সম্ভাবনা থাকলেও উদাসীনতার জন্যই পর্যটনে পিছিয়ে পশ্চিমবঙ্গ- মনে করেন পর্যটন চিন্তাবিদ বি দাস

Main এসপিটি এক্সক্লুসিভ ভ্রমণ রাজ্য
শেয়ার করুন

  • “বৌদ্ধগয়া থেকে বাসগুলি আসে। তারপর তারা বিদেশি পর্যটকদের কলকাতা বিমানবন্দর থেকে তুলে নিয়ে ১০ ঘণ্টার বাস জার্নি করে সেখানে পৌঁছে দেয়।এক টাকাও তারা খরচ করে না এখানে।”
  • “এই পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারলে শুধু রাজ্যের আয়ের পথ প্রশস্তই হত না, কর্মসংস্থানের পথও খুলে যেত। এটা বোঝানো পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে আজ পর্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।”

সংবাদদাতা- অনিরুদ্ধ পাল

Published on: জুলা ১১, ২০১৯ @ ২০:১৬

এসপিটি নিউজ, কলকাতা, ১১জুলাই:  এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি…’

কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা বিখ্যাত গানের এই লাইনগুলি আজও কিন্তু প্রাসঙ্গিক। দরকার শুধু আমাদের ভিতর একটু সচেতনতা। দরকার আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গকে আপন করে নেওয়া। একে ভালোবাসা। এত কিছু ফুলে-ফলে-ঐশ্বর্যে-সম্পদে ভরপুর এমন সুন্দর এক স্থানকে আমরা আজও ভারতের সেরা পর্যটনের ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি।

স্বাধীনতার ৭০ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও আমাদের এখন এর কারণ খুঁজে বেড়াতে হচ্ছে।পশ্চিমবঙ্গের এক অভিজ্ঞ পর্যটনপ্রেমী পর্যটন শিল্প নিয়ে চিন্তাশীল মানুষ সিটি ট্রাভেলসের কর্ণধার ট্রাভেল এজেন্টস ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া(টাফি)’র সাধারণ সম্পাদক বিলোলাক্ষ দাস বিষয়টি নিয়ে তাঁর সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন সংবাদ প্রভাকর টাইমসকে।

পর্যটন চিন্তাবিদ টাফি’র সাধারণ সম্পাদক বি দাস মনে করেন- “ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গে সম্ভাবনা বেশি থাকলেও শুধুমাত্র রাজ্য সরকারের উদাসীনতার কারণেই পর্যটনের প্রসার লাভ হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকে এ রাজ্যে যত সরকার এসেছে প্রায় সকলের মধ্যেই কম বেশি এই উদাসীনতা দেখা গেছে।”

পর্যটন নিয়ে ভাবনা-চিন্তার অভাব পশ্চিমবঙ্গে

“এটা এমন এক শিল্প যাকে আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। এটা এমনই এক দফতর যেখানে সমাজের সকলকেই প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে এই পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারলে শুধু রাজ্যের আয়ের পথ প্রশস্তই হত না, কর্মসংস্থানের পথও খুলে যেত। এটা বোঝানো পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে আজ পর্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার পর্যটনের ট্যুরিস্ট বাংলোগুলিকে সুন্দর করে মেরামত করেছে। সেখানে থ্রি-স্টার লেভেলের মান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যা আছে, প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য, কিছুই নয়। উইকেন্ডে কলকাতার বাইরে যে কোনও জায়গায় যেতে চাইলে যেতে পারেন সেখানে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা খুবই ভাল। কিন্তু তা সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষন করা দরকার। সঠিক জায়গায় স্থাপন করা দরকার। এরজন্য সঠিক পরিকল্পনা দরকার।” বলেন বি দাস।

অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় কিছুই নয়

অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে তুলনা টেনে তিনি বলেন-“আপনি যদি দেখেন সারা ভারতবর্ষে সব চেয়ে বেশি পর্যটক বাইরে ঘুরতে যায় আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গ থেকে।আজ বাঙালিরা দীঘা-মন্দারমণি-শঙ্করপুর বেড়াতে যায়। কিন্তু সেখানে পর্যটনের জন্য যেভাবে এগোনো উচিত সেটা সঠিকভাবে হচ্ছে না। কারণ, রাজ্যের বাইরে থেকে কিংবা দেশের বাইরে থেকে পর্যটকদের এখানে টানতে হবে। যেটার খুব প্রয়োজন। সেটা হচ্ছে না। আগে আন্তর্জাতিক পর্যটন মেলায় পশ্চিমবঙ্গের কোন অংশগ্রহণই ছিল না। সেটা আস্তে আস্তে হলেও কিছুটা বেড়েছে। এক্ষেত্রে খুব ইউনিক উদাহরণ হচ্ছে কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ। যাদের কিছুই নেই তারাও এখন এগিয়ে গিয়েছে। কেরালা ছোট একটা জায়গা সেখানে কিছুই নেই। তারাও এখন পর্যটন ব্যবসায় এগিয়ে গিয়েছে শুধুমাত্র প্যাকেজিং-এর জন্য।”

উড়িষ্যা এখন অনেক এগিয়ে গেছে। তারা শুধু ভিতরকণিকা দেখাতে তৎপর হয়ে উঠেছে। কেরালায় তো কোনও শিল্পই নেই। শুধুমাত্র ওরা এগোচ্ছে পর্যটন ব্যবসাকে সামনে রেখে।

বহুবার প্রস্তাব দিলেও আজ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে আমরা বহুবার পর্যটনের প্রসারের জন্য প্রস্তাব দিয়েছি। আমাদের প্রথম প্রস্তাব ছিল লোকবলের উপর জোর দেওয়া। একটা লোক বিমানবন্দর কিংবা রেলওয়ে স্টেশনে নামলে তার সাহায্যের জন্য সেখানে একটা হেল্পডেস্ক থাকা দরকার। বিশেষ করে ট্যাক্সি চালক তাদের ঠিকমতো প্রশিক্ষন হওয়া উচিত।’অতিথি দেব ভবঃ’ সেই ব্যাপারটা যাতে থাকে। রাস্তাঘাট এখন তৈরি হয়েছে কিন্তু তার সাথে তার মতো করে পর্যটনসুলভ হওয়া দরকার সেটাই হয়নি।কার্যকর হয়নি কিছুই।

বিদেশি পর্যটক টানতে ব্যর্থ পশ্চিমবঙ্গ

“আপনি শুনলে অবাক হয়ে যাবেন বৌদ্ধদের সব চেয়ে বড় পীঠস্থান হচ্ছে বৌদ্ধগয়া। তার সঙ্গে লুম্বিনী, সারনাথ এই একটা সার্কিট আছে। এটা ট্র্যাডিশনালি কলকাতা থেকেই হত। এখনও উড়ান সরাসরি বৌদ্ধগয়ায় যায়। কিন্তু সেটাও মরশুম অনুযায়ী। সারা বছর যায় না। ইস্টার্ন ব্লকটা খোলার পর চিন হল একটা বড় দেশ- চিন, জাপান, কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া এই দেশগুলির বহু পর্যটক কলকাতা হয়ে যায়। কলকাতায় সে একটা টাকাও খরচ করে না। খুবই দুর্ভাগ্যজনক। যে লোকগুলো উড়ানে করে নামে কলকাতা বিমানবন্দরে, নেমে বাসে করে সরাসরি বৌদ্ধগয়ায় চলে যায়। বাসগুলি আসে কিন্তু ওই বৌদ্ধগয়া থেকেই। অর্থাৎ বৌদ্ধগয়া থেকে বাসগুলো আসে এসে তারা পর্যটকদের কলকাতা বিমানবন্দর থেকে ১০ ঘণ্টার বাস জার্নি করে নিয়ে যায়।”  হতাশার সুরে কথাগুলো বলছিলেন বি দাস।

পরিকল্পনার চূড়ান্ত অভাব

তিনি বলেন-“আজ যখন কলকাতার উপর দিয়ে বিদেশিরা যাচ্ছে তখন এখানে দুটো দিন কাটিয়ে যাক। কলকাতায় এমন কিছু জিনিস আছে যা সারা পৃথিবীতে নেই।আমরা কলকাতায় ন্যাশনাল মিউজিয়ামের কিউরেটরের সঙ্গে কথাও বলেছি- যে চাইলে তারা সেটাও পর্যটকদের জন্য প্রদর্শন করতে পারে। যা অমূল্য এক বৌদ্ধ রেপ্লিকা। যার সামনে দাঁড়িয়ে তারা পুজো কিংবা ধর্মীয় রীতিনীতিও পালন করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে বহু জায়গায় বৌদ্ধদের সভ্যতা ছিল।নতুন নতুন স্থানের আবিষ্কার হচ্ছে তা নিয়ে কোনও প্রমোশন নেই। এটা তো একটা পরিকল্পনা। আমরা শুধু বলতে পারি। আমরা যখন বলতে যাচ্ছি তখন সেখানে সচিব বদল হয়ে যাচ্ছে। বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের ট্যুরিজম কমিটি পশ্চিমবঙ্গের ট্যুরিজম কমিটিতে একাধিকবার মিটিং হয়েছে। কিন্তু কিছুই হয়নি। আসলে এখানে সম্ভাবনা প্রচুর কিন্তু সরকারি উদাসীনতার কারণেই পশ্চিমবঙ্গে পর্যটনের প্রসার লাভ হচ্ছে না।”

বাংলাদেশ পারলেও আমরা পারি না

“আপনি বললে বিশ্বাস করবেন না সুন্দরবন-এর একটা বড় অংশ বাংলাদেশে আছে। আজকের দিনে বাংলাদেশে গেলে সুন্দরবন নিয়ে যেভাবে প্যাকেজ করা যায় খুলনা থেকে করে ওখানে যা আছে সেই জিনিস কি পশ্চিমবঙ্গে আছে? আসলে এখানে সেই চিন্তাধারাটাই নেই। এখানে পাখিরালয়ে হোটেল করা হচ্ছে যেখানে মদ খাওয়া আর বেল্লেলাপনা করতে যায় এক শ্রেণির মানুষ। ওরকম একটা হেরিটেজ সাইট তার আজ কি করুণ অবস্থা।” বিস্ময় প্রকাশ করেন বি দাস।

করুণ হাল টেরাকোটার

“আপনি দেখলে কষ্ট পাবেন বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে টেরাকোটার মন্দিরগুলি যেভাবে যে অবস্থায় আছে যেখানে বাংলাদেশের দিনাজপুরে টেরাকোটার মন্দির চকচক করছে। একদম ওই রঙে। আমি একটা জায়গায় গিয়েছিলাম ৬০০ বছরের পুরনো একটা মন্দির আছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের কর্ণগড় বলে একটি জায়গা সেখানে একটি কেল্লা আছে। উন্নয়ন বলতে যা বোঝায় প্রাচীন কালের যে পাথরগুলো ছিল তার উপর মার্বেল বসিয়ে দিয়েছে। গরমকালে হাঁটতে গেলে পা পুড়ে যায়। এটাকে আপনি উন্নয়ন বলতে পারেন না।”

গুজরাট পারলেও আমরা কেন পারি না?

বি দাস বলেন- “আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মতো একটা জায়গা পর্যটনের জন্য। সারা পৃথিবীতে এমন জায়গা খুব কম আছে।আপনি জানেন, গুজরাটে যে শীতকালে রান উৎসব হয় কচ্ছের যে রান সেটাই। যখন আলো পড়ে শীতকালে পূর্ণিমার রাতে তো সাদা মরুভূমি মনে হয়। এখন সেখানে হোটেল পাওয়া যায় না। ওই সময় ২০-২৫ হাজার টেন্ট লাগায় রুম পাওয়া যায় না।”

“আজকে গুজরাটে ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’ হল- আমাদের এখান থেকে একেবারে বিনা মূল্যে নিয়ে গেছে। তাও আবার বিমানে। এক টাকা খরচা লাগে নি। পুরোটাই গুজরাট সরকার খরচ করেছে।”

বিদেশে খাবার তৈরির স্থান হয়েছে পর্যটন কেন্দ্র

আজকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটনের ট্যাগ লাইন কি-‘সুইটেস্ট পার্ট অব ইন্ডিয়া’। তার মানে এখানে সুইট বলে একটা ব্যাপার থাকে। আমরা বিদেশে গেছি- ইংল্যান্ডে যেখানে পৃথিবীর সেরা স্কচ-হুইস্কি তৈরি করা হয়, সেখানে আপনাকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয়। যদি আপনি সুইৎজারল্যান্ড যান তাহলে আপনাকে চকলেট ফ্যাক্টরিতে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হবে। আজকে কলকাতা শহরে কিংবা কলকাতা থেকে ১০০ কিলোমিটার জায়গার মধ্যে এক একটি জায়গার মিষ্টি আছে। এগুলি নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যাথা আছে? এগুলিকে তো পর্যটনের বিষয়বস্তু করে তোলা যেতেই পারে। একশো বার পারে।

ইতিহাসকে নিয়েও কিন্তু পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব

এইসবের পাশাপাশি রাজ্যের ইতিহাস নিয়েও যে পর্যটন শিল্প গড়ে উঠতে পারে তা নিয়েও আলোকপাত করেন বি দাস। তিনি মনে করেন-“আর একটা বিরাট দিক হল ইতিহাস। আমি পুরনো ইতিহাস বাদই দিলাম। ২০০-৩০০ বছরের যে ইতিহাস আছে। এখানে বহু বিদেশি এসে শাসন করে গিয়েছে। ইংরেজদেরও আগে ডাচ-পর্তুগীজ-ফরাসি-ওলন্দাজ অনেকেই এসেছে। ইহুদি-চাইনিজ-জাপানিজ-বার্মিজরা এসছিল। কলকাতা একটা সত্যিই দর্শনীয় স্থান। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে সেটা আমরাই রক্ষা করতে পারছি না। শ্রীরামপুরে এশিয়ার প্রথম পেপার মিল তৈরি হয়।এসবের ইতিহাস অসাধারণ। আমাদের এখানে যেসব কবরস্থানগুলি আছে যারা আজ বিদেশে চলে গেছে যাদের পূর্ব পুরুষদের কবর এখানে রয়ে গেছে তারা এখানে আসবে দেখতে। এগুলি শুধুমাত্র সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে, তাহলেই হবে। সেটাই হচ্ছে না। চাইনিজ চার্চ, জাপানিজ টেম্পল- এসব ছেড়ে দিন সারা ভারতবর্ষ থেকে তামিলনাড়ু, গুজিরাটিরা, সিংজিরা তারা এই শহরটাকে নিজের শহর করে নিয়েছে। তাদের একটা কৃষ্টি-সংস্কৃতি সব কিছু আছে। এটাকে পর্যটনের প্রসারে কাজে লাগানো যায় না?”

“পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উৎসব হল দুর্গাপুজো। লোকে কার্নিভাল বলতে বোঝে ব্রাজিলের রিও-ডি-জেনিরোতে কার্নিভাল। সেই তুলনায় আমাদের এখানকার দুর্গাপুজো উৎসব অনেক বড় কার্নিভাল। সেটাও যা হচ্ছে তা অনেক অগোছালো। একটা পর্যটক আসবে সে ঘুরবে সে দেখবে। আজকে একজন পর্যটকের পক্ষে তো সুরুচি সঙ্ঘে তিন ঘণ্টা লাইন দিয়ে ঠাকুর দেখা সম্ভব নয়। সেই কো-অর্ডিনেশনের অভাব।” মনে করেন বি দাস।

সমাধানের উপায়

“এ থেকে সমাধানের একটাই পথ তা হল সরকারি স্তরে ইতিবাচক চেতনা। অর্থাৎ যারা সরকারে থাকবে এ রাজ্যে তাদের বেশি করে এই সম্পর্কে ভাবা দরকার। তাদের মধ্যে চেতনার উন্মেষ দরকার তবেই পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের ব্যবসায় নাম করতে পারবে।” মনে করেন বিলোলাক্ষ দাস।

Published on: জুলা ১১, ২০১৯ @ ২০:১৬


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

63 − = 59