বঙ্গবন্ধু শিখিয়েছিলেন, রাজনীতি মানে ভালোবাসা

বাংলাদেশ বিদেশ
শেয়ার করুন

ড. কামাল হোসেন, সংবিধান প্রণেতা, আইনজ্ঞ, রাজনীতিবিদ

Published on: আগ ১৪, ২০১৮ @ ১৬:১৮

এসপিটি, ঢাকা, ১৪ আগস্টঃ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে জল্পনা-কল্পনা যখন চলতে থাকে। বিদেশি সাংবাদিকরা বাংলাদেশে আসেন। সর্বক্ষণ খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা। অবশেষে ৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আশ্বাসের পাশাপাশি ঘোষণা করলেন ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হবে। ৬ মার্চ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও আমাকে ৭ মার্চ ভাষণের খসড়া তৈরির নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৬০-৬১ সালের দিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আদালত প্রাঙ্গণে প্রথম দেখা। তাঁর জামিনের জন্য সরোজি সাহেব গেছেন। আমিও পিছনে পিছনে গিয়েছি। আমি বলতাম ‘মুজিব ভাই’। দেখার পর বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, ‘কামাল তুমি আইনজীবী হলে অনেক টাকা আয় করতে পারবে এটা সত্য। কিন্তু রাজনীতি করলে মানুষের ভালোবাসা পাবে। মানুষের সেবা করার সুযোগ রাজনীতি করে যেভাবে সম্ভব সেটা আর কোনোভাবে সম্ভব নয়।’ বঙ্গবন্ধু শিখিয়েছিলেন, রাজনীতি করলে ভালোবাসা পাওয়া যায়।

তখন সারাদেশে মার্শাল ল’ চলছিল। তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সাহেবের বাসায় বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী থাকত, আমিও যেতাম। ওখানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই কথা বলি যে, মার্শাল ল’ কতদিন চলবে? তো উনি বললেন যে, ‘পাঁচ বছর, খুব বেশি হলে ১০ বছর।’ এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল। যখন ১৯৬৯-এ আইয়ুব ক্ষমতা থেকে চলে যায়, তখন আমি তাঁকে বলেছি, আপনি কীভাবে অঙ্ক করলেন? ঠিক আপনার কথা মতোই তো আইয়ুব খান বিদায় নিচ্ছে। তখন বঙ্গবন্ধু হাসলেন। এসব ব্যাপারে তাঁর অসাধারণত্ব আমি খেয়াল করেছি। এভাবেই তাঁর সঙ্গে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি।

সারাদেশে ছয়দফা বাস্তবায়ন অথবা এক দফা (স্বাধীনতা) দাবি করা হয়। পরে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণের পর ইসলামাবাদে গোলটেবিল বৈঠকে ছয় দফার দাবি জানানো হয়। বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমাদের আলোচনা চলতে থাকল। ছয়দফার বিষয়ে আমরা আপসহীন থাকলাম। এরইমধ্যে ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে তিনি মার্শাল ল’ জারি করেন। আমরা ৫৬ ভাগ জনসংখ্যার ভিত্তিতে বরাদ্দসহ সংবিধান সংশোধনীর প্রস্তাব দিলে ইয়াহিয়া খান আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নিলেন। কিন্তু তার বাস্তবায়ন পাচ্ছিলাম না। পরে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন দেওয়া হলো। নির্বাচনে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে আমরা জয়লাভ করলাম। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু পুরান ঢাকা এবং তেজগাঁও এলাকা দুটি আসন থেকে জয় লাভ করলেন। পরে বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, ‘আমাকে তো একটি আসন ছাড়তে হবে। তুমি তেজগাঁও আসন থেকে সংসদে আস।’ আমি উপনির্বাচন করলাম। বঙ্গবন্ধুর আসনের কারণে আমার বিপরীতে কেউ প্রার্থী হতে সাহস করল না। আমি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলাম। প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের সংসদ হলাম। কিন্তু নির্বাচনের পরও পশ্চিমা সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা শুরু করল।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে জল্পনা-কল্পনা যখন চলতে থাকে। বিদেশি সাংবাদিকরা বাংলাদেশে আসেন। সর্বক্ষণ খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা। অবশেষে ৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আশ্বাসের পাশাপাশি ঘোষণা করলেন ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হবে। ৬ মার্চ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও আমাকে ৭ মার্চ ভাষণের খসড়া তৈরির নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন, ‘এমনভাবে ভাষণ দিতে হবে যেন, আর্মিরা সাধারণ মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ না চালায়। আমরা যদি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করি তাহলে আর্মিরা হত্যাযজ্ঞ শুরু করবে।’ এরই মধ্যে ৭ মার্চ দুপুরের পর শুরু হলো বক্তব্য। এ সময় হাইকোর্টের প্রাঙ্গণে বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদের ওপর পাক আর্মিরা মেশিনগান তাক করে বসে আছে। যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়, তাহলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এমনভাবে কৌশলে বক্তব্য দিলেন সাপও মরল লাঠিও ভাঙল না।

অবশেষে ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু দলের নেতা-কর্মীদের আত্মগোপনে চলে যেতে বললেন। আমি এবং আমীর-উল ইসলাম একত্রে তাজউদ্দীনের ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোডের বাসায় গিয়ে তাঁর বাড়িতে উঠলাম। রাত ৮টার দিকে তিনি তাঁর প্রতিবেশী এম আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে যখন সাত মসজিদ রোডের দিকে যাচ্ছিলেন, তখনই তাঁরা খবর পান যে রাস্তায় রাস্তায় মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা গাছ কেটে ব্যারিকেড বসিয়েছে। এই সময় মোজাফফর নামের কুমিল্লার এক সংসদ সদস্য আমাদের জানান যে নিউমার্কেটের সামনে ইপিআর অবস্থান নিয়েছে। ফলে পুরান ঢাকায় না গিয়ে আপাতত ধানমন্ডির আশপাশে আত্মগোপনের উদ্যোগ নিলাম।

এ সময় আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে যাই। রাত ৯টার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে যাওয়ার পর দেখলাম বঙ্গবন্ধু রাতের খাবার খাচ্ছেন। আমরা গিয়ে তাঁকে আত্মগোপনের কথা বললে তিনি অস্বীকার করেন। একইসঙ্গে আমাদের দ্রুত আত্মগোপনে যেতে বলেন। আমরা লালমাটিয়ার কাছাকাছি যাওয়ার পর আমি তাজউদ্দীন ভাইকে বললাম, আমাদের সবার একসঙ্গে থাকা ঠিক হবে না। রাতের পরিস্থিতি বুঝে আলাদাভাবে থাকার পর সকালে নদী পার হয়ে ঢাকা থেকে বের হয়ে যাব। অবশেষে তাজউদ্দীন ও আমীর-উল ইসলামকে বিদায় দিয়ে আমি লালমাটিয়ায় এক আত্মীয়ের বাসায় উঠলাম। পরের দিন আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও তাঁরা আমাকে ছেড়ে চলে যান। পরে চারদিন বাড়ি পরিবর্তন করে থাকার পর লালমাটিয়ায় একটি বাসা থেকে ৩০ মার্চ আমাকে আটক করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি আর্মিরা। সন্ধ্যার সময় আমাকে আটক করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে একটি গেস্টহাউসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এক আর্মি অফিসার আমাকে বলেন, ‘তোমার নেতাকেও এই জায়গায় রাখা হয়েছিল। তুমিও এখানে থাক।’ প্রথম বুঝতে পারলাম বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে একদিন রাখার পর ৩১ মার্চ বা ১ এপ্রিল আমাকে একটি বিমানে করে প্রথমে করাচি পরে ইসলামাবাদে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে রাওয়ালপিন্ডি কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে রাখা হয়। কারাগারে একটি লকআপে শুধু আমি একাই ছিলাম। পরে সেখান থেকে হরিয়ানাপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। নির্জন একটি কক্ষে আমাকে রাখা হয়। যেখানে গার্ডদের সঙ্গেও কথা বলা নিষেধ ছিল আমার। এভাবে দিন কাটতে লাগল।

অবশেষে ২৮ ডিসেম্বর হঠাৎ করে জেল সুপার এসে আমাকে সব কিছু গোছগাছ করে তৈরি হতে বললে বিস্মিত হলাম। কাপড়-চোপড় এমনকি বই-পুস্তক যা এত দিন জেল কর্তৃপক্ষের হেফাজতে ছিল, সব দিয়ে গেটের সামনে এনে গাড়িতে তুলে আমাকে রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে আসা হয়। সেখানে আনার পর সিহালার নির্মাণাধীন পুলিশ দফতরের একটি বাংলোতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঢুকে অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেলাম হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ২৫ মার্চের কালরাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে শেষ সাক্ষাতের দীর্ঘ নয় মাস পর ২৮ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডির সিহালার এক বাংলোতে বঙ্গবন্ধুকে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। এ সময় আমরা পরস্পরকে আবেগে জড়িয়ে ধরলাম। বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে পারলাম রাওয়ালপিন্ডির মিওয়ানওয়ালী কারাগারে তাঁকে এই দীর্ঘ নয় মাস বন্দি করে রাখা হয়েছিল।

অবশেষে ৭ জানুয়ারি রাতে ভুট্টো করাচি বিমানবন্দর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসেন এবং একটি পাকিস্তানি বিমানে করে পরের দিন সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধুসহ আমি লন্ডন হিথরো বিমানবন্দরে নামি। পাকিস্তান থেকে লন্ডন পর্যন্ত আমাদের যাত্রার খবর গোপন রাখা হয়। লন্ডন থেকে মাত্র এক ঘণ্টা দূরত্বের অবস্থান থেকে জানানো হয় যে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ঘণ্টার মধ্যে হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবেন। অতি অল্প সময়ের নোটিশে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদায় অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে ছুটে আসেন স্যার ইয়ান সাউদারল্যান্ড। লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর আগমন সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার প্রবাসী বাঙালির সঙ্গে ছুটে আসেন ব্রিটেনের বিরোধীদলীয় নেতা হ্যারোল্ড উইলসন, সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট, রেজাউল করিম, এ কে খান, বেগম আবু সাঈদ চৌধুরী প্রমুখ দেশি-বিদেশি কূটনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদ।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ নিজ এলাকা থেকে দ্রুত লন্ডন ফিরে এসে নিজের বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত বিমানে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করেন। ওরই মধ্যে ঢাকায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে কথা বলে বঙ্গবন্ধুর যাত্রার সময় ইত্যাদি ঠিক করে ফেলা হয়। অবশেষে ৯ জানুয়ারি সকাল ৭টায় লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে যাত্রা করে সাইপ্রাস-শারজাহ ও দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি বিকেল ৩টায় প্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশের মাটিতে আমি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অবতরণ করলাম।

Published on: আগ ১৪, ২০১৮ @ ১৬:১৮

 

 

 


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

+ 1 = 8