স্নানযাত্রার পর মহাপ্রভু শ্রীজগন্নাথদেবের গজানন বেশ ধারন করার পিছনে আছে অসাধারণ কাহিনি

Main দেশ ধর্ম ভ্রমণ
শেয়ার করুন

Published on: জুন ২৪, ২০২১ @ ২০:৩১
Reporter: Aniruddha Pal

এসপিটি নিউজঃ  প্রতি বছরের মতো এবারেও স্নানযাত্রার শেষে মহাপ্রভু শ্রীজগন্নাথ, বলভদ্রজি ও দেবী সুভদ্রতাকে গজানন বেশে সাজানো হয়েছে। তবে অন্যান্যবারের মতো এবার জনসমাগম হয়নি। করোনা মহামারীর কারণে মহাপ্রভু এবার ভপক্তবিহীন হয়েই গজানন বেশ ধারণ করেন।

রাত থেকেই শুরু হয়ে স্নানযাত্রার নিয়ম-বিধি

মহাস্নানযাত্রার জন্য রাত ১টা৪০মিনিট থেকেই সমস্ত আচার-বিধি শুরু হয়। রাত ১টা ৫৫মিনিটে পুষ্পাঞ্জলি থেকে শুরু করে অন্যান্য বিধি নিয়ম শুরু হয়ে গিয়েছিল যা রাত ৩টে ২০ মিনিটে শেষ হয়। ভোর চারটে নাগাদ চতুর্দ্ধ মূর্তিকে স্নানের মণ্ডপে নিয়ে আসা হয়। ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ মঙ্গল আরতি হয়। ভোর পাঁচটায় মিলাম নীতিম,আল করা হয়। সকাল ৬টায় অবকাশ নীতি সম্পন্ন হয়। সকাল ৬টা২০মিনিটে রোষ হোম সাড়ে ছ’টায় বেশ সম্পন্ন হয়। সকাল সাতটায় সূর্য পুজো, ৭টা২০মিনিটে দ্বারপাল পুজো, সাতটা ৫৫ মিনিটে মহাপ্রভুর স্নানের জল আনার জন্য সেবকদের আমন্ত্রণ করা হয়। স্নানের মণ্ডপে সাড়ে আটটা নাগাদ ১০৮টি কলসিতে করে সুগন্ধিত জল নিয়ে আসা হয়।

গজানন বেশের পর মহাপ্রভুকে ফুল দিয়ে সজ্জিত করা হয়

এর মধ্যে বলভদ্রজির জন্য ৩৫ টি কলসির জল, জগন্নাথজি’র পক্ষে ৩৩টি কলসি, দেবী সুভদ্রার জন্য ২২ টি কলসি, সুদর্শনজির জন্য ১৮ টি কলসিতে করে জল নিয়ে আসা  হয়েছিল। সকাল ৯টা ৪৫মিনি্টে চতুর্দ্ধ মূর্তিকে স্নান করানো হয়। এর পরে, গজপতি’র প্রতিনিধি মুদিরাস্ত চার দেবদেবীর পূজা শেষে একটি বৃত্তাকার করলেন। এর পর ১১টা ২০ মিনিটে গজানন বেশ শুরু হয়। এর পরে, স্নানের মণ্ডপে চতুর্দ্ধ মূর্তির কাছে ব্রহ্ম ভোগ উৎসর্গ করা হয়। ভোগ নীতি সমাপ্ত হওয়ার পরে গজানন বেশ সরিয়ে ফুল দিয়ে সজ্জিত করা হয়।

মহাপ্রভু শ্রীজগন্নাথদেবের এই গজানন বেশের পিছনে রয়েছে এক অসাধারণ কাহিনি। আসুন শোনা যাক কি সেই কাহিনি-

ভক্ত গজপতি ভট্ট

গজপতি ভট্ট একজন শিল্পী। অসাধারণ মূর্তি গড়েন। মহারাষ্ট্রেই ছিল তাঁর নিবাস। মনে-প্রাণে তিনি ছিলেন একজন সিদ্ধিবিনায়কের পরম ভক্ত।বিঘ্নহর্তা শ্রীগণেশজি তাঁর সবকিছু। তাঁর আরাধ্য দেবতা। নিজের কার্যশালায় বসে দিন রাত এক করে শ্রীগণেশের নামগান করেন আর আরাধ্য দেবতার মূর্তি গড়ে চলেন। এভাবে বেশ চলছিল। ধীরে ধীরে তাঁর সুকীর্তির কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পৌঁছে যায় সেদেশের রাজার কাছেও।

শিল্পী গাজপতিকে রাজা প্রভু শ্রীকৃষ্ণের চতুর্ভুজ মূর্তি গড়ার নির্দেশ দেন

রাজা পৌঁছে যায় শিল্পী গজপতি ভট্টের কার্যশালায়। শিল্পীর কাছে নিজের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করে বলেন- রাজরানী জন্মাষ্টমীতে প্রভু শ্রীকৃষ্ণের চতুর্ভুজ মূর্তি প্রার্থণা করেছেন। আমি তাঁকে কথা দিয়েছি যে সেই মূর্তি তাঁর সামনে উপস্থিত করব। আমি আপনার কথা শুনেছি। আমি চাই, সেই মূর্তি আমি গড়ুন। রাজার কথা শুনে সেখানে উপস্থিত শিল্পীর এক শিষ্য ভয় পেয়ে যান। তিনি তাঁর গুরুকে অনুরোধ করেন- “এখনই আপনি রাজাকে বলে দিন যে ওই মূর্তি আমি গড়তে পারবেন না। কারণ, আপনি তো শ্রীগণেশের মূর্তি ছাড়া আর কোনও মূর্তি গড়েন না। শিল্পীর তাতে কোনও হেলদোল নেই। তিনি হাসত হাসতে প্রভু শ্রীগণেশের নাম স্মরণ করে রাজাকে কথা দিয়ে দেন নিজের সেরা প্রচেষ্টা দিয়ে তিনি ওই মূর্তি গড়বেন।

কিন্তু এ কার মূর্তি গড়লেন গজপতি

যথাসময়ে শিল্পী গজপতি ভট্ট মূর্তি গরার কাজ সম্পন্ন করেন। সেই মূর্তি নিয়ে রাজ দরবারে হাজির হন। রাজসভায় হাজির হতেই রাজা মূর্তির আবরণ উন্মুক্ত করতে শিল্পী গজপতিকে নির্দেশ দেন। কিন্তু আবরণ উন্মোচিত হতেই সকলে হতভম্ব হয়ে যান- এ যে প্রভু শ্রীকৃষ্ণের বদলে শ্রী গণেশের মূর্তি। যদিও এখানে শ্রীগণেশের হাতে বাঁশি। মাথায় শোভা পাচ্ছে ময়ূরপুচ্ছ। রাজা এই মূর্তি দেখে রুষ্ট হলেন। তিনি গজপতিকে কঠোর শাস্তি দিতে উদ্যত হলেন। গজপতি তখন রাজার সামনে করজোড়ে বলেন- মহারাজ- আপনি ইচ্ছা করলে আমাকে শাস্তি দিতেই পারেন। কারণ, সেটা আপনার অধিকার। কিন্তু আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি কিন্তু আমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিনি। আমি নিজের নিজের সেরা প্রচেষ্টা দিয়ে প্রভুর চতুর্ভুজ মূর্তি গড়েছি। কিন্তু রাজা নিজের সিদ্ধানে অটল থেকে শিল্পী গজপতিকে শাস্তি দিতে অনড় থাকেন।

শ্রীগণেশের মূর্তিতে শ্রীকৃষ্ণের রূপ

রাজ প্রহরী যেই না গজপতির দিকে তরবারি উঁচিয়ে এগিয়েছে তখনই ঘটে যায় এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। রাজরানী লক্ষ্য করেন যে শ্রী গজাননের ওই মূর্তিতে শ্রীকৃষ্ণের রূপ ফুটে উঠেছে। রাজরানী রাজাকে অনুরোধ করেন তিনি যেন শিল্পী গজপতিকে শাস্তির বদলে পুরস্কৃত করেন। কারণ, এই মূর্তিতে যে আমাদের আরাধ্য শ্রীকৃষ্ণ বিরাজ করছেন। রাজা শিল্পীকে পুরস্কৃত করে বিদায় দেন।

প্রভু শ্রীগজাননের আশীর্বাদ হল সবচেয়ে বড় পুরস্কার

এই পুরস্কারে শিল্পী গজপতির মন ভরেনি। শিষ্যের কাছে নিজের মনের ইচ্ছার কথা খুলে বলেন। কারণ, তার কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার হল প্রভু শ্রীগজাননের আশীর্বাদ।এই সময় এক ব্রাহ্মণ বালক শিল্পীর কার্যশালায় উপস্থিত হন। গজপতির শিল্পকলা দেখে মুগ্ধ হন। তাঁর কাছে গজপতি জানতে চান মোক্ষ লাভ কিভাবে সম্ভব। তখন সেই ব্রাহ্মণবেশধারী বালক বলেন- পরমব্রহ্ম পরমেশ্বর ভগবানের দর্শনে মোক্ষলাভ সম্ভব। আর সেটা হতে পারে একমাত্র পুরীতে শ্রীজগন্নাথধামেই।

শিল্পী গজপতির মোক্ষলাভ, মহাপ্রভুর গজানন বেশ ধারণের ঘোষণা

শ্রীগজাননভক্ত গজপতি সমস্ত বিষয়-আশয় সবার মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে পরমেশ্বর ভগবানের খোঁজে ছুটলেন জগন্নাথধামের উদ্দেশ্যে। প্রথমবার মন্দিরে প্রবেশ করে বেরিয়ে আসেন সেখানে শ্রীগজাননের মূর্তি দেখতে না পেয়ে। পরে শ্রীগজাননের আদেশে ফের জগন্নাথধামে মহাপ্রভুর শ্রীবিগ্রহের সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষমা প্রার্থণা করেন।আর বলেন- প্রভু, এই ভক্তকে একবার পরমব্রহ্ম পরমেশ্বর ভগবানের রূপ দর্শন দিনঙ্গজপ্তির পরম নিষ্ঠা আর ভক্তিতে মহাপ্রভু নিজের সচ্চিদানন্দ পরমেশ্বর ভগবানের রূপ দর্শন দেন। ভক্ত গজপতি সেই রূপ দর্শন করে অভুভূত হয়ে পড়েন।

মহাপ্রভু তখন ঘোষণা করেন- প্রতি বছর স্নানযাত্রার দিন গজানন বেশ ধারণ করা হবে। এরপর গজপতি মোক্ষলাভ করেন। সেই থেকে প্রতি বছর স্নানযাত্রার দিন মহাপ্রভু শ্রীজগন্নাথদেব, বলভদ্রজি ও দেবী সুভদাকে গজাননের বেশে সজ্জিত করা হয়।

Published on: জুন ২৪, ২০২১ @ ২০:৩১


শেয়ার করুন