ্ঠার কাহিনি নিজের মুখে শোনালেন উত্তম দাস স্বয়ং।
আজও সেই কথা মনে আসলে গায়ে কাঁটা দেয়-উত্তম দাস
“আমার বাড়িতে লোকনাথ বাবার মন্দির আছে। সেখানে আমরা প্রতিদিন পুজো পাঠ করি। রীতি-আচার মেনেই তা করা হয়। হঠাৎ একদিন ভোরের দিকে আমি স্বপ্নে দেখি যে একটা নীল পদ্মের উপর বাবা আমাকে আশীর্বাদ করছেন এবং বলছেন যে তুই কবে আমাকে নিয়ে আসবি? তা আমি তখন ভাবলাম এটা তো একটা স্বপ্ন, আর স্বপ্ন তো সবাই দেখে। আমার এটা বাগান বাড়ি ছিল। এখন যেখানে মূল মন্দির হয়েছে সেখানে অনেক পদ্মফুল ফুটত। ওখানে একটা ডোবা মতো ছিল। সেই স্বপ্ন দেখার সাত-আটদিন পর এখানে আসি। এসে ঘুরতে ঘুরতে দেখি যে ওখানে ডোবার মধ্যে সেই নীল পদ্ম ফুটে আছে। আজও সেই কথা মনে আসলে গায়ে কাঁটা দেয়। বাড়িতে এসে বললাম যে এই ব্যাপার হয়েছে। বাড়ি থেকে বলল যে কালই তুমি ঠাকুর মশাইকে নিয়ে যাও। ওনাকে জিজ্ঞাসা করো যে কেন এমন স্বপ্ন দেখা গেল। তারপর বাড়ির ঠাকুরমশাইকে নিয়ে এখানে এলাম। তখন সব দেখে ঠাকুরমশাই বললেন যে উত্তমদা এখানেই মন্দির করুন। এখন বাবা এখানে অধিষ্ঠান করছেন। বাবা অতি সহজেই সব কিছু করিয়ে নিয়েছে আমাকে দিয়ে। ২০২০ সালে এই মন্দিরের উদ্বোধন হয়। “ বলেন উত্তম দাস।
নবদা অনেক বড় বড় কাজ করেছেন- উত্তম দাস
বাবা লোকনাথের জন্মস্থান চাকলা ধামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও লোকনাথ মহানাম প্রচারক নবকুমার দাসকে এদিন মানপত্র দিয়ে সম্মানিত করা হয় এই লোকনাথ মন্দিরের পক্ষ থেকে। নবকুমার দাসের সঙ্গেও এই মন্দিরের গভীর সম্পর্ক আছে। সেই প্রসঙ্গে এদিন উত্তম দাস বলেন- “নবদার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে আমার বাড়ির পাশেই থাকে স্বপন সিনহা। তার মাধ্যমেই নবদার সঙ্গে। নবদা অনেক বড় বড় কাজ করেছেন। এর আগেও যে চাকলায় বড় অনুষ্ঠান হয়েছে সেখানেও তার অবদান অনেক। আমরা বেশ কিছুদিন ধরে নানা জায়গায় মিটিং করেছি। তারপর তো অনুষ্ঠানটা সফল হল। এরপর তো আমাদের মুখ্যমন্ত্রী এলেন। ওনাকেও সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছে।“
প্রতিষ্ঠিত বাবা লোকনাথের মূর্তিটি রাজস্থানের জয়পুরের
এখানে প্রতিষ্ঠিত বাবা লোকনাথের মূর্তিটি রাজস্থানের জয়পুর থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। তার উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট মতো হবে। জানালেন মন্দির প্রতিষ্ঠাতা উত্তম দাস স্বয়ং। এখানে প্রায় দুই বিঘা মতো জমি আছে। এখানে মূল মন্দির আছে। বাবার গুরুদেবের একটা মন্দির রাখা হয়েছে। এছাড়াও মন্দিরের সেবাইতদের থাকার জায়গা আছে। উপরে তারা থাকেন। নীচে রান্না হয়। উপরে একটা ঘর আছে। বাইরে থেকে কোনও অতিথি এলে তার থাকার ব্যবস্থা আছে। সাত-আটজনের মতো ব্যবস্থা করা আছে। এছাড়াও একটা চার তলা বিল্ডিং করা হয়েছে। একেবারে নীচে একটা মেডিটেশন হল আছে। তার উপরে দশটা রুম আছে। প্রথম তলা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। চার তলা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। শুধু বাকি আছে তৃতীয় তলের কাজ। কেউ যদি এখানে এসে থাকতে চান তাহলে এখানে ম্যানেজার বসন্তবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করে বুকিং করে নিতে পারেন।
চন্দনগর স্টেশন থেকে সরাসরি চলে আসা যায় অটোয় করে। এছাড়াও শ্বেতপুর মোড় থেকে আসা যায়। সামনেই রয়েছে বলরামপুর ব্রিজ।
গঙ্গাসাগর থেকে আসা এক সাধু জানালেন যে এখানে এসে খুবই ভাল লাগছে। এরপরই জানালেন নবকুমার দাসের সঙ্গে যোগাযোগের অভিজ্ঞতার কথা। বাবা লোকনাথকে নিয়ে তিনি যে কাজ করে চলেছেন তা সত্যি প্রশংসার যোগ্য।
অঙ্ক পরীক্ষার দিন বাবা একটা ছোট্ট ছবি হয়ে আমার কাছে এসেছিলেন-পূরবী দাস
মন্দির প্রতিষ্ঠাতা উত্তম দাসের সহধর্মিণী পূরবী দাস তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন- “আমি তখন দশম শ্রেণীতে পড়ি। মাধ্যমিক পরীক্ষা। অঙ্ক পরীক্ষার দিন বাবা একটা ছোট্ট ছবি হয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। সেই থেকে দীর্ঘদিন বাবাকে নিয়েই থাকি। তার মধ্যে আমার বাড়িতে একটা ছোট্ট মন্দির আছে। আমার বাড়ি রিষড়ায়। আমার এক জা আমাকে বাবার মন্দির গড়ার কথা বলেছিলেন। তার আশীর্বাদ আর আমার ভাইকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করি। এই মন্দিরকে প্রতিষ্ঠা করেছি। এখানে বাবার সেবা হোক এবং সেই সঙ্গে বাবার অভুক্ত সন্তানদের একটু সেবা হোক সেটাই আমি চাই। অভুক্ত সন্তানরা যাতে এখানে কর্ম করে খেতে পারে তাদের অন্নের যেন জোগাড় হয়। এর বেশি বাবার কাছে আমার কিছু চাওয়ার নেই। বাবা যা দিয়েছে তা আমার চাওয়ার থেকে জীবনের অনেক বেশি পাওয়া হয়ে গিয়েছে।“
একটা মানুষ ছোট থেকে কিভাবে বড় হয় সেটা আমার কাকাকে দেখলেই বোঝা যায়-অভিজিৎ দাস
প্রতিষ্ঠাতা উত্তম দাসের ভাইপো অভিজিৎ দাস জানান, “আমার ছোট কাকা ছোটবেলা থেকে প্রচন্ড পরিশ্রম করেছে আমরা সেটা জেনেছি। আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখেছি কাকাকে। তখন আমার দশ-বারো বছর বয়স। ছোট টুনি বাল্ব থেকে শুরু করে কারখানা কিভাবে হয়েছে তা চোখের সামনে দেখেছি। একটা মানুষ ছোট থেকে কিভাবে বড় হয় সেটা আমার কাকাকে দেখলেই বোঝা যায়। কাকার আশীর্বাদ আমাদের মাথার উপর আছে। কাকার দুটো কারখানাতেই বাবার মূর্তি আছে। শুধু মূর্তি নয় বাবার মন্দির আছে। আমি কাকাকে বলেছি যে তোমার জীবনে সবচেয়ে বড় কাজ এটাই। বলরামপুরে লোকনাথ মন্দির। কাকা আমাদের পূর্বপুরুষের ভগবানের কাছে যে ঋণ করেছিলেন। এর মাধ্যমে আমাদের সেই নয় পুরুষ আজ কাকাকে আশীর্বাদ করছে। কাকার সহযোগিতায় নবদার সহযোগিতায় স্বপন সিনহার সহযোগিতায় রিষড়াতেও একটা মন্দির গড়ে তুলতে পেরেছি।“
বাবা বলেছিলেন আমার তিরোধানের শতবর্ষ পরে আমি ঘরে ঘরে পূজিত হব
শিমুরালি লোকনাথ মন্দিরের সাইত বলেন- “বাবা লোকনাথ বলেছেন আমার তিরোধানের শতবর্ষ পরে অর্থাৎ আমার মৃত্যুর ১০০ বছর পর আমি ঘরে ঘরে পূজিত হব। আজ বাবা লোকনাথের তিরোধানের ১৩০ বছর পার করে দিয়েছি। সেই কারণে আজ বাবাকে নিয়ে ঘরে পুজো করা হচ্ছে। বাবাই সব করাচ্ছেন। তাই উত্তমদাকে দেখিয়েছিলেন আজ ওনার এত বড় চিন্তাধারা বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন। আমরা এখানে এসেছি নবকুমার দাসের সহযোগিতায়। তিনি চাকলা ধামের প্রধান নবকুমার দাস। তার জীবনের লক্ষ্য একটাই – তিনি ঘরে ঘরে লোকনাথের মহানাম পৌঁছে দেবেন। সেই মহানাম পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যেই আজ বাবা লোকনাথের ভক্তরা এখানে এসে পৌঁছেছি। বাবা লোকনাথের মহানাম প্রচারের উদ্দেশ্যে।
মন্দিরের প্রধান পুরোহিত প্রদীপ ঘোষাল বলেন- “আজ এখানে এই মহামিলকে মহাতীর্থে পরিণত করেছেন আপনাদের মতো নারয়ণরা। সাধারণ মানুষের উদ্দেশে বলেন তিনি।“
দীঘায় জমি পেলে গড়ে তোলা হবে লোকনাথ মন্দির- নবকুমার দাস
নবকুমার দাস বলেন- “আগামী ২৩ জানুয়ারি রিষড়া লোকনাথ মন্দিরে গঙ্গাসাগর থেকে ১০জন সাধু আসছেন। সেখানে এক বড় অনুষ্ঠান হতে চলেছে।“ পাশাপাশি তিনি বলেন- “দীঘায় আমাদের ইচ্ছা আছে একটা আন্তর্জাতিক মানের বাবা লোকনাথ মন্দির প্রতিষ্ঠা করার। এর জন্য জমি চাই। আমরা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যাতের দ্বারস্থ হব। তার সঙ্গে দেখা করার সময় চাইব। আমাদের বিশ্বাস যে এর আগে তিনি যেভাবে আমাদের রাজ্যের দুটো লোকনাথ মন্দিরের উন্নয়নে সাহায্য করেছে এবারও তিনি লোকনাথ ভক্তদের কথা মাথায় রেখে আমাদের আবেদনে সাড়া দেবেন। তিনি জনদরদী। মানুষের কল্যাণে তিনি কাজ করেন। আমাদের আশা দীঘায় বাবা লোকনাথের মন্দির গড়ার জন্যে তিনি আমাদের জমি দেবেন। সেই জমি পেলেই আমরা সমস্ত লোকনাথ ভক্তরা আন্তর্জাতিক মানের লোকনাথ মন্দির গড়ে তোলার কাজ শুরু করব।“
বারাসত বামুনমুড়া থেকে আসা লোকনাথ ভক্তরা তাদের অনুভূতির কথা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন- “আমাদের একটা মহিলা সংগঠন আছে। আমরা লোকনাথ মন্দির দর্শন করে থাকি। নবকুমার দাস বরাবরই মানুষের পাশে থাকেন। আমরা তার কাছ থেকে সেই শিক্ষা নিয়ে মানুষের সেবায় থাকি। লোকনাথ বাবাকে নিয়ে তিনি সবসময় থাকেন। লকডাউনের সময় কেউ মাছ কিনতে পারছে না। পুকুর থেকে মাছ ধরে দিয়েছে। আমরা তা বিলি করেছি। এখানে এসে আমরা নিজদের ধন্য মনে করছি।“
এদিন বলরামপুর লোকনাথ মন্দিরে বাৎসরিক অনুষ্ঠান ছিল সেই উপলক্ষ্যে মহানাম যজ্ঞ, কীর্তন, পূজো, সমস্ত কিছু পালিত হয়েছে। একই সঙ্গে এদিন মন্দিরে শ্রীশ্রীমায়ের জন্মজয়ন্তীও সাড়ম্বরে পালিত হয়। সবেশেষে অতিথিদের যথাযথ মর্যাদার সাথে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়।
Published on: ডিসে ২৪, ২০২৪ at ১১:২৪