১৮ মাস বাদেই রিটায়র হতেন হেমরাজ মীণা, কিন্তু সব তছনছ হয়ে গেল-বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন শহীদের স্ত্রী

Main এসপিটি এক্সক্লুসিভ দেশ
শেয়ার করুন

সংবাদদাতা- অনিরুদ্ধ পাল

Published on: ফেব্রু ২০, ২০১৯ @ ১৭:৩৭

এসপিটি স্পেশাল নিউজঃ দায়িত্ব-নিয়মানুবর্তিতা-শৃঙ্খলাবোধ সম্পর্কে সব সময় নিজের সন্তানদের বলতেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে দেশের হয়ে সেবা করার মহান দায়িত্ব পেয়ে সবসময়ই গর্ব বোধ করতেন। মনে করতেন- এমন মহান কাজের সুযোগ পাওয়াটাও একটা পুরস্কার। আজ এসব মনে পড়তেই দু’চোখ দিয়ে সমানে জলের ধারা পড়ে চলেছে স্ত্রী মধুবালা মীণার। চোখের জল যে কোনও সান্ত্বনাই বাঁধ মানতে চাইছে না। “ও তো বলে গেছিল ২০ দিন বাদে ঘরে ফিরে আসবে।কিন্তু সব যে আমাদের তছনছ হয়ে গেল।” এ কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন শহীদ হেমরাজের স্ত্রী।

রাজস্থানের কোটা জেলার সাঙ্গোদ এলাকার বিনোদ কলা গ্রামের ৪৩ বছরের হেমরাজ মীণাকে ঘিরে সবাই একদিকে যেমন গর্বিত আবার একই সঙ্গে শোকার্ত।গোটা এলাকার মানুষ এই হামলার শুধু নিন্দা করেই থামছে না তারা সকলেই প্রতিশোধ নেওয়ার আওয়াজ তুলেছে। তবে হেমরাজের বাড়ির লোকজন একেবারে স্তম্ভিত। তারা আজ ঘরের ছেলের এমন আকষ্মিক মৃত্যুতে একেবারে দিশেহারা। ১৮ বছর আগে সেনায় চাকরি শুরু করেছিলেন হেমরাজ। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তিনি ৬১ নম্বর ব্যাটেলিয়নের হয়ে দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। একদিন আগেই তিনি ডিউটিতে যোগ দিয়েছিলেন। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় পরিবারের সকল সদস্যকে বলে গেছিলেন- “তোমরা চিন্তা করো না, আমি ২০ দিন বাদেই ফিরে আসব। ভালো থেকো তোমরা সকলে। আমি আসি।” এই বলে ডিউটির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন হেমরাজ। কিন্তু চারদিন বাদেই তিনি ফিরলেন। তবে সশরীরে নয় পার্থিব শরীরে তেরঙ্গা পতাকায় কফিন বন্দি হয়ে। আজ এটাই বাস্তব ছবি হেমরাজের পরিবারের কাছে। এটাই মেনে নিতে হবে তাদের সকলকে।পাকিস্তানের মদতপুষ্ট আশ্রয়ে থাকা জঙ্গিদের নির্লজ্জ্ব হামলার শিকার হয়ে অকালে চলে যেতে হয়েছে হেমরাজকে।

তাঁর ভাই রামবিলাস মীণা বলছিলেন- জম্মু ও কাশ্মীর যাওয়ার আগে হেমরাজ মহারাষ্ট্রের নাগপুরে ট্রেনিং-এ গেছিলেন। ট্রেনিং থেকে পৌঁছে সোমবার রাতে কিছু সময়ের জন্য গ্রামের বাড়িতে আসেন। গ্রামের বাড়িতে হেমরাজ চোদ্দো ঘণ্টা পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে মঙ্গলবার সকাল প্রায় ছ’টা নাগাদ জম্মু ও কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে সকলকে আলবিদা জানিয়ে রওনা হয়ে যান। ঘর থেকে বেরোনোর সময় হেমরাজের স্ত্রী-র মন খুব ভেঙে পড়ে। তখন তিনি তাঁর স্ত্রী মধুবালাকে হাসতে হাসতে বলে যান- “মন খারাপ করো না। আমি তো দেশের সেবায় যাচ্ছি। মাত্র তো ২০দিন বাদেই আমি ফিরে আসব। ফিরে এসে তোমাদের নিয়ে ঘুরতে যাব।” কথাগুলো বলার সময়ে ভাই রামবিলাসের গলা ধরে আসে। চোখ মুছতে থাকেন। শুধু বিড় বিড় করে বলতে থাকেন- কি যে হয়ে গেল!

সত্যি সব কেমন হয়ে গেল। বুধবার হেমরাজ জম্মু পৌঁছে যান। কিন্তু সেখানে পৌঁছনোর পর একদিন পরই বৃহস্পতিবার তারা শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন।আর তখনই তাদের কনভয়ের উপর আত্মঘাতী হামলা হয়। যে হামলায় ৪০ জওয়ান শহীদ হন। যার মধ্যে ছিলেন রাজস্থানের হেমরাজ মীণাও। ভাই রামবিলাস বলছিলেন- হামলার দিন দুপুরবেলাতেই সংবাদ মাধ্যমের থেকে আমরা খবর পেয়ে যাই। এরপর আমরা ব্যাটেলিয়নের আধিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। তারা হেমরাজের খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে।

রামবিলাস মীণা বলছিলেন- ভারত সরকারকে এই জঘন্য হামলার বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে জবরদস্ত জবাব দেওয়া উচিত। তিনি নিজেও সীমান্তে গিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাদের বিরুদ্ধে চরম আঘাত হানতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। হেমরাজের বাবা হরদয়াল মীণা প্রশ্ন তোলেন- আর করতদিন আ্মাদের জওয়ানরা এভাবে শহীদ হতে থাকবে? আমি সেদিন খুশি হব ভারত যেদিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এর বদলা নেবে।

এরপর গোটা পরিবার স্তম্ভিত হয়ে যায়। ঘরে স্ত্রী ছাড়াও আছে হেমরাজের চার প্রাণ-দু ছেলে দুই মেয়ে। বড় মেয়ে রীণার বয়স ১৮। ছোট মেয়ে টিনার বয়স ১৪। দুই ছেলে ১২ বছরের অজয় আর ৪ বছরের ঋষভ। এদের নিয়ে বড় সুখের সংসার ছিলে হেমরাজের। সব সময় ছেলেমেয়েদের বলতেন- ভালো করে পড়াশুনো করে দেশের দশের একজন হও। দেশের সম্মান পরিবারের সম্মান মুলুকের সম্মান তুলে ধরবে। সব সময় মনে রাখবে-এই দেশ আমাদের মা। আর তার অসম্মান মানে আমাদের মায়ের অপমান। নিয়ম মেনে চলবে। শৃঙ্খলাপরায়ন হবে। বাবার এই কথাগুলো মনে পড়তেই চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে ছেলে-মেয়েদের।

সংবাদ প্রভাকর টাইমস-এর পাঠকরা আপনাদের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ- আপনারা আপনাদের মনের ভিতর হেমরাজদের মতো বীর শহীদদের কাহিনিকে স্থান দেবেন। লোক দেখানো কিছু করার দরকার নেই।শুধু একবার ভাবুন তো- আমার-আপনার মতোীক সাধারাওণ পরিবারের এই বীর জোয়ান হেমরাজও তো তাঁর সুখের পরিবারকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল। কী অপরাধ করেছিল তাঁর পরিবার। ওই নিষ্পাপ সন্তানগুলি? এক অসহায় গাঁয়ের বধূ? যাদের সব সুখ কেড়ে নিল ওই পাকিস্তানি জঙ্গিরা। আমাদের দেশকে রক্ষা করতে গিয়ে অকালে প্রাণ বলিদান দিতে হলে হেমরাজকে।

তিন বছর কাশ্মীরে ডিউটি করেন হেমরাজ। তার আগে তিনি নকশাল প্রভাবিত এলাকায় ডিউটি করেছেন। আর মাত্র ১৮ মাস বাদেই তিনি রিটায়র করতেন। স্ত্রী মধুবালা বলছিলেন- বিয়ের সময় হেমরাজ সিআরপিএফ-এ ছিলেন না। বিয়ের পর এখানে যোগ দেন। একটা কথাই ও বলতো- আর তো কয়েকটা দিন। এরপর আমরা খুব আনন্দে দিন কাটাবো সবাই মিলে। কিন্তু এর মধ্যে সব তছনছ হয়ে গেল। ১৮ মাসের মধ্যেই এমন দিন সামনে চলে আসবে যা দেখতে হবে বলে কল্পনাও করতে পারছি না। বলেই কাঁদতে থাকেন হেমরাজের অসহায় স্ত্রী।

Published on: ফেব্রু ২০, ২০১৯ @ ১৭:৩৭


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 + 5 =