মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল থেকে ‘রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের নিবেদিতা’- এক দীর্ঘ পথের কাহিনি

Main দেশ ধর্ম বিদেশ রাজ্য
শেয়ার করুন

সংবাদ প্রভাকর টাইমস-এর ২০১৮ সালের দীপাবলী সংখ্যায় ‘রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের নিবেদিতা’ শীর্ষক নিবন্ধটি লিখেছিলেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের স্বামীজী স্বামী বিশ্বনাথানন্দ মহারাজ।আজ তার ১৫৩তম জন্মদিবসে সেই নিবন্ধটির অংশ বিশেষ প্রকাশ করা হল। এই মহিয়সী নারীর প্রতি রিল আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা।
Published on: অক্টো ২৮, ২০২০ @ ১৫:৫৬
লেখক- স্বামী বিশ্বনাথানন্দ

এসপিটি প্রতিবেদনঃ “শাস্ত্র, গুরু এবং মাতৃভূমি- যেন তিনটি সুর, এই গুলি মিলিত হইয়া সৃষ্টি করিয়াছে স্বামী বিবেকানন্দের রচনার মহান সঙ্গীত। এই রত্নগুলিই তিনি দান করিতেছেন। এই গুলি হইতেই উপাদান সংগ্রহ করিয়া তিনি প্রস্তুত করিয়াছেন পৃথিবীর সকলের জন্য তাঁর আধ্যাত্মিক করুণার এক সর্ব রোগহর মহৌষধি। এ গুলি হইতেছে যেন তিনটি দীপ শিখা- একই দীপাধারে প্রজ্জ্বলিত, ভারতবর্ষ তাঁর হাত দিয়া উহা জ্বালাইয়া সাজাইয়া করিয়াছেন- তাঁহার সন্তানগণের ও সমগ্র মানব জাতির পথ নির্দেশ করিবার জন্য- ১৯ সেপ্টেম্বর ১৮৯৩ হইতে ৪ জুলাই, ১৯০২ পর্যন্ত মাত্র কয়েক বৎসরের কর্মের মাধ্যমে।” কথাগুলি লিখেছিলেন ভগিনী নিবেদিতা তাঁর ‘আমাদের স্বামীজী ও তাঁহার বাণী ও রচনা (প্রথম খণ্ড) বইটিতে।

নিজের নাম সই করেছেন- রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের নিবেদিতা

ইংরাজিতে স্বামীজীর গ্রন্থাবলী প্রথমে চার খণ্ডে বিভক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থ প্রকাশের সময় নিবেদিতা একটি ভূমিকা লিখেছিলেন যা অনবদ্য। এই গ্রন্থের ভূমিকায় নিবেদিতা ধর্মসভায় স্বামীজীর বক্তৃতা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে লিখেছেন- “যখন তিনি বক্তৃতা আরম্ভ করিলেন, তখন তাঁহার বিষয় বস্তু ছিল ‘হিন্দুদের ধর্মভাব সমূহ’ কিন্তু যখন তিনি শেষ করিলেন, তখন হিন্দু ধর্ম নতূন রূপ লাভ করিয়াছে। সেই ক্ষণটি ছিল সেই সদ্ভাবনায় পূর্ণ।” এই ভূমিকায় তিনি নিজের নাম সই করেছেন- রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের নিবেদিতা। (N of RK-V) আমরা প্রবন্ধটির নাম দিয়েছি রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের নিবেদিতা। নিবেদিতার সমগ্র রচনা – প্রবন্ধ, বক্তৃতা, চিঠি পত্রে সূক্ষ্মভাবে তাঁর গুরু ও পরম গুরুকে তিনি উল্লেখ করেছেন- নিবেদিতা এই গ্রন্থাবলীর ভূমিকা লিখেছেন ৪ জুলাই, ১৯০৭ খৃঃ এবং স্থায়ীভাবে তাঁর পরিচিতি উল্লেখ করেছেন ঐ নামে। “গুরু রামকৃষ্ণের মধ্যে বিবেকানন্দ জীবন রহস্যের কুঞ্চিকা লাভ করিয়াছিলেন।” স্বামীজী সমুদ্র মেখলা কন্যা কুমারী হতে তুষার মৌলী হিমালয় পরিভ্রমণ করেছিলান- সংসর্গে এসেছিলেন সাধু, পণ্ডিত, রাজা, চরমতম দারিদ্র মানুষ- তথা কথিত চাষাভূষা তৎকালীন হরজন-গিরিজন সম্প্রদায়ের সঙ্গে। তাঁর পদ্ম পলাশ দুটি আঁখি উন্মীলন করে দেখেছিলেন, “ভারত মাতা যে রূপে ছিলেন আর যে রূপ হয়েছেন।’ “এইভাবেই বিশাল সমগ্রতার সর্বাবগাহিত্ব তাঁহাকে উপলব্ধি করিতে হইয়াছিল, ইহারই সংক্ষিপ্ত ঘনীভূত প্রতিরূপ ছিল তাঁহার গুরুর জীবন ও ব্যক্তিত্ব।”

মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেলের কর্মজীবন

মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেলের কর্মজীবন প্রথমাবধিই ব্যাপক সমস্যাসঙ্কুল। ১৮৮৪ সালের গ্রীষ্মকাল, স্থান কেসউইক, শিক্ষকতার আমন্ত্রণ পেলেন মার্গারেট। এক স্বাধীন জীবনের স্বপ্নে বিভোর মার্গারেট। সুন্দর স্থান- অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। বোর্ডিং স্কুল। এক আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলে মার্গারেটের জন্ম। এখানে এসে ধীরে ধীরে বদলে গেল তাঁর পূর্বার্জিত আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণা। কেসউইক তাঁর জীবনে ধর্ম পিপাসা জাগিয়ে দিল। এই সময়ে কোন ক্যাথলিক মঠে যোগ দেওয়া নিয়ে তাঁর ভাবনা-চিন্তা দেখা দিয়েছিল। এই বিষয়ে পারিবারিক ধর্ম কেন্দ্রিক বিরোধ তথা বিতর্ক দেখা দিল মা ও মেয়ের মধ্যে। ১৮৮৭ সালে কেসউইক ত্যাগ করে মার্গারেট এলেন রাগবির এক অনাথ আশ্রমে। নিজেকে পরীক্ষা করছেন- স্বেচ্ছায় দরিদ্রকে বরণ করে। না, বিশেষ কিছু হল না। এলেন এক খনি অঞ্চলে – রেক্সহাম সেকেন্ডারি স্কুলে। ভাল লাগল- খনি অঞ্চলের শ্রমিক জীবনের মর্মস্থলটি স্পর্শ করতে পারবেন এই ভাবনায়। খনি অঞ্চলের মাঝে মাঝে সেন্ট মার্ক্স চার্চ। মার্গারেট ওখানকার চার্চ কর্মী হিসেবে নাম লেখান। বস্তিতে ঘুরে জনকল্যান কর্মে নিয়োজিত হলেন। এখানে মার্গারেট দেখলেন অনেক বাছ বিচার রয়েছে দরিদ্রদের সেবায় চার্চের কর্মসংস্কৃতি নিয়ে আরম্ভ হল মন কষাকষি। গীর্জার ভিতরকার খবর ফাঁস করে ‘নর্থ ওয়েলস গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় এক খোলা চিঠি লিখলেন। এই প্রথম মার্গারেটের শেখার শুরু। বুঝলেন কলমের শক্তির চেয়ে আপাতত বড় শক্তি নাই। ছদ্মনামে রিকসহ্যামের দরিদ্রদের মুখপাত্র হয়ে আরম্ভ হল সংগ্রামী জীবনের। বয়স একুশ বছর। জীবনের আর একটি অধ্যায়ের সূচনা হল মার্গারেটের। তেইশ বছরের এক ইঞ্জিনিয়ার- কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিতে কর্মরত – আলাপ হল মার্গারেটের সঙ্গে -ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব। যুবকটির মায়ের সঙ্গে গীর্জায় পরিচয় হল। বৃদ্ধা মার্গারেটকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন- ক্রমশঃ বাড়িতে যাতায়াত- প্রাকৃতিক কারণেই উভয়ের মধ্যে সঞ্চারিত হল অনুরাগ। যখন ওঁরা বাগদত্তা হবেন তখন এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হল যুবকটি- কয়েক সপ্তাহ পরেই অকালে ঝড়ে পড়ল এই তরুণের প্রাণ। এই ঘটনার পর নিবেদিতা চলে এলেন চেষ্টারে।

চেষ্টারে এসে মার্গারেটের পারিবারিক বন্ধন একটু জেগে ওঠে

এই চেষ্টারে এসে মার্গারেটের পারিবারিক বন্ধন একটু জেগে উঠল। মা মেরী নোবেল, বোন মে, ভাই রিচমন্ড- সব কাছাকাছি চলে এলেন। বোন মে ও শিক্ষিকা- ভাই কলেজের ছাত্র। এখানের ‘গুড সানডে ক্লাবে’ পরিচিত হলেন মার্গারেট। ক্লাবে শিক্ষা-সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা, সাহিত্য সভা, বিভিন্ন বিষয়ে বক্তৃতার মাধ্যমে ভাবের আদান-প্রদান – মার্গারেট কলম ধরলেন। ‘এলিজাবেথ নীলাস’ এই ছদ্মনামে লিখতে আরম্ভ করলেন। এই সময় মিসেস ডি-লিউ লন্ডনে একটি স্কুল খোলার জন্য মার্গারেটের সাহায্য চাইলেন- বলা মাত্রই মার্গারেট এই সুযোগটি গ্রহণ করলেন। মা,বোন সহ মার্গারেট লন্ডনে চলে এলেন। এখানে এসে মার্গারেটের বিয়ের সব ব্যবস্থা হল- এমনকি বিয়ের দিন পর্যন্ত। কিন্তু কী অদ্ভুত কারণে বিয়ে ভেঙে গেল- ঘর বাঁধার আশা হল চূর্ণ।পর পর দুটি আঘাত মার্গারেটের চিন্ত-চেতনাকে অন্য পথে প্রবাহিত করতে লাগল- এক অন্য জগতের রহস্য সন্ধানে তাঁর মন উদ্বেলিত। লন্ডনের ‘সিসেম ক্লেব’ এক বিখ্যাত স্থান – বার্নাড শ, হাক্সলি — এঁদের মতো নামজাদা মানুষের যাতায়াত। এই সিসেম ক্লাবের এক সম্মেলনে মার্গারেট পরিচিত হলেন লেডি ইসাবেল মার্গসনের সঙ্গে। নদীর এ কূল ভাঙে- একই সঙ্গে ও কূল গড়ে ওঠে। সংসারে এই ভাঙাগড়ার খেলায় মার্গারেট অভিজ্ঞ হয়ে গেছেন। জগতের ক্রিয়াকাণ্ড বা জাগতিক বিষয় নিয়েই যে শুধু ব্যাপৃত থাকেন তা নয় অতীন্দ্রিয় আধ্যাত্মিক তত্ত্বের সন্ধানের জন্য ও তাঁর ব্যাকুলতা আসে। এ বিষয়ে এক দক্ষ দিশারীর জন্য মন প্রাণ উন্মুখ। ধর্মে মার্গারেটের অটুট বিশ্বাস- মানুষ ধর্ম ছাড়া বাঁচতে পারে না- মনে মনে প্রার্থণা – ‘কোথায় পাবো তারে’।

উনি একজন প্রধান মৌলিক ভাবাপন্ন ব্যক্তি, বলেন নিবেদিতা

১৮৯৫ সালের অক্টোবর মাস। কুয়াশাচ্ছন্ন এক শীতের সকাল। খবরের কাগজে দেখলেন এক হিন্দু সন্ন্যাসী ২২ অক্টোবর পিকাডিলিস্থ প্রিন্সেস হলে বক্তৃতা করবেন। বিষয়-আত্মজ্ঞান। ওয়েস্ট মিনিস্টার গেজেটের এক সংবাদদাতা ভূয়সী প্রশংসা করে লিখেছেন, “স্বামীজী যখন কথা বলেন তখন তাঁহার মুখ বালকের মুখের মতো উজ্জ্বল হইয়া ওঠে- মুখ খানি এতই সরল অকপট ও সদ্ভাবপূর্ণ। … আমার সহিত যত ব্যক্তির সাক্ষাত হইয়াছে, তাঁহার মধ্যে উনি একজন প্রধান মৌলিক ভাবাপন্ন ব্যক্তি, একথা আমি নিঃসন্দেহে বলিতে পারি।” প্রিন্সেস হলে স্বামীজীকে দর্শন ও তাঁর বক্তৃতা শ্রবণে মার্গারেটের মনে এক আলোড়ন সৃষ্টি হল- সম্মান পেলেন বৃহত্তর আর এক জীবনের, সব ব্যথা, ব্যর্থতা ধুয়ে মুছে সাফ হতে লাগল।

Published on: অক্টো ২৮, ২০২০ @ ১৫:৫৬


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

80 + = 82