বিনা ব্যয়ে বাংলার কালো ছাগল ও গাড়ল ভেড়া পালন করে লক্ষ টাকা আয়ের পথ দেখাচ্ছে প্রাণী বিশ্ববিদ্যালয়

অর্থ ও বাণিজ্য এসপিটি এক্সক্লুসিভ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান রাজ্য
শেয়ার করুন

সংবাদদাতা- অনিরুদ্ধ পাল ও ডা. সৌমিত্র পন্ডিত

Published on: জানু ৮, ২০১৯ @ ২১:১৪

এসপিটি নিউজ, কলকাতা, ৮ জানুয়ারিঃ একটি গরু পালন করতে গিয়ে যে শ্রম এবং যে পরিমান টাকা ব্যয় হয়ে থাকে তার চেয়ে অনেক কম খরচে বাংলার কালো ছাগল ও গাড়ল ভেড়া পালন করে লক্ষ টাকা আয়ের মুখ দেখতে পাবেন গ্রামীণ মহিলারা। প্রথম পর্যায়ে সুন্দরবনের কিছু মহিলাদের এই সুযোগের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। যেহেতু অর্থনৈতিকভাবে তারা এখনও অনেকটাই পিছিয়ে। তাই তাদের মধ্যে থেকে বাছাই করে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিনশো গ্রামীণ মহিলাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে বাংলার কালো ছাগল ও গাড়ল ভেড়া কিভাবে পালন করা যায় তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলগাছিয়া ক্যাম্পাসে বিশেষ প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করা হয়েছে। বায়োটেক কিষাণ হাব-এর মুখ্য প্রকল্প পরিদর্শক বিশ্ববিদ্যালয়ের খামার বিভাগের সহ-অধিকর্তা অধ্যাপক ড. কেশব চন্দ্র ধারা একথা জানিয়ে বলেন-আগামিদিনে গ্রামীণ অর্থিনীতিতে নতুন দিশা দেখাবে বাংলার এই কালো ছাগল ও গাড়ল ভেড়া পালন।

এককথায় বলা যেতে পারে সুযোগ পাওয়া সুন্দরবনের সেইসব মহিলাদের কাছে এ যেন সত্যি এক “পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা”। কিছুদিন আগেও যারা জানতই না এভাবে প্রাণী পালন করে এত টাকা উপার্জন করা যায়, আজ তারাই এখন দলে দলে পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী বিশ্ববিদ্যালয়মুখী হবার জন্য ছোটাছুটি শুরু করেছেন। এভাবে সরকারি আনুকূল্যে সম্পূর্ণ বিনা ব্যয়ে পাঁচদিনের এমন সুন্দর এক প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দিয়ে বৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রাণীপালনের পাঠ নিয়ে ফিরছে এটা আগে কেউ ভাবতেই পারত না। এখন সেটা সম্ভব করে দেখিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়। আর বাস্তবায়ন করে তার সফল রূপদান করে চলেছেন কৃষি খামার বিভাগের সহ অধিকর্তা ড. কেশব চন্দ্র ধারা। সংবাদ প্রভাকর টাইমস সংবাদ মাধ্যমকে এই বিষয়টির উপর তিনি এক বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। যেখানে তিনি জানিয়েছেন-

  • কেন একজন প্রাণীপালক এধরনের ছাগল কিংবা ভেড়া পালন করবেন?
  • এই ধরনের প্রাণী পালন করে কত টাকা তাঁর আয় হবে?
  • অর্থনৈতিকভাবে তিনি সত্যিই কতটা লাভবান হবেন?  

সহ অধিকর্তা ড. কেশব চন্দ্র ধারা বলেন- “আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক বছরে ৪০০জন খামারিকে প্রশিক্ষণ দেব। তার মধ্যে ৬০ শতাংশ অন্তত মহিলা রাখতে হবে। ৪০০ জনের মধ্যে ইতিমধ্যেই ৩৪৩জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে গেছে। আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমাদের ৪০০ লক্ষ্যমাত্রা আমরা ছাড়িয়ে যাব।”

কোন অঞ্চলকে এবং কেন বাছা হয়েছে

“জোনটা হল কোস্টাল জোন। সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে আমরা প্রপোজাল দিয়েছিলাম। বায়োটেক কিষাণ হাবের জন্য। সেটাকে মাথায় রেখেই সুন্দরবন এলাকাকেই তারা অনুমোদন দিয়েছে। এখানে মূলতঃ বাংলার কালো ছাগল এবং গাড়ল ভেড়াকে লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে যদি আমরা প্রশিক্ষণ দিতে পারি, তাদেরকে জীবিকার একটা নতুন দিশা দেখাতে পারি তাদের ক্ষেত্রে তা খুব কার্যকরী হবে।তাছাড়া সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলকে বাছার কারণ হল-সেখানকার নোনা জলে কৃষিকর্ম সেভাবে হয় না, নেই শিল্পও। সুন্দরবনের গাড়ল ভেড়া যা এখানকার অধিবাসীরা বহুদিন ধরেই পালন করে আসছেন এবং বাংলার কালো ছাগল বা ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট, যা সুন্দরবনে পালনের উপযোগী-এই দুই জাতকেই এদের পালন করতে দেওয়া হচ্ছে, তবে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে।কারণ এখানে যে জলা জায়গা সেখানে বাংলার কালো ছাগল এবং গাড়ল ভেড়া খুব সহজেই বৃদ্ধি হয়। বিশেষ করে মহিলারা তাদের পারিবারিক কাজের সাথে সাথে এই কাজটা করতে গেলে তাদের অধিক পরিশ্রম করতে হবে না। একটা গরু পালন করতে গেলে তাকে নিয়ে যতটা দৌড়-ঝাঁপ করতে হয় অনেক শ্রম ব্যয় হয় তার চেয়ে অনেক কম শ্রম ব্যয় করে ছাগল এবং ভেড়া পালন করা যায় এবং তার চেয়েও লাভ বেশি হয়।” বলেন ড. ধারা।

একটি গরু পালনে যে খরচ তার চেয়ে কম খরচে ১০টি ছাগল পালন সম্ভব

ড.ধারা উদাহরন দিয়ে বুঝিয়ে দেন যে একটি গরু পালনের চেয়ে বাংলার কালো ছাগল কিংবা গাড়ল ভেড়া পালন কতটা লাভদায়ক। আর তা যদি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে করা যায়। সে কথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন-“একটা গরু আর তা যদি উন্নত প্রজাতির যেমন ধরুন জার্সি গরু হয় সেখান থেকে যা আয় হয় তার চেয়ে অনেক বেশি আয় হয় বাংলার কালো ছাগল কিংবা গাড়ল ভেড়া পালনে। ধরা যাক, একটা গরু যদি দিনে ১০ থেকে ১৫ লিটার দুধ দেয়, সেক্ষেত্রে লিটার প্রতি দুধের দাম যদি ২৫ থেকে ২৬ টাকা হয় তবে ১৫ লিটার দুধ বেচে ৩৭৫ থেকে ৪০০ টাকার মতো প্রতিদিন খামারি্র আয় হয়। এরপর গরুটির খাওয়া থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক দেড়শো থেকে দুশো টাকা খরচ হয়। তাহলে একটা গরু থেকে দিনে ২০০ টাকা আয় আসে। এবার ৩৬৫ দিনের মধ্যে ২৭০ থেকে ২৮০ দিন গরুটি দুধ দেবে। আমি সেটা ২৫০ দিন ধরছি। ২৫০দিন দুধ দিলে ২০০টাকা ধরে হিসেব করলে বছরে ৫০ হাজার টাকা একটা গরুর থেকে আয় হয়। যদিও এটা আরও কমবে। কমে সেটা সেটা ৩৫-৪০ হাজার টাকা আয় হবে। আর এই গরুটি পালন করতে যে পরিমান জায়গা লাগবে বা খরচ লাগবে এবং যা পরিশ্রম হবে সেই সময়ের মধ্যে ১০টি ছাগল সে পালন করতে পারবে। ১০টি ভেড়া পালন করতে পারবেন খামারি।”

ছাগল কিংবা ভেড়া পালন করে লাখ টাকা আয়

“একটি ছাগল দুটি করে কখনও ‘বছরে তিনটি করে বাচ্চা দেয়। তাহলে দু’বছরে ছ’টি বাচ্চা দিচ্ছে। ছটি’ বাচ্চা একটি ছাগল থেকে হলে ১০টি ছাগল থেকে ৬০টি বাচ্চা হচ্ছে। এবার গড়ে যদি আট থেকে ১০ কেজি ছাগল বিক্রি হয় -এক একটা ছাগলের দাম আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা করে। তাহলে এবার হিসেব করুন তো- দু’বছরে ৬০টি ছাগল হয়েছে। ধরে নিলাম সেখান থেকে কিছু মরে গিয়ে থেকে গেল ৫০টি। এগুলি যদি গড়ে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হয় তাহলে দু’বছরে ১ লাখ টাকা আয় হচ্ছে। তাহলে বছরে সেখান থেকে ৫০ হাজার টাকা আসছে।যেখানে গরু থেকে আসছে ৩৫-৪০ হাজার টাকা। আর গরু পালনে প্রচন্ড শ্রম দিতে হয়।” বলেন প্রাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি খামার আধিকারিক ড. কেশব চন্দ্র ধারা।

ছাগল কিংবা ভেড়ার খাবারের অভাব হয় না

একই সঙ্গে গরু পালনের সমস্যার কথাও সমানভাবে তুলে ধরে কেন ছাগল কিংবা ভেড়া পালন সহজ ও লাভদায়ক সেকথাও পরিষ্কার করে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সহ অধিকর্তা। তিনি বলেন-“একবার যদি একটি গরু মরে যায় তাহলে কি হবে বুঝতে পারছেন? বিশেষ করে ১৫ শতাংশ যেখানে মৃত্যুর হার রয়েছে সেখানে একটি গরু মরে গেলে সব শেষ।যেমন ধরুন ২০০ মুরগির মধ্যে দুটো মরে গেলে আপনার কিন্তু গায়ে লাগবে না। সেখানে যদি একটি গরু মরে যায় সেটা আপনার অনেকটা গায়ে লাগবে। আজকে ধানি জমি এত হয়ে গেছে যে গরুর খাবারের জন্য ঘাস চাষ করার জায়গাই নেই। সেক্ষেত্রে ছাগল আপনি খেলার মাঠে, জমির আলে, যখন ধান তোলা হল সেই জায়গায় ছেড়ে দিলেন। সেখানে সে চড়ে খেতে পারবে। তার জন্য আলাদা করে খুব বেশি খাবার দিতে হয় না।তাদের খাবারের অভাব হয় না।”

একটি গরুর চেয়ে ১০টি ছাগল বেশি লাভদায়ক

“আপনি বিদেশ থেকে উন্নত প্রজাতির গরু আনলেন। কিন্তু সে গরু তো এখানে নাও মানিয়ে নিতে পারে। ইংল্যান্ডের জার্সি গরু যে আবহাওয়ার মধ্যে থাকে সেই আবহাওয়া তো এখানে সে পাবে না। ফলে এখানে কিন্তু সে অসুস্থ হতেই পারে। সেখানে আমি যদি ১০টি করে ছাগল দি তাহলে সেটা অনেক বেশি লাভবান হতে পারে। আজকে তাই গ্রামীণ অর্থনীতিতে সাড়া ফেলে দিয়েছে এই প্রকল্প। আগস্ট মাসে আমরা এই প্রশিক্ষণ শুরু করেছি।ইতিমধ্যে ৩০০ থেকে ৩৫০জন মহিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেলেছে। যদি তাদের আগ্রহই না থাকত তা হলে তারা এখানে আসত নাকি?আমাদের একটা ওয়েবসাইট আছে। আছে আমাদের অ্যাপ। এসবের মধ্যে দিয়ে আমরা এসবের প্রচার করছি। আধুনিক প্রযুক্তি এসেছে এসব তুলে ধরতে।” বলেন ড.ধারা।

প্রকল্পের খরচ ১ কোটির উপরে

প্রকল্প আধিকারিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি খামার সহ অধিকর্তা ড. কেশব চন্দ্র ধারা বলেন- “এই প্রকল্পের জন্য ১ কোটি ৩৭ লক্ষ ৩ হাজার টাকা অনুমোদন করা হয়েছে। এই বছরে তো ৬৭-৬৮ লাখ টাকা মতো দিয়েছে।তার মধ্যে ৪০-৪৫ লাখ টাকা প্রায় খরচ হয়ে গেছে।”

‘উন্নত প্রজনন কেন্দ্রে’র মাধ্যমে ছাগল দেওয়ার পরিকল্পনা

বিনা পয়সায় খামারিদের যে ছাগল দেওয়া হবে তা যে আর পাঁচটা ছাগলের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত তা কিন্তু বলার অপেক্ষা থাকে না। সেদিকে একশোভাগ খেয়াল রেখে চলেছে প্রাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্নিষ্ট বিভাগ। সেকথা স্মরণ করে ড. ধারা স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিলেন-“এরপর আমরা যেটা করেছি- উন্নত মানের ছাগল কিংবা ভেড়া প্রদান। আর তা দিতে গেলে তাকে তো বলতেই হবে এটা উন্নত জাতের। আর সেটা বলার জন্য এবং তাদের হাতে উন্নত জাতের ছাগল-ভেড়া দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে “উন্নত প্রজনন কেন্দ্র” করছি। আমরা সেখানে ভালো ছাগল-ভালো ভেড়া রেখে দেব। তাদের আমরা দেখব-তিনটি না চারটি নাকি পাঁচটি বাচ্চা দিচ্ছে। তার বৃদ্ধি ঠিক মতো হচ্ছে কিনা। সেই প্রজনন করে যে ভাল বাচ্চাটা হবে সেই ভাল বাচ্চাটাই আমরা ওদের হাতে তুলে দিতে চাই। ব্যবহারিক জীবনে আমরা এর প্রয়োগ করব। আমরা ১০টি ছাগল নিয়ে আসব। এদের বাচ্চা হল। তার মধ্যে থেকে সবচেয়ে ভাল বাচ্চাটিকে আমরা দেব। এজন্য আমরা এখন সন্ধান চালাচ্ছি ভাল ছাগল কোথায় আছে-সেখান থেকে নিয়ে এসে এই প্রক্রিয়া শুরু করব।”

Published on: জানু ৮, ২০১৯ @ ২১:১৪


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 + 6 =