Published on: মে ৩, ২০২১ @ ২০:৩৭
Reporter: Aniruddha Pal
এসপিটি নিউজ, কলকাতা, ৩ মেঃ কোভিড মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ-এ দেশ হারাল তার আরও এক কৃতী সন্তানকে। সারা জীবন যিনি মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন সেই মাতৃসাধক শ্রীশিশির কুমার শর্মা পরমধামে যাত্রা করলেন। গত ১ মে শিলিগুড়ির এক বেসরকারি হাসপাতালে তিনি প্রয়াত হন। বয়স হয়েছিল প্রায় ৬৯ বছর। তাঁর প্রয়াণে শোকাহত দেশ-বিদেশের অগণিত ভক্ত-শিষ্য। গত কাল ২ মে রায়গঞ্জে তাঁর শেষ কৃত্য সম্পন্ন হয়।যাবার বেলায় ভক্তদের উদ্দেশ্যে তাঁর শেষ বাণী- ‘সকলে মিলে ভালো থেকো’।
গত অমাবস্যাতেও যজ্ঞ করেছেন তারাপীঠে
মাতৃসাধক শিশির কুমার শর্মা গত মাসেও তারাপীঠে গিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠিত ত্রিণয়নী আশ্রমে মানুষের কল্যাণে যজ্ঞ করে এসেছেন। করোনা কালে গত বছর লকডাউনের সময় বেশ কয়েক মাস তিনি তারাপীঠে যেতে পারেননি। সেই সময় তিনি উত্তর দিনাজপুরের বিন্দোল গ্রামে নিজের বাড়িতেই যজ্ঞ করেন প্রতি মাসের অমাবস্যায়। গত ২২ তারিখ তিনি বিধানসভার ভোটও দিতে গিয়েছিলেন। ওই দিন ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথাও হয়েছিল। পরদিনও মাতৃসাধক শ্রী শিশির কুমার শর্মার সঙ্গে অনেক কথা হয়।
দাদা বলেছিলেন-ভাই আমার শরীরটা খারাপ
পাঠকদের জানিয়ে রাখি- তাঁর সঙ্গে আমার দাদা-ভাইয়ের সম্পর্ক ছিল। তাই আমি তাঁকে দাদা বলেই ডাকতাম। তিনিও আমাকে ভাই বলে আবার কখনও অনিরুদ্ধ বলে সম্বোধন করতেন। তাঁর সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছিল গত ২৭ এপ্রিল। ওইদিন আমার করোনা টিকা নেওয়ার কথা ছিল। যে কোনও বিষয়েই তাঁর কাছ থেকে মতামত নেওয়াটা আমার কাছে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। সেই মতো তাঁর কাছে এই প্রসঙ্গ তোলার সময় দাদা বলেছিলেন-ভাই আমার শরীরটা খারাপ। আমি ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। আমি বলেছিলাম, ঠিক আছে রাতে ফোন করে খোঁজ নেব। কিন্তু তার পর থেকে দাদার ফোনের সুইচ অফ ছিল। তারপর আমি দাদার অত্যন্ত স্নেহধন্য আলাপনকে ফোন করে জানতে পারি যে দাদার অবস্থা খুবই খারাপ। তাঁকে শিলিগুড়িতে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ভেন্টিলেশনে আছেন। এয়ার অ্যাম্বুলেন্স করে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু সেই সুযোগ আর হল না। ১ মে দেশ-বিদেশের অগণিত শিষ্য-ভক্ত-গুণমুগ্ধ স্বজনদের ছেড়ে পরমধামে যাত্রা করলেন সকলের প্রাণের মানুষ। তাঁর প্রয়াণে দিশেহারা দাদার সমস্ত ভক্ত-শিষ্যরা।
সংবাদ প্রভাকর টাইমস আজ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল
দাদার প্রয়াণে শোকস্তব্ধ আমরাও। সংবাদ প্রভাকর টাইমস আজ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল।কারণ, এই সংবাদ মাধ্যমের সূচনা হয়েছিল দাদার হাত ধরেই। ২০১৫ সালের রথযাত্রার দিন। তারপর থেকে প্রতিটি মুহূর্তে দাদা ছিলেন আমাদের মাথার উপর ছাতার মতো। তাঁর পরামর্শ আর উপদেশ মেনেই এগিয়ে চলেছে সংবাদ প্রভাকর টাইমস। আধ্যাত্মিকতা বিষয়ে লেখালেখি দাদা খুব পছন্দ করতেন। এই বিষয়ে লেখালেখিতে আমাকেও অনুপ্রাণিত করতেন।প্রায়ই তাঁর সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে ফোনে আলোচনা হত। করোনা কালে গত এক বছর ধরে ফোনে আধ্যাত্মিকতা নিয়ে নানা ধরনের কথপোকথন হয়েছে। অনেক কিছু জেনেছি। ঠিক ছিল করোনা মিটে গেলে আশ্রমে তাঁর মুখোমুখি হয়ে বিস্তারিত জানবো। কিন্তু তা আর হল না।
যে ছবিটা ব্যবহার করেছি সেটি দাদা নিজেই আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে পাঠিয়েছিলেন।তাই এই ছবি দিয়েই তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলী জানালাম।
এই প্রতিবেদন যখন লিখছি তখন সামনে দাদার মুখ ভেসে আসছে
আজ এই প্রতিবেদন যখন লিখছি তখন সামনে দাদার মুখ ভেসে আসছে। আর শুধু ভাবছি, এই লেখাটা তো দাদাকে পড়ে শোনাতে পারব না। তাহলে কী হবে! এর আগে যত লেখা লিখেছি, সব কটাই ছাপার আগে দাদাকে পড়ে শুনিয়েছি। প্রতিবারই দাদা শুনে বলেছেন- ভালো হয়েছে ভাই। আজ আর সেই অবকাশ নেই। তবু আমি বিশ্বাস করি, দাদা এই লেখা দেখবেন। তিনি আমাকে বলতেন- ভাই, তুমি এখন বেশি করে পড়ো। ভগবদগীতা পড়বে। দেখবে সব কিছু জানতে পারবে।
তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই জীবনের সব বাঁধা এক নিমেষে দূর হয়ে যেত
লেখালেখি নিয়ে তাঁর ছিল প্রবল আগ্রহ। তিনি ছিলেন জ্ঞানের ভান্ডার। তিনি ছিলেন মুশকিল আসান। তিনি ছিলেন দীনের দয়াল। অসহায়ের অবলম্বন। তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই জীবনের সব বাঁধা এক নিমেষে দূর হয়ে যেত। এক অদ্ভূত প্রশান্তি ভরা মুখমন্ডল ছিল দাদার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মতোই তিনি ছিলেন ভালোবাসার কাঙাল। তাই তো তিনি বলতেন- প্রেম, ভক্তি, বিশ্বাস নিয়ে ভগবানকে ডাকতে। তিনি ছিলেন মা তারার সন্তান। বলতেন- মায়ের কাছে কিছু চাইবে না। সব সময় বলবে- মা তোমার জয় হোক, মা তোমার মঙ্গল হোক, মা তোমার কল্যাণ হোক। যে সন্তান মায়ের মঙ্গল কামনা করে মা সর্বদা সেই সন্তানের মঙ্গল করে। তিনি বলতেন- এই জগতে একমাত্র ঈশ্বর হলেন- পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।তিনি হলেন দীনের দয়াল।তাঁকে স্মরণ করবে। আরও কত কথা তিনি বলতেন, যা এত স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়।
শঙ্কর ক্ষ্যাপা বলেছিলেন- শ্মশানে আজ এসেছে রাজসন্ন্যাসী, প্রেমের জগৎশেঠ
শঙ্কর ক্ষ্যাপার সঙ্গেও ছিল তাঁর অন্তরঙ্গ যোগাযোগ। “শ্মশান ভৈরব” প্রবন্ধে এ প্রসঙ্গে লেখক ড. নিমাই চন্দ্র ঝা লিখছেন- মোক্ষকামী সন্ন্যাসী শ্রী শঙ্কর ক্ষ্যাপা আসন ত্যাগ করে দাঁড়িয়ে পড়লেন ও সমবেত ভক্তদেরকে বললেন-“দ্যাখ, দ্যাখ ভাল করে চেয়ে দেখে নে। শ্মশানে আজ এসেছে রাজসন্ন্যাসী, প্রেমের জগৎশেঠ। মহাভিক্ষু আজ দ্বারে দ্বারে মহাভিক্ষা যাচে রে। যা তোরা ওর কাছে, ও বাংলা-হিন্দি-উর্দু-আরবি-ইংরাজি-সংস্কৃত জানে, ও জানে যোগ-তন্ত্রমন্ত্র-জ্যোতিষ। তাঁর গুরু মুন্সিজিকে সালাম করে আবার ত্রিসন্ধ্যা গায়ত্রী জপে। ডান হাত বামহাত দিয়ে সমানে কলম চালায়। বেদ-পুরান-বাইবেল-কোরান-রপ্ত করে সার করেছে ভালবাসা। যা ওর কাছে, মিটবে তোদের সকল আশা।”
নিভে গেল দীপ
আজ থেকে প্রায় ৬৯ বছর আগে ১৯৫২ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর রাজশাহী জেলার পুঠিয়াতে মা ইরাবতীদেবীর কোল আলো করে পৃথিবীতে এসেছিলেন মাতৃসাধক শ্রী শিশির কুমার শর্মা। জ্বলে উঠেছিল দীপ। অবশেষে ২০২১ সালের ১লা মে তা নিভে গেল।
Published on: মে ৩, ২০২১ @ ২০:৩৭