মুখোশ ও মানুষ

Main দেশ বিদেশ সাহিত্য
শেয়ার করুন

লেখকঃ সুমিত গুপ্ত

Published on: অক্টো ২৬, ২০১৯ @ ০১:১০

ছেলেবেলায় একবার সপরিবারে রাজস্থান বেড়াতে গিয়েছিলাম। চিতোরগড়ে আমাদের হোটেলের বাইরে সন্ধ্যার পর রাজস্থান ট্যুরিজমের উদ্যোগ বসেছিল বিচিত্র এক নাচগানের আসর। সেই আসরে ভীল উপজাতির কিছু শিল্পীকে আনা হয়েছিল তাদের ট্র্যাডিশনাল ফোক ড্যান্স পারফর্ম করার জন্য। ওই কাঁচা বয়সে তাদের জগঝম্পের পয়জার আর বাঁজখাই কিংখাবের পোষাকের ঘূর্ণীতে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আমি।  সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছিলাম তাদের মধ্যে একজনের মুখ দেখে। কালচে পাটকিলে রঙ-এর অবয়বে মোটা কোঁচকানো ভ্রুকুটি। ড্যাবড্যাবে, ঠিকরে আসা লাল লাল দৃষ্টিগোল্লা, চোখের নীচে থ্যাবড়ানো ঝলসানো রাক্ষুসে ভাঁজ, তস্য ঠাকুর্দামার্কা মোটা-মোটা গোঁফ, করাতের মতো পরিপাটি ঝকঝকে দাঁত আর হিলহিলে লোলজিহ্বা দেখে আঁতকে উঠে মুখ লুকিয়েছিলাম পিতৃদেবতার আস্তিনের আড়ালে। একটু বড় হয়ে জানা গেল ওটা আসলে ছিল অসুরের মুখোশ। মুখোশের সাথে আমার সেই প্রথম পরিচয়। মুখোশের সেই আতঙ্ক কাটাতে আমার লেগেছিল বেশ কিছুদিন। প্রায়শই মাঝরাতে হঠাৎ চমকে উঠতাম ঘুমের ঘোরে মুখোশের স্বপ্ন দেখে। কখনো সিলিং-এর দেওয়ালে বাদুরঝোলা হয়ে দাঁত ঝিকোচ্ছে, কখনো বা ছত্তিস কি আখড়ায় হামলে পড়ে অদৃশ্য হাতে গলা টিপে ধরছে। আবার, সকাল হলেই আকাশের ছেঁড়াখোড়া মেঘের দঙ্গলে, মশারির আলোছায়ার ভাঁজে তন্নতন্ন খুঁজতাম সেই মুখচ্ছবি। আজ বসেছি সেই মুখোশের কথা লিখতে, মুখোশের মরফোলজিক্যাল অ্যান্থ্রোগ্রাফির ম্যাক্রো অ্যানালিসিস ঘাঁটতে। দক্ষিণ ফ্রান্সের আলতামিরা গুহাচিত্রের চল্লিশ হাজার বছরের পুরনো ক্রিপ্টোগ্রাফির কোলাজ ছেড়ে রূপকথার নিডলফাইটারের আশ্চর্য বুনণে উঠে আসছে বাস্তবের মুখোশ। ধরা দিচ্ছে যোগেশ দত্তর মাইমের মতোই সপ্রাণ অভিব্যক্তি নিয়ে ইতিহাসের জীবন্ত প্যারাডক্স- মুখোশ।

(১)

মুখোশেরা জাদুকর। মুখ নেই তবু কথা বলে। হাত নেই, ফারের মুকুট। অনাঙ্গিক হাতে-পায়ে তা-থৈ তা-থৈ নাচ নেচে এলিয়েন্সুলভ উল্লাসে। শুয়োরের চামড়া ঢাকা সভ্যতার ক্লীব অঙ্গরাখা টেনে ছিঁড়ে রাজপথে নামায় মুখোশ। মুখোশের রঙ্গালয়ে মানুষের সৃষ্টি-ক্ষয়, ইতি-নেতি, ধ্বংস-নির্মাণ, যুদ্ধ-শান্তি, ক্রোধ-করুণা, হাসি-কান্না, প্রেম-ঘৃণা, নিত্য-অনিত্যের অষ্টসিদ্ধির অনুশীলিত গর্ভসঞ্চার। মূলবাসী মানুষের গতিশীল জীবনশৈলীর খণ্ড-বিখন্ড পোর্টেটই হল মুখোশ।

মুখোশ এক ছদ্মবিভঙ্গ। মন-মুখ-মুখোশের সুদীর্ঘ ধারাপাতে আদিম মানুষ পেয়েছে তার আত্মপরিচয়। সৃষ্টি করেছে তার ভাষা, কাব্য, নৃত্যনাট্যকলা আর বহুধা বৈচিত্রে একীভূত বর্ণময় সংস্কৃতির চিরলোকায়ত স্রোতধারা। মুখোশ হল আদিমমানুষের অন্তর্জগত ও বহির্জগতের লব্ধ সংঘাত-মিলনের, বাস্তব-বিভ্রমের, অপ্রকাশ-সম্প্রকাশের সিন্থেসিসে তৈরি সেই সর্বোচ্চ হাতিয়ার- যার অবগুন্ঠনে চেনা মুখ হয়ে ওঠে অচেনা; নিজের তুচ্ছ পরিচয়ের রুচিবালিশের মোহ ছিন্ন করে সপাট মাথা ঝেড়ে দাঁড়ানো, সমস্ত ক্ষুদ্রতা ছাপিয়ে ওঠা এক ডি-পারসনিফায়েড প্রবল ব্যক্তিত্ব। সম্ভব করে তোলে সগৌরবে দৃপ্ত এক এপিক-আইডল ফ্যান্টমের প্রাণপ্রতিষ্ঠা। মুখোশের মূলাধারে দাঁড়িয়েই নগন্য মুখোশ নর্তক গত্তীর্ণ হয় বাস্তবের মাটি থেকে পরাবাস্তবের নক্ষত্রলোকে। ছড়িয়ে দেয় তার ঘণীভূত বিষয়লিপ্ততা, তার জুরাসিক-ইচ্ছাপ্রাবল্যের শিশুসুলভ ছদ্মমতি বার্তার বিদ্যুৎবাহ শক্তিপুঞ্জ দর্শক্মনের নাড়ীচক্রের গভীরে। রোপণ করে মৃত্যু-ক্ষুধা-জরা-ব্যাধি-যুদ্ধ ও দারিদ্রের গ্রাসে ক্রমাবলুপ্তির বিরুদ্ধে আরোগ্যের বিপরীতায়ণ, প্রতিরোধের পূণরায়ণ, অশুভের ধ্বংসসাধনের পৌরাণিক জাগৃতির নিরক্ষীয় আবেগ সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীজনস্ততার চেতনার গভীরে। রক্ষা করে চলে সামাজিক-নৃতাত্তিক ভারসাম্যরক্ষার দায়বদ্ধতা। পৃথিবীর সমস্ত জনগোষ্ঠীর মুখোশই চরিত্রের এই মৌলিক্তায় সমধর্মী ও সমমাত্রিক।

এইবার আসি মুখোশের অ্যানাটমিতে। অসংখ্য ধরনের গঠনশৈলীর হাতেধরা হাতলওয়ালা মেকিমুখ-মুখোশ কিংবা কন্টেম্পোরারী হালুম-টালুম মুখোশ, মুখোশের আদি ও বহুলপ্রচারিত চেহারা। এই মুখোশে মুখের অঙ্গপ্রতঙ্গের নড়াচড়া দেখা যায় স্পষ্টভাবে। মুখোশ তৈরির প্রায় সমস্ত উপাদানই প্রাকৃতিক ও ভেষজ। কাঁচাকাঠ, ধাতু, ঝিনুক, গাছের ছাল ও আঁশ, রেজিন, হাতি, কুমির, শুয়োর ও হায়নার দাঁত, পোড়া মাটি, পশুর সিং, চামড়া ও লোম, পাথর, পাখির পালক আ ঠোঁট, মোম, ফার, কাগজ, ঘাস, গাছের পাতলা ডাল, কাপড়, শষ্যের তুষ, কাচ ও আয়নার টুকরো, মানুষের মাথার চুল, পুঁতির মালা মুখোশ তৈরির আদি উপকরণ। মুখোশের উপরিতলের আবরণ প্রস্তুতিতে খসখসে-কর্কশ সারল্য থেকে সূক্ষ্ম মসৃণতা, পালিশ ও বার্ণিশ করা কাঠ থেকে রঙচঙে মোজাইকের অলঙ্করণে বৈচিত্রময়।

(২)

মুখোশের আকৃতি ও রং মোটামুটিভাবে দিয়ে দেয় তার স্রষ্টা উপজাতি গোষ্ঠীর পরিচয় ও উৎসের সন্ধান। মুখোশ শিল্পীর ব্যবহৃত রং ও আকৃতিতে থাকে প্রত্যেক উপজাতির নিজস্ব কিছু চিরাচরিত বাধ্যবাধকতা। মুখোশে ভেষজ রং ছাড়াও ব্যবহার হয় বলিপ্রদত্ত পশুপাখির রক্তমিশ্রিত পোড়ামাটির প্রলেপ আর বাস্তু ও জাদুতন্ত্রের নানা উপাদান। প্রাচীন প্রবাদ- এতে নাকি বেড়ে ওঠে মুখোশ নৃত্যে ব্যবহৃত মুখোশের অলৌকিক শক্তির সক্রিয়তা। আইভারী কোস্টের “ডান” উপজাতির মুখোশ শিল্পীরা তাদের মুখোশে দির্ঘস্থায়ী কাদার রং এর ছোঁয়া আনবার জন্য কাদার মধ্যে পুঁতে রাখে তাদের মুখোশ। এই অদ্ভুত পদ্ধতিকে ওরা বলে “কাদাস্নান”। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আংশিকভাবে পুড়িয়ে মুখোশে আনা হয় ঘোর কালো রং। গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোয় “বোমা” উপজাতির যুদ্ধসংগীতের মুখোশ-নৃত্য উৎসবে ব্যবহৃত মুখোশে দেওয়া হয় সাদা-কালো পিগমেন্টের ছিট। নানা উপজাতির মুখোশে ব্যভৃত বিভিন্ন রং বহন করে বিভিন্ন অর্থ। যেমন চিনামাটির সাদা রং বহন করে মৃত্যু, আত্মা, দিনের আলো আর সৌভাগ্যের সংকেত। কাঠকয়লার কালো রং অশুভশক্তির প্রতিচ্ছায়া। বলিপ্রদত্ত পশুপাখির রক্তমিশ্রিত পোড়ামাটির গাঢ় লাল রং জীবনের প্রাণোচ্ছল উৎসবমুখরতার বাঙ্ময় উৎসার তরঙ্গ। ওই একই অর্থে ব্যবহার হয় নীল ও হলুদ রংও। কাঁচাকাঠে তৈরি মুখোশের স্থায়িত্ব বজায় রাখতে ব্যভার হয় “সেসেম” পাতার নির্য্যাস ও পামতেলের প্রলেপ। নাইজেরিয়ার “ইকোই” উপজাতীর মুখোশ তৈরি হয় অ্যান্টিলোপের চামরা দিয়ে। সুদূর অতীতে অ্যান্টিলোপের চামড়ার বদলে ব্যভার হতো যুদ্ধবন্দি জীবন্ত মানুষের চামড়া। দক্ষিণ আফ্রিকার “সোথো” উপজাতির মুখোশ তৈরি হয় ঘাস দিয়ে। তার সঙ্গে উলের জরী ও ঝুরির অলঙ্করণ। জাইরের “চোকুই” উপজাতি ব্যবহার করে গাচের পাতলা ডালপালা, আঁশ ও রেজিন তাদের নিজস্ব মুখোশ “চিকুঞ্জা”র অলঙ্করণে। গোষ্ঠীতে নতুন সদস্যের অভিষেক অনুষ্ঠানে মুখোশ নৃত্যের চন্দে দুলে ওঠে এই অদ্ভুতদর্শন মুখোশ। ক্যামেরুনের “নকাম্বে” উপজাতির কাঠের তৈরি মাথায় পরার মুখোশের আহ্লাদী নাম “মাবূ”। কালো ফেব্রিকে জোড়ালাগানো পাখির পালকের বিরাট ঝালরের বহিরঙ্গে ঢেকে যায় মুখোশের নর্তকের মুখ। ক্যামেরুনের “টিকার” ও মালির “মারকা” উপজাতি ব্যবহার করে হরেক ধাতুখণ্ড খচিত কাঠের ভারী মুখোশ। গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোর “মোঙ্গে” গোষ্ঠীর বাঁশ ও বেতের ঝুড়ি দিয়ে তৈরি মুখোশ বহন করে তাদের ব্যতিক্রমঈ শিল্প নৈপুণ্যের স্বাক্ষর। গাবোনের “ফাঙ্গ” উপজাতির ধাতুর তৈরি মিনিয়েচার “পাসপোর্ট” মুখোশের আঁটোসাটো নিখুঁত গঠন লজ্জা দিতে পারে নামিদামি শো-পিস প্রস্তুতকারী সংস্থাকেও। প্রবাস সফরে বেরিয়ে “ফাঙ্গ” উপজাতির মানুষ এই মুখোশ জড়ায় তাদের বাহুবন্ধে। যুদ্ধবিগ্রহে নিহত বীর পূর্বপুরুষ, গোষ্ঠীসর্দার ও রাজাদের প্রতেত্মা বহন করে চলে ঘানার “আশান্টে” গোষ্ঠীর সোনার তৈরি মুখোশ তাদের যুদ্ধনৃত্যের ঢাকের দ্রিম-দ্রিম শব্দের তালে-তালে। কঙ্গোরই অন্য এক উপজাতি “বাপান্দে” দের হাতির দাঁতের তৈরি মুখোশ ব্যভার হয় অসুস্থদের চিকিৎসার উপাচারের তাবিজ ও মাদুলী হিসেবে অশুভ আত্মার প্রতিরোধে।

(৩)

অলংকরণের দৃষ্টিনন্দন আঙ্গিকেও মুখোশের আশ্চর্য প্রতিভাস। নির্লিপ্ত সৌকুমার্য্যে পৃথিবীজোড়া তার গর্বোদ্ধত উপস্থিতি।উদ্দেশ্য কিন্তু একটাই- মুখোশের অতিপ্রাকৃতিক সত্তার শক্তি বৃদ্ধি। নৃত্যকালে মুখোশে ভর করা পূর্বপুরুষের সুচারু আত্মার প্রসাদলাভ। মুখোশে চাগিয়ে বসা আত্মময় গ্রেট ডেমনের বার্তাপ্রকাশের সূত্রধর। মুখোশের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল তার কস্টিউম। অনেকো সময় তা তৈরি হয় আলাদাভাবে সযত্ন পরিপাট্যে। মুখোশ এবং তার কস্টিউম তৈরিতে বাঁদর, সিংহ ও জিরাফের চামড়া, কুমির ও হায়নার দাঁত, বিদেশি মুদ্রা, আয়নার ছোট টুকরো, প্রতিটি জিনিস ব্যবহার হয় আলাদা আলাদা উদ্দেশ্যে। প্রতিফলিত সূর্যের আলোয় দুষ্ট আত্মার নাশে ব্যবহার হয় আয়নার টুকরো। প্রাচুর্য্য, ঐশ্বর্য্য ও বংশবিস্তারের শক্তি বৃদ্ধিতে শুভ আত্মার আশীর্বাদ সুনিশ্চিত করতে ব্যবহার কড়ির অলংকরণ। আবার যুদ্ধে-স্নজ্ঞহাতে-শিকারে বিপদ্মুক্ত হতে রক্ষা করা হিসেবে মুখোশে ব্যবহার হয় পাখির পালক। মুখোশ তৈরির এই খুঁটিনাটিতে লুকিয়ে থাকে মুখোশ শিল্পীদের প্রত্যক্ষ আবেগ। সেই আবেগ মুখোশে জাগ্রত করে তাদের পূর্বপুরুষের শুভ আত্মার বিমূর্ত অভিজ্ঞানকে। ট্রাইবাল কার্নিভালের মুহূর্তে ছন্দের লয়ে মুখোশ হয়ে ওঠে সেই প্রসুপ্ত চেতনায় অভিষিক্ত অঙ্গীকার। মুখোশ শিল্পীরা অনুসরণ করে চলে সেইসব সুপ্রাচীন সাংকেতিক পরিসৃজনের আঙ্গিকমালা। মুখোশ নৃত্যের সময় সেই স্বপ্নকর অনুরণন তোলে সূত্রবদ্ধ করে তার ভ্রাতৃপ্রতিম, সমদর্শী সমস্ত উপজাতীয় দর্শক সদস্যদের সমসত্ব যৌথ আবেগে।

Published on: অক্টো ২৬, ২০১৯ @ ০১:১০


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 + 2 =