“শিল্পীদের পন্য মনে করবেন না শিল্পীরাও মানুষ”

Main বিনোদন রাজ্য
শেয়ার করুন

Published on: ফেব্রু ৫, ২০১৯ @ ১৭:০৮

এসপিটি নিউজ ডেস্কঃ সঙ্গীতশিল্পীরা গান গাইতে যান আয়োজকদের আমন্ত্রণে। শ্রোতাদের আনন্দ দান করাই তাদের উদ্দেশ্য থাকে। এজন্য তাদের একটা নির্দিষ্ট সময়ও ধার্য্য করা থাকে। কিন্তু তাই বলে তাদের সঙ্গে জুলুমবাজি করা, অসভ্যতামি করা, তাদের লাঞ্ছিত করা এসব আমাদের বাংলার সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে না।কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সেগুলি কিন্তু ইদানীংকালে দুটো ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ্যে চলে এল। কয়েক মাস আগে জি-সারেগামা-র এক মহিলা শিল্পী পূর্ব মেদিনীপুরে পুলিশের এক অনুষ্ঠানে গিয়ে চূড়ান্ত ভাবে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। তারপর ফের গত রবিবার কৃষ্ণনগরে গিয়ে প্রায় একই সমস্যার মুখোমুখি হয়ে ফিরতে হল বাংলার স্বনামধন্য সংগীত শিল্পী ইমন চক্রবর্তীকে। তিনি এতটাই অপমানিত আর লাঞ্ছিত হয়েছেন যে অনুষ্ঠানের আয়োজকদের বিরুদ্ধে ফেসবুক লাইভ করে ক্ষোভো উগরে দিয়েছেন। একই সঙ্গে রাজ্যের সমস্ত সচেতন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে শিল্পীর মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে পাশে থাকার আবেদনও জানিয়েছেন।

এই ঘটনার পর গোটা কৃষ্ণনগরে ছিঃ ছিঃ পরে যায়।গোটা এলাকার ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে যে বা যারা এমন ভাবে কালিমালিপ্ত করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও ওঠে। যদিও প্রকাশ্যে সেভাবে কাউকে সরব হতে দেখা যায়নি। তবে নতুন বোর্ড না হওয়ায় পুরসভার দায়িত্বে থাকা মহকুমাশাসক জানান- খোঁজখবর নিয়ে দেখছি। আয়োজক সংস্থা কৃষ্ণনগর সাংস্কৃতিক মঞ্চ অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছে। প্রাক্তন পুরপ্রধান অসীম সাহা অবশ্য এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে ঘটনাটিকে অত্যন্ত লজ্জাজনক বলেছেন।

ফেসবুক লাইভে ইমন চক্রবর্তী যা বলেছেন তা শুনুন শিল্পীর মুখেই।-

“থ্যাঙ্কলেস জব করে থাকি তো!”

“আমাদের টাইম দেওয়া ছিল সন্ধে সাতটা-সাড়ে সাতটা সেটা শুরু হয়েছে আটটা- সাড়ে আটটা। মিজিশিয়ানসরা পাঁচটার মধ্যে চলে এসে সাউন্ড চেক করে ফেলে।সমস্ত কিছুই ঠিক ছিল। রাখা হয়েছিল পুরসভার গেস্ট হাউসে। সেখানে তাদের এক গ্লাস জল পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। আমাদের রিসিভ করতেও কেউ আসেনি। সেটাও মেনে নিলাম যদি আমরা বেসিকালি একটা থ্যাঙ্কলেস জব করি তো!” ক্ষোভের সঙ্গে একথা বলে তিনি বলতে থাকেন- “তাতে কেউ জল দিলো-কি চা দিল-কি দিলো না, আমাদের সেটা নিয়ে কোনও দরকার নেই। আমাদের বেসিক কাজটা হচ্ছে যাব্‌ অনুষ্ঠান করবো। ভালোবাসা একে-অপরকে বিলোবো। এবং চলে আসবো। আমি এই নীতিতে বিশ্বাস করি।”

“আমরা কেউ বাঈজি নই, এখানে নাচতে আসিনি”

“দিনের পর দিন শিল্পীদের সঙ্গে যে অন্যায় হচ্ছে শিল্পীদেরকে পয়সা দিয়ে কিনে নেই নি। আমরা কেউ বাইজি নই। এখানে নাচতে আসিনি। আমাদেরকে চিৎকার করে বলবে দু’ঘণ্টা-আড়াই ঘণ্টা ধরে গান করব- তারপর তাদের এই অসভ্যতা। অত্যন্ত ভালো অডিয়েন্স ছিলেন। কৃষ্ণনগরের পুরসভার এই অনুষ্ঠানের যারা অডিয়েন্সরা ছিলেন তারা আমাদের রেসকিউ করেছেন। মহিলারা, বাচ্চা ছেলেরা গিয়ে দরজা ভেঙেছে তারা বলেছে- ইমনদি, এটা আমরা মানতে পারছি না। এটা তোমার সঙ্গে হতে পারে!” এক নিঃশ্বাসে বলে চলেন-” শুনুন, আপনাদের একটা কথা বলি, আপনারাই আমাদের ভগবান। হ্যাঁ, ভগবানও অন্যায় করলে ভক্তরা সেটা সহ্য করে না। আজকে যে ঘটনা আমার সঙ্গে কৃষ্ণনগর পুরসভার মানুষজন যেটা করলেন সেটা আনএক্সপেকটেড।”

“অনেকে মনে করেন শিল্পীরা হচ্ছি বিনোদনের পন্য”

এরপর ইমন এতটাই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন রীতিমতো ক্ষোভ ঝরে পড়ে তাঁর গলায়-“এসব জাতীয় পুরস্কার-টুরস্কার দিয়ে না কিচ্ছু হয় না। আমরা শিল্পীরা হচ্ছি বিনোদনের পন্য। আমাদেরকে পয়সা দিয়ে অনেকে মনে করেন আমি সবার কথা বলছি না। আজকে যেটা হল- একজন এসে বলল- এই দরজাটা বন্ধ করে দে, দেখি তুই এখান থেকে কি করে বেরোস। আজকে যখন এই ঘটনাটা আমার সঙ্গে ঘটছে ‘দেখি তুই এখান থেকে কি করে যাস’- আমি তো ওনার রক্তের সম্পর্কের কেউ নই যে উনি আমাকে তুই-তুকারি করে কথা বললেন। আমি কিন্তু একটা কথাও বলি নি। আমার ভাই গৌরবকে হেনস্থা করা হয়েছে আমার ছোট মেসোকে হেনস্থা করা হয়েছে।সব থেকে বড় কথা গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের যে দাদা সমস্ত নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে রয়েছেন সেই কৃষ্ণদা তাকে পর্যন্ত আটকে রাখা হয়েছে।”

“দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি- আমি কারও বাবার সম্পত্তি নই”

“এখানকার বাচ্চা বাচ্চা ছেলে- দিদিরা-বোনেরা আমাদের বের করেছেন। কৃষ্ণনগরবাসীর কাছে আমার কোনও অভিযোগ নেই। আমার অভিযোগ হল- কৃষ্ণনগর পুরসভার ওই সমস্ত অসভ্য মানুষ-বর্বরলোকগুলোর জন্য যারা মনে করেন শিল্পীরা ওদের বাপের সম্পত্তি।আমি দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি- আমি কারও বাবার সম্পত্তি নই। আমরা আপনাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য বেঁচে থাকি। তার মানে এই নয় তার জন্য আপনারা যা খুশি ভাবে আপনারা আমাদের সঙ্গে ব্যবহার করবেন। এই অন্যায়ের আমি প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং আমি আশা করব বিশ্বাস করব আমার এটা ধারণা- এই অন্যায়ের আপনারা বিরোধিতা করবেন। এবং কৃষ্ণনগর পুরসভার বিরুদ্ধে একটা ব্যবস্থা নেবেন। তারা যতক্ষন পর্যন্ত আমার কাছে লিখিত ভাবে ক্ষমা চাইছে আমি ততক্ষন পর্যন্ত আমি ওনাদের কিন্তু ছাড়ব না। আমি যেখানে যাওয়ার আমি যাব। একজন শিল্পীর সঙ্গে এই অত্যাচার দিনের পর দিন চলতে পারে না। আমরা কারও কেনা সম্পত্তি নই। শিল্পীদের মুডের একটা বিষয় আছে শিল্পীদেরও একটা হৃদয় আছে। শিল্পীদেরও হাসতে ভালো লাগে শিল্পীদেরও চোখে জল আসে- ভাই একটু বোঝো! ছেলেখেলা হচ্ছে?”

“প্লিজ, কৃষ্ণনগরবাসী-এই বজ্জাতগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন”

ইমন বলতে থাকেন-“এই কোনও শিল্পীকে স্টেজে উঠে উলটো পালটা অঙ্গভঙ্গী করবে সে লাইভ করে কাঁদবে একজন শিল্পীকে আটকে রেখে দেবে লাইভ করে কাঁদবে দেখতে খুব ভাল্লাগে নাকি? দেখে খুব আনন্দ লাগছে যে শিল্পী কাঁদছে। খুব ভাল লাগছে। আটকে রেখে দিচ্ছি। পয়সা দিচ্ছি। আটকে রেখে দিচ্ছি। আরে কেয়া বাত। বাঃ দারুন। কিন্তু আমি বার বার করে বলছি- কৃষ্ণনগরের মানুষজন আমাদের বাঁচিয়েছেন। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কিন্তু প্লিজ কৃষ্ণনগরবাসী, যদি শিল্পীদের ভালোবেসে থাকেন বাংলার সংস্কৃতির ধারক ও বাহক আপনারা হন আপনারা তাহলে কৃষ্ণনগর পুরসভার এই বজ্জাতগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। আমি সত্যিই দুঃখিত- এই শব্দ প্রয়োগ করার জন্য, কিন্তু আমার কিছু করার নেই। আমার সঙ্গে আমার বাবা এসেছেন তিনি একজন অসুস্থ মানুষ। আমার সঙ্গে একজন আঙ্কল এসেছেন আমাদের গোটা টিম এসেছে। আমরা যাদের হয়ে অনুষ্ঠান করতে আসি তাদের আমাদের সিকিউরিটি দেখার দায়িত্ব তাদের আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার দায়িত্ব- তাদের দায়িত্ব শুধু স্টেজের নীচে নাচ করব আর গান শুনব। সে কি খেল সে কিভাবে এল তা নিয়ে তাদের কোনও দায়িত্ব নেই।”

“একজন শিল্পী হিসেবে আমি বলছি- আমি ভীত”

ইমন এক নাগাড়ে বলে চলেন- “অসভ্যতামি আর নোংরামির জায়গায় চলে যাচ্ছে এই স্টেজের জায়গাগুলো। এর পর যা দাঁড়াচ্ছে- পুলিশ ফোর্স নিয়ে অনুষ্ঠান করতে যেতে হবে। আজকে প্রশাসনিক স্তরের অনুষ্ঠান ছিল সেই জায়গাটা নিয়ে আমি যথেষ্ট ভীত। একজন শিল্পী হিসেবে আমি বলছি- আমি ভীত। এভাবে চলতে পারে না। আপনারা প্লিজ একটু সঙ্গে থাকবেন। এই আন্দোলনের সঙ্গে থাকবে্ন। এদের এই অত্যাচার এই বর্বরতা কিছুতেই সহ্য করা যায় না।”

“গেট আটকে রেখে দিল। খুলতে দেবে না এত বড় সাহস!”

“আপনারা প্রত্যেক অডিয়েন্সের কাছে শুনেছেন আমি কতক্ষন গান করেছি কতক্ষন আমার গান করার কথা। দেড় ঘণ্টা গান করার কথা আমি পৌনে দু’ঘ’ণ্টা গান করেছি। প্রত্যেকেই বলেছেন শুধুমাত্র কয়েকজন অভদ্র লোক এই ঘটনাটা আজকে ঘটিয়েছেন। যেটার প্রতিবাদ হওয়া উচিত। একটা গেট আটকে রেখে দিল। খুলতে দেবে না এত বড় সাহস। মনে করছে কি চারপাশে সব মরা মানুষগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে? তাদের হাত-পা-গলা নেই? সেই জ্যান্ত মানুষগুলো আমাদের গেট ভেঙে বের করেছে। কলেজের বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলো, এখানকার মায়েরা-বোনেরা, বয়স্ক ভদ্রলোকরা গেট ভেঙে আমাদের বের করেছেন। আজকে এটা আমাদের প্রাপ্তি। আমার প্রাপ্তি আপনাদের কাছ থেকে। কৃষ্ণনগর পুরসভা আপনাদের ধিক্কার জানাচ্ছি। এরপর আপনারা যদি অনুষ্ঠান করতে না ডাকেন আমার কিচ্ছু যায়-আসে না। আমি জানি কৃষ্ণনগরবাসী কিন্তু এর বিরুদ্ধে লড়বে। শিল্পীদের পন্য মনে করবেন না শিল্পীরাও মানুষ।” দুঃখের সঙ্গে শিল্পীর গলা থেকে বেরিয়ে আসে কথাগুলি।

Published on: ফেব্রু ৫, ২০১৯ @ ১৭:০৮

 


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

− 8 = 1