শীতে প্রাণীর পরিচর্যা করতে চান, ভাবছেন কিভাবে , তাহলে মন দিয়ে পড়ুন এই প্রতিবেদন

দেশ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান রাজ্য
শেয়ার করুন

সংবাদদাতা– ডা. সৌমিত্র পন্ডিত

Published on: নভে ২৮, ২০১৮ @ ০৯:৫৯

এসপিটি নিউজ, কলকাতা, ২৬ নভেম্বরঃ “প্রতিরোধ রোগের চিকিৎসার চেয়ে বেশি ভাল”

শীতকালে সব থেকে বেশি ক্ষতি হয় বা অসুস্থ হয়ে পড়ে বাচ্চা। সঙ্গে বয়স্ক প্রাণীরাও রোগগ্রস্ত হয়। তাই সকল প্রাণীর দেখভাল নিতে হবে। সঠিক পদ্ধতি বিজ্ঞান ভিত্তিক ভাবে যদি আমরা প্রাণীপালন করি তাহলেই কেবলমাত্র অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যাবে।

পশ্চিমবাংলার ৭০ শতাংশ গ্রামীণ মানুষ আজ কৃষি ও প্রাণীপালনের সঙ্গে যুক্ত যার বেশিরভাগটাই ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি তাদের বড় খামার করার ক্ষমতা নেই কিন্তু দুটো, চারটে বা দশ-বিশটা ছাগল-ভেড়া বা মুরগি পালনের ক্ষমতা রয়েছে। জেনে রাখা ভাল- আমাদের রাজ্যের “বাংলার কালো ছাগল” আমি বলি “বাংলার কালো সোনা”- এই নামটা আমার ব্যক্তিগত দেওয়া। কারণ, দীর্ঘদিন প্রাণী চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে পশ্চিম বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামীণ মানুষের অর্থাৎ যাদের “নুন আনতে পান্তা ফুরায়”- যেসকল মানুষের আর্থিক উন্নতি এই “কালো ছাগল” পালনের মধ্য দিয়ে কিভাবে হয়েছে তা খুব কাছ থেকে দেখেছি দেখছি ও আগামিদিনেও আরও বেশি করে দেখবো, তাই এই প্রাণীটিকে “বাংলার কালো সোনা” নামে আর যে যাই বলুক উল্লেখ করলাম।তাই বলি-

করলে চাষ বাংলার “কালো সোনা”।

থাকবে না আর বাপের দনা।।

“কালো সোনা” পুষলে পরে

লক্ষ্মী আসে দূয়ার ভরে।।

ছাগল পালন বিশেষ করে গ্রামীণ পিছিয়ে পড়া মানুষ তথা তপশিলি জাতি, উপজাতি ও সংখ্যালঘু মানুষদের আরও বেশি করে প্রশিক্ষণ ও শিবিরের মধ্য দিয়ে প্রাণী পালনের মধ্য দিয়ে আর্থিক উন্নতি সাধনের যে প্রক্রিয়া সারা বিশ্বে শুরু হয়েছে সেই কর্মকান্ডে আমাদের দেশ অনেকটা এগিয়ে।প্রাণীপালনের যে বিশেষ দিকগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হল- পরিচর্যা ও রোগ ব্যাধি সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান থাকা জরুরী তবেই আশানুরূপ ফল পাওয়া সম্ভব।

আজ আমি শীতকালে প্রাণী পরিচর্যা কিভাবে করবেন তার কিছু তত্ত্ব আপনাদের জানাব-

গ্রামের মানুষ সাধারণতঃ গরু, ছাগল, ভেড়া হাঁস-মুরগি পালন করে থাকে।গোয়ালে গরু থাকে যা ঘেরা হয়। বিজ্ঞান ভিত্তিক উপায়ে প্রাণীদের ঘর পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত হয়ে থাকে ফলে উত্তর-দক্ষিনে হাওয়া চলাচল করতে পারে।শীতকালে হাওয়া উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়- যা শীতল বা ঠান্ডা হওয়ার ফলে প্রাণীদের অসসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।বিশেষ করে বাচ্চা এবং বয়স্ক বা গর্ভবতী প্রাণীরা।ঘরের ছাউনি খড় বা টিনের হয়ে থাকে।মেঝে মাটির, কাঠের বা বাঁশের পাটাতন বা সিমেন্টের  হয়ে থাকে।ফলে ঠান্ডা ও রোগব্যাধির হাত থেকে প্রাণীকে সুস্থ রাখতে হলে অবশ্যই করনীয় বিষয়গুলো নিলে বর্ণিত করলাম।

  • প্রথমত-ঘরের ঘোলা অংশে অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ পর্দা বা খড়ের ঢাকনার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে কোনভাবে ঠান্ডা বাতাস প্রাণীদেহে সরাসরি না লাগে।
  • দ্বিতীয়ত- সকালে রৌদ্র ওঠার ২-৩ ঘণ্টা অর্থাৎ শিশির শোকানোর পর প্রাণীদের মাঠে ছাড়তে হবে।
  • তৃতীয়ত, সন্ধ্যা নামার আগে প্রাণীদের ঘরে আনতে হবে।
  • চতুর্থতঃ গরু-ছাগল-ভেড়ার খুর যাতে সর্বদা শুকনো থাকে সেদিকে নজর দিতে হবে।
  • পঞ্চম- প্রাণীদের ঠান্ডা জল খেতে দেওয়া যাবে না।
  • ষষ্ঠ- মেঝেতে খড় বা গরম থাকার জন্য পাতা বা চট দিতে হবে যাতে প্রাণী দেহে ঠান্ডা না লাগে।
  • সপ্তম- ঘর সর্বদা শুকনো রাখতে হবে। ভেজা-স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে প্রাণীদের রোগব্যাধির অন্যতম কারণ।
  • অষ্টমঃ যথাসময়ে মলমূত্র পরিষ্কার করতে হবে। ঘরের বাহিরে রাতে কন প্রাণীকে রাখা যাবে না।
  • নবমঃবাচ্চা প্রানীর জন্য বিশেষ করে ছাগল বা ভেড়ার বাচ্চার জন্য ছোট্ট ঘেরা জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে যেখানে গরম থাকবে বাচ্চাগুলো। রাতে ঠান্ডা জল না দিয়ে হালকা গরম জল দেওয়া ভাল।
  • দশমঃ শীতকালে রোগব্যাধির মধেয় ঠান্ডা লেগে সর্দি বা কাশি বেশি হয়। যদি সঠিকভাবে সাবধানতাগুলো মেনে চলা যায় তাহলে সহজেই আমরা শীতকালে প্রাণীদের পরিচর্যা করতে পারবো।

সর্বোপরি অসুস্থ হলে প্রাণী চিকিৎসা সঠিকভাবে টিকাকরন-কৃমিনাশক সঙ্গে ভিটামিন আর একটু খনিজ লবন যোগে যদি আপনারা প্রাণীপালন করেন তাহলে আয়ের দিকে তাকাতে হবে না।আপনারা যারা ভাবছেন কিছু না করে আয় হচ্ছে তাহলে শুধু শুধু কেন খরচ করবো। একবার একটু বিজ্ঞান-ভিত্তিক উপায়ে প্রাণীপালন করুন দেখুন আগের থেকে বেশি লাভবান হচ্ছেন কিনা। তারপর সময়েই বলবেন আপনি কোন পথে যাবেন। লেখগুলো পড়তে থাকুন।

চাষি বন্ধুদের কিছু জানার থাকলে চিঠি পাঠান বা যোগাযোগ করুন sangbadprabhakartimes2015@gmail.com। এই মেলে। অথবা ৭সি বিজয়নগর, নৈহাটি, পিন-৭৪৩১৬৫, উত্তর ২৪ পগনা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

সূচনা

আমরা জানি বর্ষা-বাদল-বরফ-ঠান্ডা শীত এগুলো দ্বিপদ বা চারপদ বা চতুষ্পদ প্রাণীদের খুব ভোগায়। কিন্তু দুপায়ী প্রাণীরা গরম জামাকাপড় পরে বা ঘরের একধাপ গরম পানীয় নিয়ে নিজেদেরকে গরম করে নেয় খুব সহজে। অন্যদিকে চারপেয়ে অর্থাৎ চতুষ্পদ প্রানিদের কিভাবে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখবেন ভেবেছেন কি? আজ তাই এই প্রতিবেদন-বিশেষত- জল, প্রয়োজনীয় শক্তি, খাদ্য, দেহাবস্থা, আশ্রয়স্থল, কাদামাটির সঠিক ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য গবেষক, এই বিষয়গুলির দিকে নজর দিতে হবে।জানিয়ে রাখি-“জলই জীবন”- কিন্তু সেই জল যদি দূষিত বা সংক্রামিত হয় তাহলে তা প্রাণ হানির ও কারণ হতে পারে। তাই বিশুদ্ধ জল খাওয়ানো জরুরী।

  • শীতকালে প্রা্ণীদের খাদ্য বেশি লাগে কারণ শক্তির বৃদ্ধির জন্য। ১-২ শতাংশ বেশি খাবার প্রয়োজন।
  • গর্ভবতী প্রাণীদের খাবারের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।নাহলে মরা বাচ্চার জন্ম বা জন্মের পর প্রাণী দেহের বৃদ্ধি সঠিক মাত্রায় হয় না।
  • ছাগল ভেড়া বা গবাদি প্রাণীদের খনিজ লবন শীতকালে সঠিক মাত্রায় দিতে ভুলবেন না। যা শীতের হাত থেকে প্রাণীদের রক্ষা করতে অনেকটা সাহায্য করে।
  • লোমশ প্রাণীদের অর্থাৎ উলযুক্ত প্রাণীর থেকেউলহীন প্রাণীর যত্ন বেশি নিতে হবে।

প্রাণী পালনের ক্ষেত্রে /আশ্রয়স্থল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শীতকালে। সঠিকভাবে আশ্রয়স্থল যদি ঘেরা না থাকে তাহলে খাদ্যের খরচ অনেক বেড়ে যায়। যদি খড় বা পাতা জাতীয় খাদ্য মেঝেতে দেওয়া হয় তাহলে সঠিক সময়ে তা পরিবর্তন করতে হবে না হলে অ্যামোনিয়ার ভাগ বেশি হয়ে যায় যা শ্বাসনালীর রোগ ব্যপ্তি ঘটায়। উৎপাদন কমে যায়।অপরদিকে, কাদা-মাটির সঙ্গে প্রাণীর নিবীড় যোগ। ফলে প্রতিটি প্রাণীকে সঠিক পরিচর্যা করতে হবে যাতে মাটি দ্বারা সংক্রান্তি রোগ ব্যধি প্রাণীদেহে না হয়। মাটি ভেজা থাকলে পরজীবীর ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাসের সম্ভাবনা বেশি হয়।

স্বাস্থ্য সম্বন্ধে বলতে গেলে যেটা মাথায় রাখতে হবে সেটা হল-এইসময় উকুনের উপদ্রব বেশি হয় এবং আন্তঃ পরজীবী-র ও প্রাণীদেহে বেশি থাকে তাই চারণভূমিতে যাতে পরজীবী সংক্রমন বেশি না হয় তারজন্য প্রাণীদেহে কৃমিনাশক ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। যা কেবলমাত্র প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাওয়াতে হবে।

সবশেষে একটা কথাই বলবো-মানুষের মতো প্রাণীদেরও খাদ্য -বাসস্থান ও পরিচর্যার প্রয়োজন। প্রতিরোধ-প্রতিকার ব্যবস্থা সঠিকভাবে প্রয়োগ ও ভালবেসে প্রাণীপালন করুন- আপনার লক্ষ্মীলাভ হবে।

(লেখক-পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী গবেষক ও চিকিৎসক)  

 Published on: নভে ২৮, ২০১৮ @ ০৯:৫৯

 

 

 

 

 


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

− 2 = 4