আ.ফ.ম মুহিতুল ইসলাম মুহিত
Published on: আগ ১৪, ২০১৮ @ ০৯:৪৬
১৪ আগস্টের রাত। রাতে ডিউটি ছিল আমার সহকর্মী ছাফদারের। কিন্তু ওর ব্যক্তিগত কাজ থাকায় আমাকে ডিউটি করতে অনুরোধ করল। আমার দুপুরের ডিউটি ছাফদার করল। সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে গাড়ি এলো। ৮টায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ৩২ নম্বরে পৌঁছলাম। ছাফদার চলে গেল। রাত ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত গেটে পাহারারত আর্মিদের সঙ্গে গল্প করলাম। ১টা ১০ মিনিটে আমাদের জন্য নির্ধারিত বিছানায় শুতে গেলাম লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। হঠাৎ টেলিফোন মিস্ত্রি মতিন আমাকে ধাক্কা দিয়ে উঠাল। বলল প্রেসিডেন্ট সাহেব আমাকে টেলিফোনে ডাকছেন। সম্ভবত তখন সময় ভোর ৪টা ৩০ বা ৫টা। চারদিক বেশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমি তড়িঘড়ি করে এসে টেলিফোন ধরলাম। বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, ‘সেরনিয়াবাতের বাসায় দুস্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে টেলিফোন লাগা।’
আমি টেলিফোন লাগানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পাচ্ছিলাম না। তারপর গণভবন এক্সচেঞ্জে চেষ্টা করছি, সে মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু আমার সামনে এলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হলো পুলিশ কন্ট্রোল রুমের?’
আমি বললাম, স্যার, পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ধরছে না। আমি গণভবন এক্সচেঞ্জে লাইন পেয়ে গেলাম। আমি বলছিলাম, হ্যালো, আমি পিএ টু প্রেসিডেন্ট বলছি। ও প্রান্ত থেকে কোনো উত্তর এলো না, কিন্তু টেলিফোন রিসিভার সম্ভবত অপারেটরের হাতে ছিল। আমি হ্যালো হ্যালো বলে চিৎকার করছিলাম। তখন বঙ্গবন্ধু আমার হাত থেকে রিসিভার নিলেন। বললেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি।’ ঠিক তখনই এক ঝাঁক গুলি আমাদের অফিস কক্ষের জানালার গ্লাস ভেঙে অফিস কক্ষের দেয়ালে লাগল। অন্য টেলিফোনে চিফ সিকিউরিটি অফিসার জনাব মহিউদ্দীন সাহেব টেলিফোন করল। আমি ধরলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা গ্লাস ভাঙা আমার ডান হাতের কনুইয়ের কাছে এসে বিঁধল। কেটে রক্ত ঝরা শুরু হলো। দুই জানালা দিয়েই ভীষণ গুলি আসছে। বঙ্গবন্ধু আমার টেবিলের পাশে শুয়ে পড়লেন। আমি দেয়াল ঘেঁষে বঙ্গবন্ধুর পাশে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর গুলি বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধবন্ধু উঠে দাঁড়ালেন। আমিও উঠলাম। উপর থেকে চাকর আবদুল ওনার পাঞ্জাবি ও চশমা নিয়ে এলো। আমার কক্ষে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবি পরলেন। বারান্দায় এসে বললেন, ‘আর্মি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি, এত গুলি চলছে, তোমরা কী করো?’ বলে উপরে উঠে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর শেখ কামাল ভাই নিচে বারান্দায় এসে বলল, ‘আর্মি-পুলিশ ভাই, আসুন আমার সঙ্গে।’ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তিন-চারজন কালো পোশাকধারী লোক সামনে এসে দাঁড়াল। আর্মি ও ডিএসপি নরুল ইসলাম সাহেব আমাকে পিছন দিক থেকে টান দিয়ে অফিসকক্ষের মধ্যে নিয়ে গেলেন। অফিসকক্ষের ফুল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের মাঝামাঝি হাত রেখে আমি বাইরে উঁকি দিয়ে দেখছিলাম, ওখানে কী হচ্ছে। গুলির শব্দে কামাল ভাই হঠাৎ আমার কাছে এসে ছিটকে পড়লেন। আমিও পড়ে গেলাম তাঁর পিছনে। কামাল ভাই বললেন, ‘আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল।’
কালো পোশাকধারীদের সঙ্গে খাকি পোশাকধারীও দেখলাম। আমার ধারণা ছিল দুস্কৃতকারীরা আক্রমণ করছে। তাই তাঁরা আমাদের সেফ করতে এসেছে। আমাদের দুস্কৃতকারী ভাবছে। তাই আমি বললাম, ভাই, উনি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। ওরা ব্রাশ ফায়ার করল। শেখ কামালের উরুর উপরে বুক ফুঁড়ে একটা গুলি লাগল আমার হাঁটুর মাঝে। কামাল ভাইয়ের রক্ত ও আমার রক্তে প্রায় একাকার হয়ে গেছে। কোনার পুলিশ বক্স থেকে ওদের লক্ষ্য করে গুলি আসল। ওরা ওই দিকে পজিশন নিল। ডিএসপি সাহেব আমাদের পিছনের গেট দিয়ে জোর করে বের করে আনলেন। গেটের বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গে একজন আর্মি আমাদের চুল ধরে টেনে দাঁড় করাল। আমি বললাম, রাতে আমাদের ডিউটি ছিল, তাই এসেছি।
আর্মি বলল, ‘ঠিক আছে আপনাদের কিছু বলব না, ওখানে লাইনে দাঁড়ান।’ দেখি, মেইন গেটের সামনে কয়েক জন পুলিশসহ টেলিফোন মিস্ত্রি লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে। আমরাও লাইনে দাঁড়ালাম। টেলিফোন মিস্ত্রি মতিনের পাশে ডিএসপি সাহেব, আমি, আমার পরে এসবির সাব-ইন্সপেক্টর দাঁড়াল। হঠাৎ একজন আর্মি এসে এসবির সাব-ইন্সপেক্টরকে গুলি করল। গুলি বাম দিকের বুকে লাগে। বুকের মাংস কিমা কিমা হয়ে আমার ও ডিএসপি সাহেবের মুখে লাগে। সাব-ইন্সপেক্টর পড়ে যান। মুখ দিয়ে এক পশলা রক্ত ওঠে এবং একটা ঝাঁকুনি দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। সাব-ইন্সপেক্টরকে মেরে রাইফেল আমার দিকে তাক করল। সেই মুহূর্তে আর একজন আর্মি এসে ধমক দিয়ে রাইফেল ছিনিয়ে নিল। বলল, ‘তোমাকে এদের মারতে কে বলেছে?’ ওই আর্মির আচরণ দেখে মনে হলো তিনি একজন অফিসার, যদিও তাদের কোনো ব্যাচ ছিল না। ওই আর্মির জন্য আমার জীবন রক্ষা হলো।
দেখলাম রাইফেলবিহীন ব্যক্তিকে বারান্দায় নিয়ে রাইফেলটা দিয়ে দিল। তারপর ৪/৫ জন ব্যক্তিকে আমাদের পাহারায় রেখে ব্রাশ ফায়ার করতে করতে উঠে গেল। কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ শুনতে পেলাম, ‘আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাস…।’ গুলির শব্দ। মহিলাদের আর্তচিৎকার। নিচের রান্না ও গোয়ালঘর থেকে রান্নার বুড়ি ও রাখাল আজিজকে আমাদের লাইনে এনে দাঁড় করাল। নাসের কাকার হাতের আঙুল সাদা কাপড় দিয়ে পেঁচানো। রক্ত ঝরছিল। তাতে মনে হচ্ছিল তাঁর আঙুলগুলো গুলিতে উড়ে গেছে। নাসের কাকা বললেন, ‘স্যার, আমি তো রাজনীতি করি না, কোনো রকম ব্যবসা-বাণিজ্য করে খাই।’ পাশে দাঁড়ানো একজন ঘাতক বলল, ‘শেখ মুজিব বেটার দ্যান নাসের।’
যে ঘাতক গান পয়েন্টে নাসের কাকাকে নিয়ে এসেছিল সেই বলল, ‘ঠিক আছে আপনাকে কিছু বলব না। আপনি ওই কক্ষে গিয়ে বসুন।’ বলে আমাদের লাইন থেকে বের করে আবারও গান পয়েন্টে আমাদের অফিসকক্ষের সঙ্গে অ্যাটাচড বাথরুমে নিয়ে গুলি করল। তারপর ঘাতক ফিরে এলো গেটের সামনে। নাসের কাকা হঠাৎ পানি বলে চিৎ্কার করে উঠলেন। ঘাতক বলল, ‘যা পানি নিয়ে আয়।’ সেই ঘাতক পানির পরিবর্তে আবারও গুলি করল। নাসের কাকার কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর এক ঘাতক শিশু রাসেলকে নামিয়ে নিয়ে এলো। শিশু রাসেল আমাদের দেখে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?’ আমার ধারণা ছিল ঘাতকরা অন্তত শিশু রাসেলকে মারবে না। এক ঘাতক আমার কাছ থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে মেইন গেটের ডান পাশে পুলিশ বক্সে নিয়ে গেল। রাসেল কাঁদছিল। মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য ঘাতকের কাছে কেঁদে আবেদন জানাচ্ছিল। ঘাতকটি রাসেলকে ওখানে একজনের পাহারায় রেখে ভিতরে গেল। অল্প কিছুক্ষণ পর এসে বলল, ‘চলো তোমাকে তোমার মায়ের কাছে দিয়ে আসি।’ বলে ভিতরে নিয়ে গেল। ওই বাড়ির সমস্ত কণ্ঠস্বর থেমে গেল। সর্বশেষ হত্যাটি ছিল শিশু রাসেলকে।
আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। ওদের অনুমতি ছাড়াই বসে পড়লাম। প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। লুঙ্গিটা পায়ের সঙ্গে লেগে গেছে। এক ঘাতক ভিতর থেকে একটা ছোট ময়লা লুঙ্গি এনে দিয়ে লুঙ্গি পাল্টাতে বলল। আমি বহু কষ্টে লুঙ্গিটি পাল্টিয়ে নিলাম। ঘাতক আমার গায়ের রক্তমাখা গেঞ্জিটিও খুলে নিল। আমাদের অফিসকক্ষে চেয়ারের হাতলে রাখা কামাল ভাইয়ের রক্তমাখা আমার হাফশার্ট এনে দিল এক ঘাতক। কাজের ছেলে আবদুল ও রমাকে আমাদের লাইনে নিয়ে এলো। দেখলাম আবদুলের পেটে ও হাতে গুলি লেগে রক্ত ঝরছে। লাইনে দাঁড়ানো বুড়ি আমাকে ও আবদুলকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঘাতকদের বারবার অনুরোধ করছিল। বঙ্গবন্ধুর মিলিটারি সেক্রেটারি এবং ডিজিএফআইয়ের ডিরেক্টর কর্নেল জামিলও নিহত হয়েছিলেন ঘাতকদের গুলিতে শুক্রাবাদের মোড়ে। তার মৃতদেহ তার লালরঙা টয়োটা গাড়িতে করে নিয়ে আসা হলো ৩২ নম্বর বাড়ির ভিতরে। তাকালাম কর্নেল জামিলের মানিব্যাগ ও হাতের দিকে। আমার ঘড়িটিও নেই। অন্য এক সেপাই হাতে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সম্ভবত সকাল ৮টা ৩০ বা ৯টার দিকে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে গেল।
(রহীম শাহ সম্পাদিত ‘পঁচাত্তরের সেই দিন’ বই থেকে সংক্ষেপিত)
Published on: আগ ১৪, ২০১৮ @ ০৯:৪৬