বাঃ স্বপ্না ! দু’পায়ে ১২ আঙুল, অভাবের সঙ্গে লড়াই- এশিয়াডে অসাধ্য সাধন করে দেখিয়েছেন এই বাঙালি তরুণী

উত্তর সম্পাদকীয় খেলা দেশ
শেয়ার করুন

অনিরুদ্ধ পাল

Published on: আগ ৩০, ২০১৮ @ ১৪:০২

এসপিটি প্রতিবেদনঃ একদিন যাঁর বাবা রিকশায় চাপিয়ে মানুষজনকে এক মাথা থেকে আর এক মাথায় টেনে নিয়ে যেতেন, দু’বেলা দ’মুঠো খাবারের সংস্থান করতে শরীরের সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে রিকশা টানতেন আজ তাঁর মেয়ে দেশের জাতীয় পতাকা সবার উপরে তুলে ধরে পরিবারের সব যন্ত্রণার কিছুটা হলেও নিষ্কৃতি দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির মেয়ে স্বপ্না বর্মন। একদিকে অভাবের সঙ্গে লড়াই আর একদিকে দু’পায়ে ১২টি আঙুল নিয়ে ট্র্যাকে অমানুষিক পরিশ্রম।অবশেষে সব কিছু সার্থক হয়েছে জাকার্তা এশিয়াডে হেপ্টাথলনে সোনা জিতে।

যত সহজে আমি উপরের ভূমিকাটি লিখে ফেললাম এত সহজ কিন্তু ছিল না ২১ বছরের বাঙালি তরুণী স্বপ্নার সোনা জেতার এই লড়াইয়ের জীবন। খুব কঠিন বললেও কম বলা হবে। একজন রিকশা চালকের পরিবারের যন্ত্রণা যে কী হতে পারে, তা তো স্বপ্নার চেয়ে ভালো কেউ বলতে পারবে না।

কত জ্বালা, কত যন্ত্রণা, কত কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করে গিয়েছেন এই লড়াকু তরুণী। আমরা মেরি কমের বায়ো পিক দেখেছি। আমরা এম এস ধোনির বায়োপিক দেখেছি। আমার তো মনে হয় স্বপ্নাও এঁদের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।

ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছেন বাবা-মায়ের লড়াকু জীবন। তখন থেকে স্বপ্না বুঝে গিয়েছেন-  তাদের মতো পরিবারের মানুষদের লড়াই করেই বেঁচে থাকতে হবে। লড়াই হল তাদের আসল বন্ধু।এই লড়াই ছাড়া তাদের এক মুহূর্ত চলবে না। তাঁর মা চা বাগানে মজুরের কাজ করেন। বাবা রিকশা চালাতেন। কিন্তু বর্তমানে অসুস্থ হয়ে বাড়িতে শয্যাশায়ী।

স্বপ্না জানেন-  অনেক কষ্ট করে এই জায়গায় তাকে পৌঁছতে হয়েছে। আর এখান থেকে খালি হাতে ফিরে যাওয়া মানেই সব শেষ হয়ে যাওয়া। বাবা-মায়ের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেওয়া। তাদের মনে দুঃখ দেওয়া। তা তিনি কোনওদিনই করতে পারেন না। তাই শেষ সময় পর্যন্ত তাকে লড়ে যেতেই হবে। তা সে যত কষ্টই হোক না কেন। এভাবেই চালিয়ে গেছে লড়াই।

কিন্তু এই লড়াই চালাতে গিয়ে তাকে কম নাকাল হতে হয়নি। কারণ, স্বপ্নার দুই পায়ে ছ’টি করে মোট ১২টি আঙুল রয়েছে। যা তাকে প্রতি মুহূর্তে হয়রান করে গিয়েছে। সারা বিশ্বে এটাও একটা অনায়াসে হয়তো বিশ্ব রেকর্ড হতে পারে যে ১২টি আঙুল নিয়ে হেপ্টাথলনের মতো কঠিন প্রতিযোগিতায় সোনা জয়।

স্বপ্না জানতেন, এটা কঠিন তবে তা সম্ভব। এর ফলে দৌড়নোর সময় তাকে সমস্যার মধ্যে পড়তে হতো। পা অতিরিক্ত চওড়া হওয়ার জন্য জুতো পড়তে অসুবিধা হতো। এর ফলে জুতো খুব তাড়াতাড়ি ফেটে যেত। এর জন্য তাকে খুব বেগ পেতে হয়েছে। প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেট অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়ের স্পোর্টস ফাউন্ডেশন এ ব্যাপারে স্বপ্নাকে সাহায্য করেছে। এরপর থেকে স্বপ্নার সমস্যা কাটতে শুরু করে এবং তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য পেতে শুরু করেন।

স্বপ্না খেলার থেকে যে পুরস্কার মূল্য পেয়ে থাকেন তা তাঁর বাবার চিকিৎসার সাহায্যে আর বাড়ির সংসার চলাতেই খরচ হয়ে যায়। ঘরের অবস্থাও খুবই খারাপ। যেখানে বাড়ির ছাদ ও দেওয়াল কাঁচা। এর আগে স্বপ্না ২০১৭ সালে পাতিয়ালা ফেডারেশন কাপে সোনা জেতেন হেপ্টাথলনে।এছাড়াও ভূবনেশ্বরে এশিয়ান অ্যাথলেটিক্সে সোনা জেতেন এই বাঙালি তরুণী।

ছোটবেলাতেই তাঁর কোচ সুকান্ত সিনহা চিনে নিয়েছিলেন স্বপ্নার প্রতিভাকে।তিনি জানান, স্বপ্না খুব গরিব পরিবারের মেয়ে। খেলার সামগ্রী কেনার মতো পয়সা ওর ছিল না। শুধু তাই নয় অনুশীলন চালানোর মতো খরচ করা্র ক্ষমতাও ছিল না স্বপ্নার। আমি ওর মধ্যে এক উজ্জ্বল প্রতিভা সেই সময় লক্ষ্য করেছিলাম। যখন সে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ত। তখন থেকেই আমি ওকে অনুশীনন করাতে শুরু করি।

চার বছর আগে ইঞ্চিয়ান এশিয়ান গেমসে স্বপ্না চতুর্থ স্থান পেয়েছিলেন। গত বছর অবশ্য এশিয়ান অ্যাথলেটিক্সে সোনার পদক জেতেন।

মেয়ের সাফল্যে আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েছিলেন মা বাসনা।মুখ দিয়ে কোনও কথা বের হয়নি। তবে মেয়ে যখন এশিয়াডে লড়ছেন মা তখন কালী মন্দিরের ভিতর বসে মেয়ের সাফল্য চেয়ে কালী মায়ের কাছে হাত জোড় করে প্রার্থণা জানিয়ে গিয়েছেন। মেয়ে সোনা জিতে এক নয়া ইতিহাস রচনা করেছেন। মা হয়তো সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত দেখতে পারেননি, কিন্তু তিনি কালী মায়ের কাছে নিজের সন্তানের কষ্টের লড়াইয়ের কথা বলতে পেরেছেন।আজ অচেনা স্বপ্না হয়ে উঠেছেন সারা দেশের কাছে ভারতবাসীর আদরের ‘সোনার মেয়ে’।

বাঃ স্বপ্না! তুমি প্রমাণ করে দিয়েছো- টাকা, অভাব, কষ্ট, জ্বালা, যন্ত্রণা এসব কখনও বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। যদি নিজের লক্ষ্য স্থির থাকে তবে কোনও বাঁধাই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। পরিশ্রমই সাফল্যের মূল মন্ত্র-সেটা আরও একবার তুমি দেখিয়ে দিলে বাংলার তথা ভারতের ‘সোনার মেয়ে’ স্বপ্না। তোমাকে জানাই সংবাদ প্রভাকর টাইমসের পক্ষ থেকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।

Published on: আগ ৩০, ২০১৮ @ ১৪:০২

 


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

− 7 = 3