সুভাষ দশকের পর দশক দেশের মাটিতে সাধুর বেশে আত্মগোপন করে থাকবেন কিসের ভয়ে?

Main দেশ বিদেশ রাজ্য
শেয়ার করুন

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস-কে নিয়ে আলোচনা-বিতর্কের শেষ নেই। তাই ১২৫ বছর পরও তাঁকে নিয়ে ভারতবাসীর উৎসাহ-আবেগে এতটুকু ঘাটতি পড়েনি। শুধু একটাই খেদ- তা হল, এত বছর পরেও নেতাজির মৃত্যু ঘিরে বিতর্ক আজও রয়ে গেল। তাঁর পরাক্রম, বীরত্ব, আদর্শ এসব নিয়ে আমরা গালভরা কথা বললেও আজও তাঁর জন্মদিনকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হল না। দেশ স্বাধীন হলেও নেতাজি দেশে ফিরলেন না নাকি তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হল না। নেতাজিকে কেন এত ভয় ? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি আমরা। সংবাদ প্রভাকর টাইমস তাই অনুসন্ধানমূলক ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। আজ তাঁর পঞ্চম পর্ব।
Published on: জানু ২৭, ২০২১ @ ১৯:০১
লেখক- সুমিত গুপ্ত 

পর্ব-পঞ্চম

শৌলিমারির সাধুবাবা, ফৈজাবাদের বাবাজি, ভগওয়ানজি, গুমনামি বাবাদের কেউই কি নেতাজি নন? সঙ্গত প্রশ্ন হবে, যদি কেউ করেন, প্রতিবেদকের এতটা নিশ্চিত হবার কারণ কি? সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। নেতাজি অন্তর্ধান রহস্য পৃথিবীর সর্বকালের সেরা গোয়েন্দা কাহিনিকেও হার মানায়।ইংরাজিতে একটা কথা আছে, রিয়্যালিটি ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন। সুভাষের অন্তরালের পঁচাত্তর বছর তিন-প্রজন্মের বিস্ময়ের কুয়াশায় ঢাকা। তাঁকে ঘিরে মিত্রশক্তির বিবেকহীন, হিংস্র ষড়যন্ত্রের আসল চেহারা হয়তো কোনওদিনই পুরোপুরি কেউ জানতে পারবে না। কিন্তু, সেই ষড়যন্ত্রের পরতে পরতে যে কী তীব্র জাতিবিদ্বেষ, বিশ্বাসঘাতকতা আর ঔপনিবেশিক শোষণতন্ত্রের বিষ মাখানো রয়েছে, আজও প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত তারই নরক গুলজার যাপন করছে ভারতীয় উপমহাদেশ তথা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মানুষ।

নেতাজি তাঁর সমগ্র জীবন জুড়ে তাঁর সমস্ত অসমসাহসিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আমাদের ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন আত্মপরিচয়। তিনি ছিলেন এক রাজ সন্ন্যাসী, মাতৃসাধক। দেশ ও দেশের মানুষ ছিল তাঁর আরাধ্য ইষ্টদেবতা।তিনি জানতেন, ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষকে শুধু শারীরিকিভাবেই লুন্ঠন করেনি তার আত্মাকেও ক্ষতবিক্ষত-রক্তশূন্য করেছে। ছিনিয়ে নিয়েছে তার হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য-সংস্কৃতির অপূর্ব সৌরভ, তার আত্মবিশ্বাস, তার সুপ্রাচীনকালের বিশ্বজয়ের অম্লান স্মৃতি। সেই কারণেই তারা টানা দু’শো বছর টিকতে পেরেছে।

নেতাজি বিশ্বাস করতেন, ইউরোপীয়দের আবিষ্কার করা ‘এরিয়ান ইনভেনশন ‘ থিওরি একটা ডাহা মিথ্যা, একটা বিষাক্ত মিথ। দেখো, তোমরা সবে দেড় হাজার বছর আগে হঠাৎ মানুষ হয়েছো। তার আগে জঙ্গলে ছিলে। আমাদের পূর্ব-পুরুষরা, আর্যরা হঠাৎ করে এশিয়া মাইনর থেকে মাইগ্রেট করে এল – তাই তোমরা বেঁচে-বর্তে গেলে। নইলে যে কী হত! আর এত বছর পর, আমরা সেই আর্যদের খুরতুতো, জ্যাঠতুতো বংশধররা আবার দয়া করে এসে তোমাদের সুসভ্য করলাম। তোমাদের শাসন করে কৃতার্থ করছি, তোমরা কৃতজ্ঞতা দেখাও। আমাদের পূর্ণ অধিকার আছে তোমাদের আদ্যন্ত চাবকানোর, তোমাদের ক্রীতদাস করে রাখার। তোমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক ভাষাগত আগ্রাসনের দমনের মধ্য দিয়ে লুঠপাট করাটাই আমাদের নির্বিচার স্বত্ত্ব। নেতাজি ইউরোপিয়দের এই দাসখতে পদাঘাত করেছিলেন।

ইংরেজরা জানত, সুভাষ বোস যদি কোনওভাবে হাতে ক্ষমতা পায়, তাহলে আসন্ন বিপদ। তাদের সাধের ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ইহকাল-পরকালে পিঁপড়ে পড়বে। তাই ষড়যন্ত্র।আর ষড়যন্ত্র তো একা-একা হয় না, দোসর লাগে। ঠিক যেমন যাত্রা-নাটকে লাগে প্রম্পটার। ভারতের যে ‘স্বাধীন সংগ্রামে’র পান্ডুলিপি তারা তাদের বশংবদ কংগ্রেসি নেতাদের দিয়ে পাঠ-অভিনয় করিয়েছে, নেতাজি তাদের সঙ্গে এক মঞ্চে থাকতে পারেননি।তারা জানত, দোসরের আবার তস্য দোসর আছে, ডান আর বাম।ইংরেজ যতবার দাঁত-নখ শানিয়েছে, ততবার অলক্ষ্যে হেসেছেন বিধাতা। যে বেয়াড়া-দামাল ছেলেগুলো কোনওদিনই ব্রিটিশের শেখানো মন্ত্র মেনে নেয়নি, ক্রমে সুভাষ তাদের নয়ণের মণি হয়ে উঠছিলেন।

সুভাষ মনে মনে পণ করেছিলেন, ব্রিটিশদের ঘাড় ধরে তাড়াবেন। তিনি একটা মোক্ষম সুযোগ খুঁজছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা তাঁকে সেই সুযোগ করে দিল।ইংরেজ শাসকরা বিপদের গন্ধ পেয়েছিল। তারা সুভাষকে গৃহবন্দি করলেন। কারণ, ইংরেজরা জানতো গান্ধী-নেহেরু-প্যাটেল নয়। ভারতে তাদের একটাই ‘প্রবলেম’। তার নাম সুভাষ বোস। কিন্তু সুভাষ বোসকে রোখা যায় না। যায়নি। জতুগৃহ দিয়ে পঞ্চপান্ডবকে থামাতে পারেনি কৌরবরা। ভগতরাম তলওয়ার, আচ্ছার সিং চিনা প্রমুখ গদর বিপ্লবীদের গোপন সহযোগিতায় ১৯৪১ সালের ২৬ জানুয়ারি সুভাষ দেশ ছাড়লেন। শুরু হল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সশস্ত্র সংগ্রামের চূড়ান্ত অধ্যায়। আজও যার অনেকটাই অজানা।

সুভাষ বোস যে কত ‘প্রবলেম’ ছিলেন, ব্রিটিশরাই তা হারে হারে জানত, স্বীকারও করত। যথা সময় এল সেই কালো অধ্যায়। ১৯৪৫ সালের মে মাস। স্ট্যালি্নগ্রাডে পর্যুদস্ত জার্মানি আত্মসমর্পন করলো। জাপানিরা আত্মসমর্পনের দিন গুনছে, তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। তবু হিরোশিমা, নাগাসাকিতে কয়েক মিনিটের মধ্যে আড়াই লক্ষ মানুষকে ঝলসে পুড়িয়ে ছাই করল আমেরিকা। আজও বিস্ময়, জাপান আত্মসমর্পন করবেই, আজ নয়তো কাল। একথা নিশ্চিত জেনেও মার্কিনিরা কেন করল এমন পৈশাচিক কাজ? স্তব্ধ-নির্বাক হয়ে পড়ল বিশ্ব-জনমত। কেন? মানহাটান প্রকল্পের সমীক্ষা সম্পূর্ণ করতে?নাকি আজাদ হিন্দ বাহিনির অগ্রগতিকে ঠেকাতে। কারণ, ততদিনে ‘জয় হিন্দ’এর তূর্যনিনাদ ছড়িয়ে পড়েছে মণিপুরের আকাশে-বাতাসে।

ইংরেজ সেনা ছাউনির প্রাচীর ভেঙে পড়ছে। ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান আর্মির ব্যারাকের ফেন্স টপকে আজাদ হিন্দ বাহিনীতে যোগ দিতে শুরু করেছে ভারতীয় সেনারা। আজাদির খুসবু আগুনের মতো ছড়িয়ে পরেছে ভারতজুড়ে। সুদূর পশ্চিমে বোম্বাই-সুরাটে ইউনিয়ন জ্যাক ছিঁড়ে জয়-হিন্দ ধ্বনী দিতে দিতে রাস্তায় নেমে এসেছে ৭৮টি রণতরীর প্রায় ২৬ হাজার ভারতীয় সৈন্য। ব্রিটিশ রয়্যাল আর্মিতে একদিকে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন কালা আদমির ফৌজ, অন্যদিকে মাত্র চল্লিশ হাজার শ্বেতাঙ্গ সৈন্য।নব্বই বছর আগেকার ট্রমা ফিরে এল ব্রিটিশ রাজ পুঙ্গবদের চোখ-মুখে। ভয়ে প্রাণ প্রায় খাঁচাছাড়া ঘৃণার পাত্রে বিজাতীয় বিদ্বেষ। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেই বসলেন, “আই হেট ইন্ডিয়ানস। দে আর অ্যা বিস্টলি পিপল উইথ অ্যা বিস্টলি রিলিজিয়ন।” সেই ঘৃণারই জয় হল আর বিদ্বেষের রাজ্যাভিষেক। হয়তো বিধাতারও সেই ইচ্ছেই ছিল। পরমাণু দানবের ধারালো জিভের ডগায় অগ্নিদগ্ধ উইপোকার মতো গুটিয়ে গেল হিরোশিমা-নাগাসাকি। জাপান নিঃশর্ত আত্মসমর্পন করলো। আরও একবার বিজয়ীরাই ইতিহাস রচনা করল নিজেদের সুবিধা মতোন করে।

পূর্ব রণাঙ্গনে আজাদ হিন্দ ফৌজের সাপ্লাই লাইন ধ্বংস  হয়ে গেল। ঘাস-পাতা খেয়ে পৌরাণিক বীরের মতো লড়াই করতে লাগলো আজাদ হিন্দের মুক্তি ফৌজ। খালি পেটে তাও লড়া যায়, বিনা গোলা-বারুদে যায় না। বড়সড় লোকক্ষয় এড়াতে আজাদ হিন্দ ফৌজকে আত্মসমর্পন করতে বললেন নেতাজি। সেই সঙ্গে নিজেও নিলেন এক চরম সিদ্ধান্ত। যা কেবল পারেন এক যুগনায়ক। ব্রিটিশদের কাছে নিজে সশরীরে ধরা দিয়ে স্বেচ্ছামৃত্যু চাইলেন সুভাষ। আজাদ হিন্দ বাহিনীর সতীর্থদের তিনি জানালেন- নিজের প্রাণ দিয়ে গোটা দেশের মানুষের স্বাধীনতা-স্পৃহাকে “গ্যালভানাইজড” করে দিয়ে যেতে চান। কিন্তু সতীর্থরা কেউ রাজী হলেন না। তাঁরা বললেন, ভারত স্বাধীন হবেই। মরে গিয়ে নয়, দেশমাতৃকার সেবা তাঁকে করে যেতে হবে বেঁচে থেকে।

ভারত “স্বধীন” হল ঠিকই। কিভাবে, কিসের বিনিময়ে হল, আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। তবে যে সুভাষ বোস নিজের প্রাণের বিনিময়ে দেশবাসীকে গ্যাল্ভানাইজড করতে চেয়েছিলেন, সেই সুভাষ দশকের পর দশক দেশের মাটিতে সাধুর বেশে আত্মগোপন করে থাকবেন কিসের ভয়ে? যুদ্ধপরাধী চিহ্নিত হবার ভয়ে? সে-তো ভয়ের বাড়ি গিয়ে তারই বাড়ির ঠিকানা খোঁজার চেয়েও অবিশ্বাস্য! নাকি সুভাষ মেনে নিয়েছিলেন দেশমাতৃকার মর্মান্তিক অঙ্গচ্ছেদ? অনিচ্ছা হলেও গ্রহণ করেছিলেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ইচ্ছাকৃত মন্বন্তরের গণহত্যা আর কলঙ্কিত ক্ষমতা হস্তান্তর ও কমনওয়েলথ ভুক্তির উচ্ছন্ন বৃত্তির চুক্তি সইকে? কখনই না। তাহলে কি কারণে এই সম্ভাব্য আত্মগোপন? সে কি এমন কোনও সুগোপন মিশন, যার জন্য একান্ত জরুরী ছিল এই আত্মগোপন?বহুবার এমন গুজব ছড়িয়েছে, চিন-ভারত যুদ্ধে চিনের চূড়ান্ত পশ্চাদ -অপসারণ, লাল-চিনের চোখে ধুলো দিয়ে দলাই লামার ভারতে আগমনের পিছনে ছায়ার মতো দাঁড়িয়েছিলেন নেতাজি।

শোনা গিয়েছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মাত্র ক’দিনের মধ্যে ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাক-বাহিনীর আত্মসমর্পনের পিছনেও ছিল নাকি নেতাজির সুনিপুণ পরিকল্পনা। এমনকি, ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার শোচনীয় দশার পিছনেও কাজ করেছিল সুভাষের মাস্টার প্ল্যান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান ঢাকায় যে প্রথম বক্তৃতা দেন তাতে নাকি তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভ এতাই প্রমাণ করে যে নেতাজি আজও বেঁচে আছেন। একথা বঙ্গবন্ধু বলে থাকলেও আজ তার নামগন্ধও নেই কোনও মহাফেজখানায়।

কেন নেই?

প্রশ্ন উঠতেই পারে। বঙ্গবন্ধু কথাটি কি আক্ষরিক অর্থে বলেছিলেন? বহুকাল পরে মুজিব কন্যা সেখ হাসিনা কলকাতায় এসে নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোয় দাঁড়িয়ে স্বীকার করে গিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু সত্যিই কথাটি বলেছিলেন। তাহলে আরও প্রশ্ন, নেতাজি যদি এত কিছুই করলেন, তিনি কি সব একা করলেন? কাদের মাধ্যমে করলেন? তারা কারা? সত্যিই যদি কোনও সিক্রেট বডি বা গোপন সংগঠন ভারতীয় উপ-মহাদেশে সক্রিয় থাকতো, তাহলে তার কিছু খবরাখবর কি প্রকাশ্যে আসতো না? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, ভারতের মাটিতে সরকারের নাকের ডগায় সাধুর বেশে স্বয়ং নেতাজি। দেশের তাবড়-তাবড় নেতা-মন্ত্রী-সেনাকর্তা তাঁর কাছে যাওয়া-আসা করেন। অথচ তৎকালীন উত্তরপ্রদেশ সরকার, ভারত সরকার সব জেনেও নিষ্পৃহ, নিরাসক্ত, এ বড়ই স্ব-বিরোধী। অতীত ইতিহাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীণ। বিশ্বাস কি সহজে হয়? ক্রমশঃ

Published on: জানু ২৭, ২০২১ @ ১৯:০১


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

− 1 = 2